হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
ছোটবেলায় কাগজ মুড়ে রকেট বানিয়ে খেলত বন্ধুরা। আর তা দেখে রকেটের ছবি আঁকত মহারাষ্ট্রের শহর কল্যাণের বাসিন্দা ছোট্ট সঞ্জল। সেই আঁকতে গিয়েই তাঁর মনের মধ্যে আসল রকেট তৈরির ইচ্ছা বাসা বেঁধেছিল। ছোটবেলাতেই তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছিল রকেট তৈরি। সেই ইচ্ছাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সবরকম সহায়তায় বাবা মা তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন সঞ্জল। মুম্বই ইউনিভার্সিটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হলেন। স্বপ্নপূরণের প্রথম ধাপ এগনোর পর মিশিগান টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে আমেরিকা পাড়ি দিলেন। সেটা ২০১১ সালের কথা। সঞ্জল গাভান্ডের এই বিদেশে পড়তে যাওয়া নিয়ে পাড়া পড়শিদের অনেকেই কটাক্ষ করেছিলেন। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয় নিয়ে একটা মেয়ে পড়াশোনা করে করবেটা কি? মেকানিক্যাল ব্যাপারস্যাপার তো ছেলেদের পক্ষেই করা সম্ভব বলে তাঁরা সঞ্জলের বাবা মাকে বোঝান। বাবা অশোক গাভান্ডে ছিলেন কল্যাণ মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের অফিসার আর মা সুরেখা এমটিএনএলের কর্মী। তাঁরা মেয়ের ইচ্ছাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মিশিগানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার পরে মার্কারি মেরিন নামে আমেরিকার একটি সংস্থায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কাজ করতে শুরু করেন। সেখানে তিন বছর ডিজাইন অ্যানালিসিস্ট পদে শিক্ষানবিশ হিসাবে চাকরি করেন। এরপর টয়োটা রেসিং ডেভেলপমেন্টে মেকানিক্যাল ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করতে থাকেন। তবে তাঁর লক্ষ্য ছিল রকেট তৈরির কোনও প্রকল্পে যুক্ত হওয়া। তিনি তা চেষ্টা করতে লাগলেন। বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে লাগলেন। ২০১৬ সালে কমার্শিয়াল পাইলটের লাইসেন্সও পেয়ে গেলেন। এবার নাসায় চাকরির আবেদন করলেন। নিরাশ হলেন। আমেরিকার নাগরিক না হওয়ার কারণে যোগ্যতা সত্ত্বেও তাঁর আবেদনপত্র বাতিল হল। তবে নাসা তাঁর আবেদন ফিরিয়ে দিলেও হতাশ হননি। কাজের সুযোগ পেলেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি জেফ বেজোসের সংস্থা ‘ব্লু অরিজিন’-এ। সেখানে তিনি সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারের পদে চাকরি পেলেন। এরোস্পেস রকেটের ডিজাইন করা সঞ্জলের স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নপূরণের সুযোগ মিলে গেল ব্লু অরিজিনে। তবে এখানে থেমে থাকেননি সঞ্জল। তিনি বিমানও চালিয়েছেন। সেই সূত্রে এ বছর তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় মহিলা পাইলটদের মধ্যে সেরার শিরোপা পেয়েছেন।
