উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
টিভিতে খবর শুনতে শুনতে মনটা থেমে গেল একটা নাম শুনে— ‘বিল্লু নামের এক কিশোর...’ আর অমনি যেন স্মৃতি সমুদ্রের ঢেউ ধেয়ে এল একের পর এক।
জানি না, আমাদের বালক কালের সঙ্গীটি আজ কোথায়, কেমন আছে। তার নামও ছিল বিল্লু, তবে নামটা বিচ্চু হলেই বোধ হয় সবচেয়ে মানাত। অবশ্য গুণ, দোষ যা-ই বলি না কেন, বিল্লুর স্বভাবে এমন অজস্র উপাদান ছিল, সচরাচর যা কোনও একজনের মধ্যে মেলা ভার। মাঝে মাঝেই বজ্জাতি, বেপরোয়া আর ঠোঁটকাটা স্বভাবের সঙ্গে রসবোধটাও ছিল তার মজ্জাগত। তবে মাস্টারমশাইদের কাছে কেন যেন একটু প্রশ্রয়ই পেয়ে যেত বিল্লু।
ছোটবেলায় আমাদের গাঁয়ের রাজবল্লভী চতুষ্পাঠীতে বছর দুয়েক সংস্কৃত শিক্ষার সুযোগ হয়েছিল। টোলের পণ্ডিতমশাই ছিলেন কানাইকৃষ্ণ কাব্যব্যাকরণতীর্থ স্মৃতি বিশারদ। টোলে ধাতুরূপ, শব্দরূপ মুখস্থ করতে করতে একটু দূরেই দেখতে পেতুম নগেন কলুর ঘানি চলছে। চোখে ঠুলি আর গলায় ঘণ্টি বাঁধা একটি বলদের কাঁধে কাঠের ভারী একটি দণ্ড চাপানো। আর সে ঘুরে চলেছে বৃত্তাকারে। বৃত্তের মাঝখানে পেষাইকলে সর্ষে পিষে তেল বের করা হচ্ছে। কলের চোঙায় মাঝে মাঝে সর্ষে ভরে দেয় নগা’র ছেলে, আর বলদটা থামতে চাইলেই খেজুর ছড়ি দিয়ে তার পিছনে ছপ্টি মেরে আবার তাকে চালিয়ে দেয়। সর্ষে মাড়াই হয়ে তেল বেরিয়ে জমা হয় বড় একটি টিনের পাতে।
সেদিনও দুলে দুলে আমরা নরঃ, নরৌ, নরাঃ পড়ে পড়ে মুখস্থ করে চলেছি। বিল্লু হঠাৎ পণ্ডিতমশাইকে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘পণ্ডিতমশাই, ওই বলদটার চোখে ঠুলি বাঁধা কেন?’ পণ্ডিতমশাই বোঝালেন, একটানা গোলাকার পথে ঘুরতে ঘুরতে ওটার মাথা ঘুরে যেতে পারে। চোখে ঠুলি বাঁধা থাকলে আলোও পড়ে না, তাই মাথাও ঘোরে না। ‘তা ওদিকে না তাকিয়ে বইয়ের পাতায় একটু চোখ রাখ না বাবা!’
পণ্ডিতমশাই থামতেই আবার শুরু হয়ে গেল আমাদের শব্দরূপ মুখস্থ করা। কিন্তু সে আর কতক্ষণ? আবারও প্রশ্ন বিল্লুর,—‘বলদটার গলায় ঘণ্টি বাঁধা কেন পণ্ডিতমশাই?’ এবার বেশ বিরক্ত হয়েই পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘মুখ্যু এটাও বোঝো না, ঘণ্টিটা থামলেই তো বুঝতে হবে বলদটা থেমেছে, আর ঘানিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তখন আবার সেটা চালু করতে হবে। পড়ায় মন দিতে না পারলে যাও, বাড়ি চলে যাও। তারপর তোমার বাবাকে যা বলার বলব।’
কিন্তু বিল্লু কি আর ভয় করে কাউকে? তার কৌতূহল না মেটা পর্যন্ত তাকে থামায় কার সাধ্যি। পণ্ডিতমশায়ের শাসানিতে হতোদ্যম না হয়ে সে এবার যেন একটু বিনয়ের সঙ্গেই বললে, ‘শুধু এইটা বলে দিন, আর কিছু জিজ্ঞেস করব না পণ্ডিতমশাই,—বলদটা যদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ে?’
