মহাপুরুষদিগের জীবনে বাহ্যিক ঘটনাবলীর বিস্ময়কর সমাবেশ প্রায়শ দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহাদের সমগ্র জীবন, অতীন্দ্রিয় বস্তুর সন্ধানে অতিবাহিত। সেইজন্য তাঁহাদের জীবনের ঘটনাবলীও মনোরাজ্যে, লোকচক্ষুর অন্তরালে সঙ্ঘটিত হইয়া থাকে। কেবল যখন তাঁহারা অপর সাধারণের সহিত মিশিবার সময় নিজ অনুভূতি সকলের কিঞ্চিৎ আভাস প্রদান করেন, তখনই সে বিষয় অপরে জানিতে পারে। ঐরূপে নিজ অনুভূতি সম্বন্ধে তাঁহাদের অপরের নিকট কিছু বলিবার অবকাশও বিরল এবং উহার ধারাও এক ভিন্ন রকমের। ঈশ্বরেচ্ছায় তাঁহাদের সহিত কখনো কখনো এমন জিজ্ঞাসু ব্যক্তিরও বাক্যালাপ হয়, যখন তাঁহারা কি যেন একটি নিয়মের বশে ঐ প্রকার বাক্যালাপ করিয়া থাকেন। কখন কাহাকে কতটুকু কিভাবে বলেন, তাহাও তাঁহাদের (মহাপুরুষদের) পূর্ব-সঙ্কল্পিত রূপে হয় না। যে লোকোত্তর মহাপুরুষের নাম প্রবন্ধ শীর্ষে উল্লিখিত হইয়াছে, তিনি নিজে তাঁহার জীবনের ঘটনাবলী সম্বন্ধে কখনো কখনো কাহারো কাহারো নিকট যাহা বলিয়াছেন—তাহা কেহ কেহ সেই সময় লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। নিম্নে দুই একটি ঐরূপ ঘটনা (যাহা সাক্ষাৎ মতো শুনিবার সুযোগ হইয়াছিল) প্রদত্ত হইল।
তাঁহার নিজমুখের উক্তি: ১। একবার ভাদ্রমাসে ফল্গুনদী পার হব—দেখছি নদীতে এক কোমর জল। একজন পার হয়ে এলো। আমিও পার হতে চললুম, পিছনে একজন ছিল সে সাঁতার জানতো। নদীর জল দেখ দেখ করে অনেকটা বেড়ে গেল। যাই কতকটা গিয়েছি, দেখলুম আমার গলাজল হয়ে গেছে, পরে আমি ডুবে যাচ্ছি দেখেই—ভাবলুম এবার আর তো রক্ষা পাব না—সঙ্গে যে লোকটি ছিল, তাকে বললুম—“আমি সাঁতার জানি না—স্রোতে আমায় কোথায় নিয়ে ফেলে ঠিক নেই— বাঁচবার আশা কম—গুরুভাই সকলকে আমার প্রণাম জানিও।” পরে শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করে বললুম—“এই নাও ঠাকুর শেষ প্রণাম।” এ কথা বলে যাই ডুবে গেলুম, দেখলুম কে যেন আমার হাত ধরে স্রোতের অগাধ জলের মধ্য দিয়ে ওপরে নিয়ে তুলে দিল।
২। আর একবার হরিদ্বারে তপস্যায় আছি, দুমাস ধরে জ্বরে ভুগছি—একদিন এমন হয়েছে—জল পিপাসা পেয়েছে, তবু কমণ্ডলুটি ধরে জল খাব সে শক্তি নেই। কি করি কোন রকমে উঠে যাই কমণ্ডলু ধরতে যাচ্ছি, পড়ে গেলুম—অবশ হয়ে পড়লুম। তখন খুব অভিমান হলো শ্রীশ্রীঠাকুরের ওপর। বললুম, “তাই তো, এমন ভুগছি—এমন কেউ নেই যে একটু খোঁজ-খবর করে।” এমনি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি—দেখছি—শ্রীশ্রীঠাকুর এসে আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, আর বলছেন—“কি ভাবচিস, দেখচিস তো আমি কাছে কাছে রয়েছি। কি চাস—লোকজন চাস, না টাকা-পয়সা চাস, কি চাস বল।” তখন আমি বললুম—“কিছুই চাই না, শরীর থাকলে রোগ তো হবেই, চাই—যেন তোমায় না ভুলি, যেখানেই থাকি তোমায় যেন স্মরণ থাকে।” পরদিন ওখানকার এক জোয়ান সাধু এসে আমায় বললে—“বলো, কি পথ্য করবে, আমি ভিক্ষে করে এনে দেব।” আমি বললুম, “আমার কিছুই দরকার নেই।” তবু সে শুনবে না। আর একজন সাধুর সেদিন পঞ্চাশ টাকার মনিঅর্ডার এল। সে এসে বললে—“তোমার এখন টাকার দরকার—ভুগচো, এ টাকা তুমিই নাও, তোমার সেবায় লাগুক।” আমি কিছুতেই নিলুম না।
৩। প্রশ্ন—মহারাজ! ধ্যান জমে কি রূপে?
উত্তর—তাঁর নাম নিয়ে পড়ে থাকলে যদি হয়।
প্রশ্ন—তবু তো ধ্যান অভ্যাস করতে হবে?
উত্তর—হবে বৈকি।
স্বামী চেতনানন্দের সম্পাদিত ‘স্বামী সুবোধানন্দের স্মৃতিকথা’ থেকে