উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
এক বন্ধুর কাছ থেকে নাম শুনেছিলাম জায়গাটার। মহারাজপুর। রাজমহলের কাছাকাছি। আদিবাসী এলাকা। একদিকে বিরাট চওড়া গঙ্গা। অন্যদিকে পাহাড়। সেই পাহাড়ে জঙ্গলের মধ্যে আছে মোতি ঝর্ণা। ভাগলপুর লাইনে সাহেবগঞ্জ স্টেশনে নেমে আবার লোকাল ট্রেন ধরে যেতে হবে। ট্যুরিস্টরা খোঁজ রাখে না।
শুনে আহ্লাদ হয়েছিল। থাকব কোথায়, খাব কী, জানি না। তাতে আরও আনন্দ। বেশ একটা ভবঘুরে ভাব। অ্যামেচার ভবঘুরে যদিও। হাতব্যাগে জামাকাপড় ভরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সঙ্গে ছিল আমার চেয়ে বছর দশেকের ছোট এক বন্ধু, মিন্টু। আমরা তখন ব্যাচেলর। তখনও গুগল ম্যাপ সব বেপর্দা করে দেয়নি। রাত সাড়ে দশটায় জামালপুর এক্সপ্রেসে রওনা দেব। অফিস থেকে বকেয়া বেতন নিতে গিয়ে দেরি হয়ে যাওয়াতে পড়িমড়ি করে হাওড়া পৌঁছলাম।
পুজোর মুখে মুখে বলে স্টেশনে দমচাপা ভিড়। এস-সিক্স কামরায় আমার ছিল লোয়ার বার্থ। আপার বার্থ যার সেই মাঝবয়সি মহিলা হিন্দিতে বললেন তার নাকি ওপরে ভয় করে। আমি যদি বদলাবদলি করে নিই। রাজি হয়ে গেলাম। ভাগ্যিস হয়েছিলাম। আমার ঠিক নীচেই মিডল বার্থে শোবে মিন্টু। আমার আপার বার্থের উল্টো দিকে সেই মহিলার কিশোরী মেয়ে। মিডল বার্থে আর একজন মহিলা। লোয়ার বার্থে যে মহিলা বছর সাতেকের ছেলেকে নিয়ে রয়েছেন তিনি তারই সঙ্গী। তিন মহিলার স্বামীদের এখানে জায়গা হয়নি।
বোলপুর স্টেশনে রাত সাড়ে বারোটায় যখন ট্রেন দাঁড়াল তখনও আমি জানলার ধারের সিটে বসে। শান্তিনিকেতন এলেই মনটা উদাস উদাস লাগে। একটা টি স্টল আর উঁচু পাঁচিল ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তবুও। বাঙালির দোষ। ট্রেন ছাড়ার পর নীচের দুই মহিলার অনুরোধে জানলার লোহার শাটার ও কাচের পাল্লা নামিয়ে দিয়ে বার্থে উঠে গেলাম। কাল সকাল ছ’টায় সাহেবগঞ্জ।
ট্রেনের দুলুনিতে অনেকে দিব্যি ঘুমোয়। আমি ঝিমুনিতে থাকি। তেমনই ছিলাম। হঠাৎ ঝগড়ার আওয়াজে সেটুকুও ভেঙে গেল। কামরার কোথাও আলো জ্বলছে, কোথাও নেভানো। রাতের ট্রেন এ সময় বেশ রহস্যময়। কিন্তু ঝগড়াটা হচ্ছে কোথায়?
বার্থের তারজালির ফাঁক দিয়ে বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি, টয়লেটের কাছাকাছি যে সাইড আপার বার্থ সেখানে এক মহিলা বসে রয়েছেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা লোক বলছে— ‘নিকাল, নিকাল।’ ভাবলাম স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হচ্ছে। কিন্তু ট্রেন থেকে বউকে নামিয়ে দিতে চাইছে না কি লোকটা! তার পরেই দেখলাম মহিলা কাঁপা কাঁপা হাতে গলার হারটা খুলে সামনে বাড়িয়ে ধরলেন। ঝিমুনিটা একদম চলে গেল। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম— লোকটার মুখে-মাথায় গামছা প্যাঁচানো, হাতে উঁচিয়ে রাখা দেশি পিস্তল। মানে ট্রেনে ডাকাতি হচ্ছে।
এরমধ্যেই ওইরকম গামছা জড়ানো দু’জন ক্ষিপ্র পায়ে আমাদের জায়গাটার সামনে দিয়ে কামরার অন্যদিকে চলে গেল। বোঝা গেল, ওরা ছড়িয়ে পড়ছে। মাথাটা আরও পরিষ্কার হয়ে আসছিল। নিয়মিত মাইনের চেয়ে বকেয়া মাইনে অর্থমূল্যে নিশ্চয়ই কিছুটা বেশি। তার ওপর আরও কিছু টাকা। হাতছাড়া হয়ে গেলে সত্যিকারের ভবঘুরে হয়ে যেতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে পড়ে মিন্টুকে ঠেলা দিয়ে জাগালাম। সে ঘুম থেকে উঠে হকচকিয়ে গেছে। ফিসফিস করে বললাম, ‘চেঁচাস না। ট্রেনে ডাকাতি হচ্ছে। তোর ঘড়িটা আর টাকাপয়সা যা আছে আমায় দিয়ে দে।’
এভাবে বলায় আমাকেই ডাকাত ভেবে কি না কে জানে, মিন্টু আরও ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে ফিসফিস করেই বলল, ‘তোমায়?’
‘হ্যাঁ। তুই অন্য বার্থের বাকিদের আস্তে করে ডাক। গয়না-টয়না যা আছে, কোথাও লুকিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকতে বল।’
আমার দুটো মোজারই ইলাস্টিক ঢিলে হয়ে গেছে বলে রাবার ব্যান্ড বেঁধে রাখতে হয়। একটা খুলে ছিঁড়ে ফেললাম। আমাদের দু’জনের ঘড়ি আর সব টাকা গোল করে পাকিয়ে তার একদিকে গিঁট দিয়ে বাঁধলাম। চেন টানার জায়গাটায়, যেখানে ট্রেনের ছাদ বেঁকে নেমে এসেছে, সেখানকার প্লাইবোর্ডটা ধরে একটু টানাটানি করতেই স্ক্রু আলগা হয়ে খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল। স্ক্রুয়ের পিছনে রাবার ব্যান্ড বেঁধে ঝুলিয়ে দিলাম ওপাশে।
ট্রেন চলছিল। এই পুরো সময়টাতেই শুনতে পাচ্ছিলাম চাপা গলার হুমকি, কান্নার আওয়াজ, চড়চাপড়ও পড়ছে। যেখান থেকে যা পারছে কেড়ে নিচ্ছিল ওরা। বুঝতে পেরে গিয়েছি, ডাকাতরা এলোমেলো ঘুরছে। আমাদের যেমন ভয় করছে, ওদেরও করছে নিশ্চয়ই। এখনও আমাদের দিকে কেউ আসেনি। সামনে দিয়ে এপাশ ওপাশ করছে শুধু। আমি গোনার চেষ্টা করলাম। ন’জন। কমবেশি হতে পারে। হয়তো একজনকে দু’বার গুনেছি। একজন হাতে পিস্তল ঝুলিয়ে গামছায় বাঁধা মুখ নামিয়ে চলে যাচ্ছিল। দেখি তার কাঁধ থেকে সাদা রঙের ময়লা একটা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে। তাতে নীল সুতোর কাজ করে লেখা— শান্তিনিকেতন। ডাকাতের কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ! এমনটি তো আর জীবনে দেখতে পাব না। আমি যাকে বলে একেবারে বিমোহিত হয়ে গেলাম।
আমাদের জায়গাটায় বাকি সবাই গুটিসুটি মেরে শুয়ে। আমি একাই বসে। ভাবছিলাম এখানে কেউ এলে আগে আমার কাছেই আসার কথা। এলে কী বলব ভেবে নিয়েছি। হলও তাই। সাঁ করে একজন এসে দুটো লোয়ার বার্থে ভর দিয়ে পা ফাঁক করে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। আমার কপালের ডানদিকে পিস্তলটা ঠেকিয়ে বলল, ‘ব্যাগ খোল, যো হ্যায় সব নিকাল।’
আমার মাথা এতক্ষণে একদম পরিষ্কার। বললাম, ‘কেয়া নিকালুঁ? আভি আভি তো সব লে গয়ে।’
‘লে গয়ে? কৌন?’
‘তুমহারা হি আদমি। এক কো কিতনে বার লুটোগে ভাই?’
‘ওঃ, তব ঠিক হ্যায়। চল, শো যা।’
পিস্তল নেমে গেল। পরম নিশ্চিন্ত হল ডাকাতটিও। আমিও ঝুপ করে শুয়ে পড়লাম।
এরপর আরও অনেক কিছু ঘটেছিল। আমাদের দিকের বার্থের বাকিরা আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে ছিল, ডাকাতদের সঙ্গে সাঁট আছে ভেবে টিকিট চেকারকে ধোলাই দিল পাবলিক, আরপিএফকে গালাগাল করল, বিনা রিজার্ভেশনে উঠে পড়া বিহারী শ্রমিকরা গেঁজ থেকে লুট হয়ে যাওয়া টাকার জন্য হাউহাউ করে কাঁদল, কোনও একটা স্টেশনে ভাঙচুর হল, আমি রাবার ব্যান্ড খুলে টাকা ফের ব্যাগে ভরে নিলাম, এক ঘণ্টা দেরিতে ট্রেন সাহেবগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছল।
ওভারব্রিজ পেরিয়ে যখন অন্য প্ল্যাটফর্মে গেলাম তখনও ট্রেনটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিন্টু বলল, ‘ভাবতেই পারছি না। ট্রেনে ডাকাতি হয়েছে অথচ আমাদের কিছু নিতে পারেনি।’
ঠিকই। তবে মনে হল, আমি মাত্র একজন ডাকাতকেই বলতে পেরেছি— এক কো কিতনে বার লুটোগে? কতজন এমন বলতে চায়। পারে না। কথাটা দেশজুড়ে নানারকম ডাকাতকে অন্তত একবার চিৎকার করে বলতে পারলে হতো।