উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
চারপাশে হু-হু হাওয়া। আক্ষরিক অর্থেই বসন্তের মাতাল সমীরণ। কতদিন পরে ছাদে উঠলাম। এই জায়গাটা আসলে আমার মামারবাড়ি। বর্ধমান শহর থেকে অল্প বেরিয়ে। বাপেরবাড়ি হিসেবে যা ছিল তা দমদমের একটা ফ্ল্যাট। আমরা দুই বোন ওখানেই বড় হয়েছি। বাবা মারা গেলেন প্রায় দশ বছর হল। দিদি বিয়ে করল না। একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছিল এতদিন। এখন মাকে নিয়ে এখানে এসে থাকছে। দু’জনেরই খেয়াল। প্রিয়ব্রতর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হল আমার তাও বছর পাঁচ হল। পায়েল তখন মাধ্যমিক দেবে। প্রিয় ওর অফিস কলিগের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল বলে অশান্তি শুরু হল। এখন অবশ্য একাই থাকে। বিয়ে করেনি কাউকেই। মেয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। এই বর্ধমানে আমার মামারবাড়িতে আসার কথা শুনে মেয়েকে বলেছে—বিয়ের পর এখানে এসে দু’রাত ছিল। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে। সেইসব দিন, নতুন বিয়ে, এরকম বিরাট বাগানওলা আমার মামারবাড়ি, ছাদে উঠে ভাইবোনদের সঙ্গে গান, আড্ডা, দিদিমার রুপোর থালা করে আমাদের খেতে দেওয়া— সেসব গতজন্মের স্মৃতির মতো করে আমার মনে পড়ে। আমি মনে করতেও চাই না।
সন্ধে নেমে আসছে। এখন সময়টা গোধূলি। মৃদু আলোয় ভরা এতটা আকাশ কলকাতায় বসে কতদিন যে দেখিনি! ঠিক দু’দিন পরে দোল পূর্ণিমা। রাতের আকাশে পূর্ণিমা থাকে যেমন দিনের আকাশেও কি থাকে না? আমি তো দেখি পূর্ণিমার আশপাশের সময়ের রোদের রং সবচেয়ে সোনালি, কাঁচা থেকে সদ্য পাকা হওয়া ধানের মতো ঝকঝকে সুন্দর। এখন সেই সোনালি রং ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। জাগ্রত হচ্ছে রুপোলি রং-এর জ্যোৎস্না। আমি ছাদে চটি খুলে হাঁটছি। ছাদের হাল্কা রোদেলা স্পর্শ পেয়ে নিজের কিশোরীবেলা ফিরে পাচ্ছি যেন। এই ছাদে মামাতো দাদা-দিদি-বোনেদের সঙ্গে কম আড্ডা তো দিইনি। এখন সবাই বাইরে। বাড়ির অন্য দিকে ছোড়দাদু, মানে মায়ের ছোটকাকু থাকেন। সঙ্গে আছে সারাদিনের কাজের লোক, সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসা বলরাম কাকু। আর এদিকে মা আর দিদি। ব্যস। এত বড় বাড়িটা খাঁ খাঁ। বিশাল বাগান, খিড়কির পুকুর সব একা হয়ে পড়ে আছে যেন।
পায়েলকে দেখতে পাচ্ছি না। মনে হয় আমবাগানের ভেতর আছে। আমি জানি ওর কেন মন খারাপ। এখানে মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক ভালো পাচ্ছে না, তাই হয়তো সৌম্যর সঙ্গে ওর কথা হচ্ছে না। অথচ এসেছি সবে আজ সকালে। আজকালকার কাপলদের এই প্রতিমুহূর্তে যোগাযোগের ব্যাপারটা আমি ভালো বুঝতে পারি না। আমরা যারা মোবাইল যুগের আগে প্রেম করেছি, বিয়ে করেছি তাদের এ ব্যাপারটা বাড়াবাড়িই লাগে। সারাদিন কথা বলার থাকেটাই বা কী? মেয়েকে এই নিয়ে দু-একবার মজা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু ও চটে গিয়েছিল। তাই এখন আর মুখে কিছু বলি না। কিন্তু ওদের দেখে হাসিও পায়। চিন্তাও হয়।
আর একটু সন্ধে নামতে নীচে নেমে আসি। ছোড়দাদু আমরা এসেছি বলে বলরাম কাকুকে দিয়ে আলুর চপ পাঠিয়েছে। দিদি মুড়ি মাখছে বড় ধামায়। বিকেলের জলখাবারে এরকম সবাই মিলে বসে মুড়ি-চপ কতদিন যে খাইনি! পায়েলও এসেছে গুটিগুটি। আমার মা আজকাল শুয়েই থাকে বেশিক্ষণ। কানে কম শোনে। তবে ভগবানের আশীর্বাদে রোগহীন। এই আলো হাওয়া যুক্ত, মায়েরও ছোটবেলার স্মৃতিজড়িত বাড়িতে এসে বেশ খুশি খুশি থাকে। অন্তত দিদির তাই মনে হচ্ছে। আমাদের উঠোনের গায়ে লাগানো আর একটা ঢাকা বারান্দা আছে। একটু উঁচুতে। আগে এখানে একবার আমরা হ্যাজাক জ্বালিয়ে ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্য করেছিলাম। মামাতো দিদির বন্ধু অনুরূপাদি নীল শাড়ি পরে শেষ দৃশ্যে নেচেছিল—‘আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী। নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী...।’ কে গান গেয়েছিল বল তো দিদি?
—রমাদি। ওদেরই বন্ধু। আমি সেজেছিলাম কোটাল। বলে দিদি হেসে গড়িয়ে পড়ল সেই কিশোরীবেলার মতো।
পায়েল মোবাইল নিয়ে খুটখুট করতে করতে উদাস হয়ে মুড়ি খাচ্ছিল। দিদির হাসিতে চকিত হয়ে বলল—মাসিমণি, তুমি ছেলে সেজেছিলে? কোটাল মানে তো ছেলে?
—এ আবার কী? তুই প্রশ্ন করছিস কোটাল ছেলে কি না? চিত্রাঙ্গদা দেখিসনি?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। ইউটিউবে দেখেছিলাম একবার।
—ইস, কী অভাগা রে তোরা। এসব তোদের ইউটিউবে দেখতে হয়। ভাগ্যিস আমাদের সময়ে মোবাইল ছিল না।
—তোমরা বন্ধু, মানে দূরের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে কী করে? তোমাদের প্রেম টিকত কীভাবে?
—হ্যাঁ। টিকত না হয়তো। সে সব তো ঘটেছেই।
—তোমার জীবনে এরকম কিছু হয়েছে না? বল না মাসিমণি।
দিদি মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর মতোই মেশে। ওরা কথা বলছে দেখে আমি বাইরে উঠোনে এসে বসি। আড়চোখে দেখি মা ঘরে গিয়ে টিভি চালিয়ে সিরিয়াল দেখছে। কানে শোনে না, তবু দেখে। গল্প সব বোঝেও কিন্তু।
দিদির গল্পটা আমিও জানি। তবে কোনও দিন এভাবে ভাবিনি অবশ্য, আজ মনে হচ্ছে মোবাইল থাকলে ওদের সম্পর্কটা হয়তো বেঁচে যেত।
দুই
ছেলেটির নাম ছিল নিশীথ। লম্বা চওড়া চেহারা, দেখতে বেশ ভালো। কিন্তু যেটা ভালো ছিল তা হল ছেলেটার মধ্যে এক ধরনের ভালো মানুষি। এই বাড়িতেই আলাপ হয়েছিল। সম্পর্কে খুড়তুতো এক মামার বন্ধু। সেই মামার বিয়েতে আলাপ। দিদি চিরকাল খুব দুষ্টু, উজ্জ্বল ছিল। রূপের বিচার ওকে দেখে কেউ করতই না, এমনিই পছন্দ করে ফেলত। তবে দিদিকে দেখতে খুব মিষ্টিই ছিল। তখন যেরকম মেয়েদের সুন্দর বলত হয়তো ঠিক সেরকম না, দিদি এখনকার বিচারে অনেক বেশি সুন্দরী আখ্যা পেত। বেশ লম্বা, গায়ের রং চাপা, টিকালো নাক, আর অসম্ভব স্মার্টনেস। নিশীথদা দিদিকে দেখে প্রেমে পড়ে গেল। নিজে শান্ত ভালো মানুষ বলেই হয়তো। বিয়ে বাড়ি মিটে গেলে ফিরে যাওয়ার আগে দিদিকে একা ডেকে কথাও বলে নিল। সে সব তখনকার দিনে বেশ চাপের ছিল। পায়েলদের এই সারাক্ষণ যোগাযোগের সম্পর্ক ভালো কি খারাপ যেমন জানি না, তেমন প্রায় যোগাযোগহীনতায় একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠার বাস্তবতাও জানি না। দুটোই চরম। দিদিকে বলে গিয়েছিল নিশীথদা, জার্মানিতে চাকরি পেয়েছে, চলে যাবে। কিন্তু দিদির সঙ্গে কথা বলার জন্য পরের শনিবার বর্ধমান স্টেশনে আসবে। দুপুর দুটোয়। দিদি ওই পর্যন্ত শুনে বলেছিল—ও বাবা, বর্ধমানে স্টেশনে বসে আমি কথা বলতে পারব না। দাদারা-মামারা সারাদিন যাতায়াত করে। তাতে নিশীথদা বলেছিল দুটো কুড়িতে একটা ট্রেন আছে। তার লাস্ট কামরায় উঠতে। ট্রেনটা যাবে রামপুরহাট পর্যন্ত। দিদি ক’টা স্টেশন কথা বলে পিচকুড়ির ঢাল-এ নেমে যাবে। ফিরতি ট্রেন সঙ্গে সঙ্গেই পাবে। বিকেলের মধ্যে বাড়ি ফিরে যাবে। ততদিনে নিশীথদা জার্মানির ঠিকানাটা পেয়ে যাবে। দিদিকে দিয়ে দেবে। সেদিন মানে সেই শনিবার আমরা কিন্তু গিয়েছিলাম। আমি আর দিদি। আমাকে না নিয়ে গেলে ও বেরতেই পারত না। তারপরের দিন আমাদের কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কথা। মা তাইই হয়তো ছেড়েছিল আমাদের, কিছুটা ঘুরে আসার জন্য।
দিদি বাড়ির ভয়ে বেশি সাজতেও পারেনি। তবু একটা লাল কটকির শাড়ি পরেছিল। প্রথমবার দিদিকে আনস্মার্ট, বোকা বোকা অথচ চরম সুন্দর লাগছিল। তখনও কি বসন্তকাল ছিল? মনে নেই। আমি কী পরেছিলাম, কী সেজেছিলাম সেসবও মনে নেই। চকিতে মনে পড়ল দিদি তখন ঠিক পায়েলের বয়সি। কুড়ি। আর আমি ষোলো।
আমরা হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে দেখলাম ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে লাস্ট কামরায়। তারপর দু’জনে খুঁজছি নিশীথদাকে। পাইনি। ট্রেনটা ছাড়তে বুঝেছিলাম ওটা ফার্স্ট কামরা। সেদিন দিদির চোখে জল এসে গিয়েছিল। আমরা কথামতো পিচকুড়ির ঢাল স্টেশনে নামলাম। ট্রেন চলে গেল। ফিরতি ট্রেনে বর্ধমান ফিরলাম। পরের দিন দমদম ফিরে আসতে হল। অনেক অনেক পরে শুনেছিলাম জার্মানি থেকে নিশীথদা মামারবাড়িতে এসেছে, সঙ্গে জার্মান বউ। আজও বোধহয় জানে না, দিদি সেদিন উপেক্ষা করেনি। গিয়েছিল। দিদি কিন্তু আর বিয়ে করল না। একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানো শুরু করল।
তিন
দিদির গল্প বলা হয়ে গেলে ভেতরে ঢুকি। পায়েল উদাস হয়ে বসে আছে। দিদিও। আমিই হাল্কা চালে বলি— তখন মোবাইল থাকলে তোর সম্পর্কটা আজ ঘটে যেত। বল?
—শুধু মোবাইল থাকলেই কি হয়? তুমি আর বাবা যখন প্রেম করতে তখন তো তোমাদের হাতে মোবাইল ছিল না। যখন ব্রেকআপ হল, তখন দু’জনের হাতেই দামি মুঠোফোন।
পায়েলের কথাটা ভাবায়। চুপ করে থাকি। কথা ঘোরানোর জন্য বলি— ছাড়, ওসব পুরনো দিনের কথা। তুই সৌম্যকে পেলি?
—ওকে তো পেয়েই আছি। কিন্তু...
—নেটওয়ার্ক থাকছে তবে? আমি ভাবছি নেই বুঝি। তাও ওরকম শুকনো মুখ করে আছিস কেন?
—জানি না মা, আমি যখনই দূরে কোথাও যাই ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। আমি মেসেজ করছি, সিন হচ্ছে ও অনলাইন। অল্প উত্তর দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে।
—ও হয়তো রাগ করে করছে।
—না মা রাগ নয়। ও স্পেস দিতে পারে না। আমি কি এক-আধদিনের জন্যও নিজের মতো থাকতে পারব না? এক-আধ দিন দূরে থাকলে কি ব্রেকআপ হয়ে যাবে তবে? এত টেনশন আমি নিতে পারছি না।
ঝট করে কেঁদে ফেলে পায়েল। দিদি এসে ওর মাথায় হাত দেয়। আমি ভেতর থেকে বাইরে আকাশ দেখি। পৃথিবীর মাতৃদুগ্ধে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। এখানে আমরা নগণ্য মানুষ কে কাকে ছোঁব? কী পথে? কেউ জানি না।
আমি ফিসফিস করে বলি— দিদি, তুই তো এখন ফেসবুকে আছিস, নিশীথদাকে খুঁজিসনি?
—হ্যাঁ। পেয়েওছি। কিন্তু দু’জনেই কথা বলি না। আমার মনে হয়, ও জানে আমরা সেদিন গিয়েছিলাম। পিচকুড়ির ঢাল স্টেশনে ও ট্রেন থেকে আমাদের দেখেছিল। ওই-ই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে খুঁজে। কিন্তু একদিনও কথা হয়নি, আমি আর কথা বলতে চাই না। যেরকম যা চলছে চলুক।
চার
পায়েল চোখ মুছে বলে— মা, দিম্মার কাণ্ড দেখো। আমরা তিনজনেই চোখ মুছে বারান্দায় অল্প আলো থেকে মায়ের ঘরের আলোয় চোখ রাখি। মায়ের বালিশের তলায় সবসময় রাখা থাকে বাবার একটা ছবি। বাবার সেই ছবিটা বের করে কোলের ওপর রেখে বিড়বিড় করে কীসব বলছে মা। এটা নতুন নয়। মাঝে মাঝেই এরকম করে। দিনে তিনবার। পায়েলের ফোন করার মতো। এই ছবি নিয়ে পায়েল কম ক্ষ্যাপায় না দিদিমাকে। আজ চুপ করে দেখছে। পার্থিব আর অপার্থিব সংলাপ। মহাজাগতিক নেটওয়ার্ক কখনও বিচ্ছিন্ন হয় না বুঝি!