এদিকে ব্লু অরিজিন মহাকাশে যান পাঠানোর জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালাচ্ছিল। অবশেষে নাসার সহযোগিতায় তারা মহাকাশযান ‘নিউ শেপার্ড’ তৈরি করেছে। ওই মহাকাশযানটিকে মানুষ ছাড়াই উৎক্ষেপণ করা হয়। তাতে সফল হওয়ার পর নাসা মহাকাশযানটিকে যাত্রী নিয়ে মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার অনুমতিও দিয়েছে। সেই মহাকাশযান নিয়ে গত ২০ জুলাই মহাকাশের দোরগোড়া থেকে ঘুরে এসেছেন স্বয়ং জেফ বেজোস। সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁর ভাই মার্ক বেজোস, ১৮ বছরের ডাচ তরুণ অলিভার ডেইমেন এবং অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন মহিলা পাইলট উইলি ফাঙ্ক। প্রসঙ্গত, বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সি মহাকাশযাত্রী হিসাবে ডেইমেন এবং বয়োজ্যেষ্ঠ যাত্রী হিসাবে ফাঙ্ক মহাকাশে গিয়ে নতুন নজির গড়েছেন। ডেইমেন গত বছর স্নাতক হয়েছেন। তাঁর বাবা বেসরকারি ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্ট ফার্মের চিফ এক্সিকিউটিভ। বেজোসের মহাকাশযানে চড়ে যাওয়ার জন্য একটি আসনের নিলাম হয়েছিল গোটা বিশ্বজুড়ে। একমাস ধরে চলা এই নিলামে ১৫৯টি দেশের সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি তা জিতেছিলেন। ওই ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করেনি ব্লু অরিজিন কর্তৃপক্ষ। তবে সেই ব্যক্তি যেতে রাজি না হওয়ায় এই দৌড়ে দ্বিতীয়স্থানে থাকা ডেইমেনকেই সুযোগ দেওয়া হয়। এজন্য ডেইমেন কত ডলার দিয়েছেন তা অবশ্য ব্লু অরিজিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। তবে ডেইমেনের দাবি ২ কোটি ৮০ লক্ষ মার্কিন ডলার তাঁকে দিতে হয়েছে। তাঁর বাবা ওই অর্থ মিটিয়েছেন।
১৯৬০ সালে আমেরিকা চাঁদে মহাকাশচারী পাঠানোর জন্য বেশ কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। সেই প্রশিক্ষণ দলে ছিলেন উইলি ফাঙ্ক। তিনি প্রশিক্ষণে সেরা বলে বিবেচিত হলেও স্রেফ মহিলা হওয়ায় তাঁকে চাঁদে পাঠাতে রাজি হয়নি নাসার কর্তৃপক্ষ। তাঁকে বিমানবাহিনীর ফ্লাইট ইনস্ট্রাক্টর হিসাবে নিয়োগ করা হয়। ফাঙ্কের মনের মধ্যে মহাকাশযাত্রার সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপ রয়ে গিয়েছিল। তিনি কোনও একদিন মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তবে বয়স বেড়ে যাওয়ায় সেই আশা আর ছিল না। কিন্তু তাঁকে চমকে দেন জেফ বেজোস। তিনিই ফাঙ্ককে মহাকাশ ঘুরিয়ে আনার প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাব শুনে আপ্লুত ফাঙ্ক। ৮২ বছর বয়সেও ফিটনেস পরীক্ষায় উতরে যান। আর বাকিটা এখন ইতিহাস।
নিউ শেপার্ডকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে মহাকাশ ছুঁয়ে আনার নেপথ্যে যে একদল ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন তাঁর অন্যতম সদস্য ৩০ বছরের সঞ্জল গাভান্ডে। কীভাবে মহাকাশযানকে পৃথিবীর বাইরে থেকে ঘুরিয়ে আবার সফলভাবে অবতরণ করাতে হবে তাতে তাঁর অবদান কম নয়। গোটা ব্যাপারটিই পৃথিবী থেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে ব্লু অরিজিনের এই ইঞ্জিনিয়ারের দল।
প্রসঙ্গত, ব্লু অরিজিনের মহাকাশযান নিউ শেপার্ড রকেটটি ৬০ ফুট (১৮.৩ মিটার) লম্বা। রকেট এবং ক্যাপসুলের সমন্বয় করে এই মহাকাশযানটিকে তৈরি করা হয়েছে। কোনও পাইলট ছাড়াই রকেটটি উড়তে পারে। কয়েকটি সফটওয়্যার ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এটির উড়ান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রকেটটি প্রতি ঘণ্টায় ২২০০ মাইল (৩৫৪০ কিলোমিটার) গতিতে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিল। পাড়ি দেওয়ার আগে যাত্রীদের ২ দিন ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মাত্র ১১ মিনিটেই নিউ শেপার্ড মহাকাশের দোরগোড়া ছুঁয়ে ফিরে আসে। এই ১১ মিনিটের মধ্যে ৩ মিনিট ওজনবিহীন অবস্থায় মহাকাশযানের মধ্যে ভেসে বেড়িয়েছেন ওরা চারজন। মহাকাশযান নিউ শেপার্ডের ক্যাপসুলের পোশাকি নাম ‘ফার্স্ট স্টেপ’। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মহাকাশ ও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সংযোগস্থল কারম্যান লাইন (৬২ মাইল) ছাড়িয়ে ৬৬.৫ মাইল উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল ফার্স্ট স্টেপ। এই সময় পিংপং বল নিয়ে ছুড়ে দিয়েছেন, ডিগবাজি খেয়েছেন আর ক্যান্ডি ছড়িয়ে দিয়ে ভাসমান অবস্থায় সেগুলো ধরার চেষ্টা করেছেন জেফ আর তাঁর ভাই মার্ক। আপ্লুত জেফ বলেছেন, এক মুহূর্তে যেন ছোটবেলার দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিলাম। এটা অভূতপূর্ব। মহাকাশযাত্রীদের মধ্যে প্রবীণতমা ৮২ বছরের ফ্রাঙ্ক জানলা দিয়ে দুচোখ ভরে পৃথিবীর বৃত্তাকার অংশটিকে দেখেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেছেন আমি অভিভূত, আনন্দিত। কয়েকদশক ধরে তিনি এটা দেখতে চেয়েছিলেন। ডাচ ছাত্র ডেইমেনের মতে, ওই সময়টুকু অবিশ্বাস্য লাগছিল।
বেজোসরা মহাকাশ ঘুরে আসার সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী মহাকাশযাত্রা নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে নানা জল্পনা। সেই জল্পনাকে আরও উস্কে দিয়েছেন ব্লু অরিজিনের এই মহাকাশ অভিযানের দায়িত্বে থাকা প্রাক্তন নভোশ্চর জেফ অ্যাসবি। তিনি ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন, এ বছরেই আরও দু’বার নিউ শেপার্ড মহাকাশে পাড়ি দেবে। প্রথম উড়ানে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়া হবে। আর দ্বিতীয়টিতে যাত্রী নিয়ে যাওয়া হবে। তাই দ্বিতীয় অভিযানে কারা মহাকাশযানে সওয়ার হবেন তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। মহাকাশযানের একটি টিকিটের দাম ১০ কোটি মার্কিন ডলার করা হবে বলে ইতিমধ্যেই ব্লু অরিজিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে তাতে টিকিটের চাহিদা একটুও কমেনি। বরং উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে আর এক সংস্থা ভার্জিন গ্যালাকটিকও মহাকাশযাত্রার জন্য প্রতি আসনের দাম করেছে ২৫ কোটি ডলার। বেজোসের আগেই মহাকাশে ঘুরে এসেছেন ভার্জিন গ্যালাকটিকের কর্ণধার রিচার্ড ব্র্যানসন। তবে ব্র্যানসনের চেয়ে মহাকাশের আরও বেশি উচ্চতায় গিয়ে তাঁকে টেক্কা দিয়েছেন বেজোস। একজন তরুণ ছাত্রকে নিয়ে গিয়ে মহাকাশ পর্যটনের প্রদীপ কার্যত জ্বালিয়ে দিয়েছেন তিনি। অপরদিকে শুধু মহাকাশের দোরগোড়া নয়, একেবারে চাঁদে সাধারণ যাত্রীদের ঘুরিয়ে আনতে চাইছেন আর এক ধনকুবের ব্যবসায়ী ইলন মাস্ক। তিনি কম খরচে চাঁদে সাধারণ মানুষকে ঘুরিয়ে আনতে চাইছেন। তাই স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস কর্পোরেশন বা স্পেস এক্স নামে একটি সংস্থা তৈরি করেছেন। ২০২৩ সালে তিনি যাত্রীদের মহাকাশযানে করে চাঁদে ঘুরিয়ে আনবেন বলে ঘোষণা করেছেন। এ নিয়ে গোটা বিশ্বেই আগ্রহ দেখা দিয়েছে। বহু মানুষ সেই অভিযানে প্রথম যাত্রী হতে স্পেস এক্স সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এবার মহাকাশ পর্যটনের এই নতুন দৌড়ে কে এগিয়ে যায় সেদিকেই তাকিয়ে গোটা দুনিয়া।
তথ্য ও ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে