হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
ইতিমধ্যে ছোটকাকু মানে অনিন্দ্যসুন্দর বসু এই করোনাকালে তাঁর ঘনিষ্ঠ চারজন স্বজনকে হারিয়ে খুবই বিষণ্ণ আছেন। তবু ছোটদের দাবি মেনে নিলেন। অনিন্দ্যসুন্দর জানেন জীবন এইভাবেই চলবে। মানে চালিয়ে নিতে হবে। দুঃখ-শোকের মধ্যে দিয়েই সমস্ত চড়াই-উতরাই পার হতে হয়। এদিকে অয়নদের বাড়ির সবার করোনা হয়েছিল। অয়ন তার সবচাইতে প্রিয় বন্ধু দাদুভাইকে হারিয়েছে। অয়নের দাদুভাই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় খুব সুন্দর গল্প লিখতেন ছোটদের সব কাগজে। আর প্রত্যেক রবিবার ওদের বাড়ির ছাদে সন্ধ্যায় বসে জমিয়ে গল্প বলতেন। শুধু অয়ন কেন অয়নের দাদুভাইয়ের প্রস্থান ওর সমস্ত বন্ধুদের কাছেই এক শোকের আবহ সৃষ্টি করেছে। প্রদীপবাবু সুগার এবং হার্টের পেশেন্ট ছিলেন। প্রথম ভ্যাকসিন নেওয়ার সাতদিন পরই প্রদীপবাবু করোনায় আক্রান্ত হন। অক্সিজেন লেভেল নেমে যাওয়ায় অনেক দৌড়োদৌড়ির পর অয়নদের পাড়ায় ভলেন্টিয়ার্সের কাকুরা অক্সিজেন সিলিন্ডার, ডাক্তার জোগাড় করে অনেক চেষ্টা করেন। বাড়িতেই মৃত্যু হয় প্রদীপবাবুর। সরকারি নিয়মানুসারে তাঁর দাহকার্যও সমাপন হয়। গতকালই পাড়ায় প্রদীপবাবুর স্মরণসভায় দলমত নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ উপস্থিত থেকে স্মৃতিচারণায় অংশ নিয়েছেন। বিশেষ করে সুন্দর ব্যবহার এবং লেখার মুনশিয়ানা প্রায় সকলের স্মরণকথায় উঠে এসেছে।
গতকাল এই স্মরণসভায় ছোটকাকুর সঙ্গে একসঙ্গে বসেছিল তাঁর প্রিয় ভাইপো ভাইঝিরা। স্মরণসভার শেষে ছোটকাকুই বললেন ‘রবীন্দ্রনাথের গানটা শুনলি তো। কত যুগ আগে লিখে গিয়েছেন —‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’...! সামনেই বাইশে শ্রাবণ একটা বড় গাড়ি করে আমরা আটজন মিলে করোনার সমস্ত বিধি মেনে তোদের নতুন একটা জায়গায় নিয়ে যাব।
—কোথায় ছোটকাকু? আনন্দী বলল।
—এখন বলব না।
—বলোই না! অর্কর বায়না।
—যেদিন যাব সেদিনই দেখবি। আমাদের সব্বার চেনা জায়গা। খুব সক্কালবেলা যাব। ভিড় এড়ানোর জন্য। এই জায়গাটাও তোদের দেখা দরকার। অর্ক বলল, ‘আমরা যে ভ্যাকসিন পাইনি। কিছু হবে না তো?’
—সে জন্যই তো বলছি পনেরো জনের যে ছোট বাসগুলো হয়, স্যানিটাইজার নিয়ে ডাবল মাস্ক পরে সেই বাসে চেপে সেখানে যাব। আমাদের সব্বাইকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। আর যাওয়ার আগে বাসটাকেও খুব পরিষ্কার করে স্যানিটাইজ করে নিতে হবে। আমরা তো ড্রাইভার সহ সাতজন। কাজেই যথেষ্ট নিয়মবিধি মেনেই আমরা যাচ্ছি। আশাকরি সবাই এই নিয়মে থাকলে সুস্থ থাকব। করোনাকে হারাতে পারব।
—সঠিক কথা। ঋষিকা বলল।
বাসের মধ্যে আমরা কিছু খাওয়াদাওয়া করব ছোটকাকু? অয়ন বলল।
প্রত্যেকের জন্য একটা করে বিস্কুটের প্যাকেট নেওয়া হবে। যাত্রাপথে দু’প্রান্তে দু’জন করে বসে বিস্কুট আর জল খাওয়া শেষ করে আবার দু’জন শুরু করবে। এইভাবে আমাদের যেতে হবে। এই নিয়ম চিকিৎসাগতভাবে একদম সঠিক। কাজেই আমরা এইসব নিয়মের বিরুদ্ধাচরণ করব না।
আজ বাইশে শ্রাবণ, আট আগস্ট দু’হাজার একুশ। বাংলার দু’হাজার আঠাশ। গতকাল রাতেই ছোটকাকু একটা রজনীগান্ধার মালা কিনে সেটাকে স্প্রে করে স্যানিটাইজ করে রেখেছেন। ভোর ছ’টায় আমাদের বাস রহড়া থেকে বিটি রোড ধরে চলতে শুরু করল। ছোটকাকুর উদ্দেশে সবাই সমস্বরে জিজ্ঞেস করলাম ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ ছোটকাকু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বল তো অয়ন কোথায় হতে পারে? ঋষিকা বলল, জোড়াসাঁকো? সুমেকা বলল জোড়াসাঁকোয় তো আজ কোনও অনুষ্ঠান হয় না। পঁচিশে বৈশাখের দিন হয়। আনন্দী বলল, ‘নিশ্চয়ই নিমতলা। বাইশে শ্রাবণ কবির স্মৃতিসৌধে এইদিন অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ মালা দিয়ে থাকেন। বাবার কাছে শুনেছি।
—ঠিক ধরেছিস। ছোটকাকু বললেন,
—আমরা সবাই তাঁর স্মৃতিসৌধ স্পর্শ করতে পারব? অর্ক বলল।
তখন ছোটকাকু বুঝিয়ে বললেন, আজ নয়। অতিমারি শেষ হলে আর একবার নিয়ে আসব। তোমরা নিমতলায় বাস থেকে নেমে দূর থেকে দেখবে। আমি ভিড় এড়িয়ে স্মৃতিসৌধের উপর মালাটা দিয়ে চলে আসব।
ছটা চল্লিশের মধ্যে নিমতলায় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিসৌধের কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম, ভিড় তেমন নেই। ছোটকাকু মালা হাতে স্মৃতিসৌধে পরিয়ে দিলেন। প্রণাম করলেন। আমরাও দূর থেকে প্রণাম করলাম। মাইকে একজন বিশিষ্ট কারও কণ্ঠে রবীন্দ্র গান দূরে দূরে সকালবেলার রৌদ্রস্নাত বাতাসে ভেসে যাচ্ছে ‘ঐ মহামানব আসে...’
বাসে উঠতে উঠতে ছোটকাকু আমাদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমরা সেই মহামানবের দিকেই তাকিয়ে আছি। যিনি এই হিংসার পৃথিবী, এই ধর্মের নামে বিভাজিত পৃথিবী, এই জটিল পৃথিবী থেকে আমাদের মানবজাতিকে উদ্ধার করে নতুন পথের দিশা দেবেন।
অঙ্কন : সুব্রত মাজী