এবার হেসে ফেললেন পণ্ডিতমশাই। বললেন, ‘হ্যাঁ বাবা, তেমন বলদ আমার টোলেই এসে জোটে, নগা কলুর ঘানি টানে না।’
ইংরেজিতে একটু দুর্বল বলে বিল্লুর বাবা হীরু স্যারের কাছে তার টিউশনির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আমাদের ইংরেজি পড়াতেন হীরালালবাবু। দেশভাগের সময় এপারে চলে এসেছিলেন ভিটে-মাটি সবকিছু ছেড়ে।
তবে ছাড়তে পারেননি বাঙাল ভাষাটি। চমৎকার পড়াতেন।
সেই হীরু স্যারের কাছে পড়েও সেবারে ইংরেজিতে কম্পার্টমেন্টাল পেল বিল্লু। রাস্তায় মুখোমুখি হতেই স্যারের প্রশ্ন— ‘কী বিল্লু, পাশ করশস্?’ বিল্লুর নির্লজ্জ জবাব, ‘না স্যার, হই নাই, টিউশনির পয়সা ফেরত দ্যান।’
বিল্লুকে নিয়ে গপ্পর যেন শেষ নেই। পাটিগণিতে নল দিয়ে চৌবাচ্চার জল ভরা ও বের হওয়া আর তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বাঁদরের ওঠানামার যে দুটি অঙ্ক কয়েক প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীকে নাজেহাল করেছে, আমরাও সেই দুর্ভোগের শরিক। সেদিন আমরা পড়েছি দ্বিতীয়টি নিয়েই। অঙ্কটি ছিল, কয়েকফুট লম্বা তৈলাক্ত একটি বাঁশ বেয়ে একটি বাঁদর মিনিটে এত ফুট ওঠে, তারপর এত ফুট নামে। ক’মিনিটে সে বাঁশটির ডগা’য় পৌঁছতে পারবে। বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে আমরা যখন গলদঘর্ম, তখন বিল্লুর হয়তো মনে হয়েছিল, ধুর ধুর, একটা অঙ্ক নিয়ে কতক্ষণ আর মাথা ঘামানো যায়। তারচেয়ে বরং একটু ঘেঁটে দেখা যাক। সে বললে, ‘স্যার, অঙ্কটায় একটু গোলমাল আছে।’ অঙ্কের মাস্টারমশাই বিষ্টুবাবু জানতে চাইলেন, ‘কোনখানে মনে হচ্ছে গোলমালটা?’
বিল্লুর এবার একটা নয়, পরপর তিনটে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাতে চাইল বিষ্টুবাবুকে। তার প্রশ্নমালাটি হল কাদের ঝাড়ে অত লম্বা বাঁশ পাওয়া যাবে? বাঁশটায় তেল মাখাতে কে অমন বাজে খরচ করবে? আর বাঁদরটাই বা খামোকা কেন বাঁশ বেয়ে একবার উঠবে আর একবার নামবে?
বিল্লুর ফিচলেমি করার সাহস দেখে আমরা তো হতভম্ব। ওদিকে বেদম হাসি চেপে ধরে আছি কোনওরকমে আর সেইসঙ্গে ভাবছি, তার শাস্তির বহরটা কেমন হয়! কিন্তু বিষ্টুস্যারের ক্ষমার ভঙ্গিটি অনুপম। সব শুনে একটু মৃদু হেসে তিনি বললেন, ‘তুমি তো দেখছি ক্ষণজন্মা প্রতিভা হে। বুঝেছি। যাও, আজ আর অঙ্ক করতে হবে না। আজ ছুটি।’
কলকাতায় এসে একই কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। বিল্লুই একদিন প্ল্যান করছে, বড়দিনের ছুটিতে ক’জন বন্ধু মিলে বাটানগরে গিয়ে গঙ্গার ধারে চড়ুইভাতি করা হবে। ভোরের বাস ধরেছি। প্রথম বাসটাই। বাসে ওঠার আগেই ফরমান জারি করে দিয়েছে বিল্লু, যে যার নিজের টিকিট কাটবে। ভালো কথা।
বাস চলছে, কন্ডাকটর একে একে সব যাত্রীর কাছে গিয়ে পয়সা নিয়ে টিকিট দিচ্ছে। বিল্লুর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই, সে মুখ কাঁচুমাচু করে একেবারে দুঃখী মানুষের স্বরে কন্ডাকটরকে বললে, ‘পয়সা নেই।’
—মানে? বাসে উঠেছেন, পয়সা নিয়ে ওঠেননি?
—বলছি তো পয়সা নেই, বিল্লুর কণ্ঠে এবারও করুণ সুর ধ্বনিত হল। কন্ডাকটর এবার ভ্রু কুঁচকে বিল্লুর আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে নিল। ব্লু জিনসের সঙ্গে ম্যাচিং ব্লু সোয়েটার পরেছে সে আজ। পায়ে নামী কোম্পানির স্নিকার্স। তার বেশবাস দেখার পর কন্ডাকটর এবার রেগেমেগে একটু চড়া গলাতেই তাকে বললে, ‘ধোপদুরস্ত জামাপ্যান্ট তো পরেছেন দেখছি, টিকিট কেনার পয়সাটা নিয়ে উঠতে পারেননি? নেমে হেঁটে হেঁটে যান।’
অমনি নিমেষে বদলে গেল বিল্লুর কণ্ঠস্বর। কন্ডাকটরের উদ্দেশে এবার তার বিদ্যুৎবাণ বর্ষিত হল দ্বিগুণ জোরে—‘দেখুন, মুখ সামলে কথা বলবেন কিন্তু। বাপ-মা তুলে কথা বললেও সহ্য করব, প্যান্ট জামা তুলে কথা বলবেন না।’
আজও কি তেমনই থেকে গিয়েছে আমাদের সেই বিল্লু? খুব জানতে ইচ্ছে করে!
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল