উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
সপ্তাহে অন্তত তিনটে দিন সন্ধের দিকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে যেতেন ছবি বিশ্বাস। তাঁর জন্য বরাদ্দ থাকত চিঁড়ের পোলাও বা চিঁড়ে ভাজা। প্রথম দিকে ভানু ফিল্ম লাইনে যেসব আন্দোলন করতেন তাতে সায় ছিল না ছবিবাবুর। গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘বাবার আবদারে ছবি জ্যাঠামশাইকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও যোগ দিতে হতো। শুনেছি, বেঙ্গল আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন আসলে বিকাশ জেঠুর (বিকাশ রায়) ব্রেনচাইল্ড। ছবি জ্যাঠামশাই না থাকলে ব্যাপারটা দানা বাঁধবে না বলেই বাবাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে রাজি করানোর জন্য। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও ছবি জ্যাঠামশাইকে নিয়ে বাবা জোরদার আন্দোলন করেছিলেন।’ ছোট জাগুলিয়ায় সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য ছবি বিশ্বাস প্রায় ১০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। ১৯৪২-’৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ পীড়িত জাগুলিয়া গ্রামের ঘরে ঘরে তাঁরই সহযোগিতায় চাল-ডাল পৌঁছে গিয়েছিল।
ছবি বিশ্বাসের অভিনয় জীবন যেমন রঙিন ছিল, তেমনই ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি ছিলেন বর্ণময় পুরুষ। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল একটা রুপোর ডিবে। ভিতরে জর্দা দেওয়া পান সাজা থাকত। বাড়িতেই হোক বা শ্যুটিংয়ের রিহার্সালে মুখে একটা পান তাঁর চাই-ই। তবে ফাইনাল টেকের সময় ফেলে দিতেন। তখন একেবারে অন্য জগতের মানুষ। পান ছাড়া আরও দুটো জিনিসে আসক্তি ছিল তাঁর। সিগারেট আর মদ। ‘জলসাঘর’-এর জমিদারকে কি মদ ছাড়া মানায়! চেনস্মোকার ছিলেন। বিদেশ থেকে তাঁর সিগারেট আসত। পরে অবশ্য সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলেন। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘ছেলেদের চুরি করে সিগারেট খেতে দেখেই সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি।’
উনি ছিলেন মনেপ্রাণে শিল্পী। কাজের ফাঁকে একটু অবসর মিললেই মাটির ফুলদানি, প্লেট, প্লাস্টিকের পাত্রে ছবি এঁকে রং করতেন। তাঁর এমব্রয়ডারি ও বুটিকের কাজও ছিল অসাধারণ। খুব যত্ন করে বাগান করতেন। তাঁর বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে ফুল আর সব্জির বাগান ছিল দেখার মতো। প্রায় ৬০ রকমের জবা আর ৩০ রকমের গোলাপের গাছ নিজেই তদারকি করতেন। বাড়িতে অতিথি এলে নিজের হাতে তোড়া সাজিয়ে উপহার দিতেন। খেলাধুলো বিশেষ করে ক্রিকেটে আগ্রহ ছিল। দারুণ টেবিল টেনিস খেলতেন। গানের বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সমঝদার ব্যক্তি ছিলেন। গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে ও জমিরুদ্দিন খান সাহেবের কাছে কয়েকদিন তালিমও নিয়েছিলেন। এসবের বাইরে আরও একটা শখ ছিল। রান্নার শখ। মাংস তো বটেই, বড়ি, ঝিঙে, পোস্ত দিয়ে দারুণ সুস্বাদু মাছ রান্না করতেন তিনি।
তবে সবচেয়ে ভালো পারতেন অভিনয়ের চরিত্র এবং শিল্পীদের মনের অবস্থা বুঝতে। এরকমই এক ঘটনার কথা এক জায়গায় বলে গিয়েছেন অভিনেতা তরুণকুমার। ‘অবাক পৃথিবী’ নামে একটি ছবি প্রযোজনা করেছিলেন তরুণকুমার। কাস্টিং চলছিল তখন। প্রযোজকের ইচ্ছে, সেই ছবিতে ফাদার রেক্টর ব্যানার্জির চরিত্রে অভিনয় করুন ছবি বিশ্বাস। সেই আর্জি নিয়ে তাঁর বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে গেলেন তরুণকুমার। গল্পটি দারুণ, চরিত্রটিও ভালো। ছবি বিশ্বাসের বেশ পছন্দও হল। চিত্রনাট্য আর চরিত্র নিয়ে আড্ডা-আলোচনা চলছে। কিন্তু একটা সমস্যা তৈরি হল। ছবি বিশ্বাস কিছুতেই বাজেট কমাতে রাজি নন। এদিকে তরুণকুমারের আবার বাজেট বেশি নেই। অথচ মনেপ্রাণে চাইছেন ওই চরিত্রটায় ছবিবাবুই অভিনয় করুন। দাদা উত্তমকুমারও এবার আসরে নামলেন। তখনই ছবি বিশ্বাস সকলকে অবাক করে একটা উপদেশ দিলেন। বললেন, ‘বুড়ো, ওই চরিত্রটায় তুই অভিনয় কর। তোকেই ভালো মানাবে।’ শেষপর্যন্ত তরুণকুমার অভিনীত সেই চরিত্রটাই সেরা সহ-অভিনেতার পুরস্কার জেতে। এরকমই মানুষ ছিলেন তিনি। নিজের অভিনয় বা পেশাকে নিয়ে যেমন কখনও আপস করেননি, তেমনই অন্যকেও কখনও ছোট করেননি। সকলকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন।
ছবি বিশ্বাসের জীবন মানে একটা অসীম যাত্রাপথ। তাই হয়তো রাস্তাতেই তাঁর নিয়তি লেখা ছিল! ছোট জাগুলিয়ার পৈতৃক বাড়িতে যাওয়ার পথে মধ্যমগ্রামের কাছে যশোর রোডে ছবি বিশ্বাসের গাড়িকে বিপরীত দিক থেকে আসা একটা মালবোঝাই লরি ধাক্কা মারে। ১৯৬২ সালের ১১ জুন। ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে গাড়িটা নিজেই চালাচ্ছিলেন তিনি। স্টিয়ারিং এসে লাগে বুকে, পাঁজরের হাড় ভেঙে যায়। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।
অভিনেতা বিশ্বজিৎ বলছিলেন, ‘আমরা বলতাম, ছবিদা অনেকদিন বাঁচবেন। কারণ হাঁপানির রোগীরা তাড়াতাড়ি মারা যায় না বলেই জানতাম। গাড়ি দুর্ঘটনায় ওঁর হঠাৎ চলে যাওয়াটা আমাদের অবাক করে দিয়েছিল। মারা যাওয়ার পর ভানুদা বলল, বুঝলি বিশ্বজিৎ, এই লোকটা চলে যাওয়ায় বাংলার স্ক্রিপ্ট রাইটারদের অনেক মেহনত করতে হবে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন ভানুদা! তখন ভানুদা বলেছিলেন, ব্যারিস্টারের যে চরিত্রগুলো ছিল, সবগুলোকে এবার কেটে মোক্তার করে দিতে হবে। ব্যারিস্টার হয়ে দাঁড়ানোর মতো তো আর কেউ রইল না।’ ছবি বিশ্বাসের আকস্মিক প্রয়াণে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘তাঁর অকালমৃত্যুতে আমার অপূরণীয় ক্ষতি হল। তাঁর উপযুক্ত আরও অনেক চরিত্র আমার পরিকল্পনায় ছিল। তাঁর মৃত্যুতে সেসব আমার মন থেকে মুছে দিতে হয়েছে।’ মানিকবাবুর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে ছবি বিশ্বাসের সেই উক্তি বাংলা ছবির দর্শক নিশ্চয়ই ভোলেননি। ‘মনে রাখব? কেন মনে রাখব? ওর বিশেষত্বটা কী?’ ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ও যে মূর্তিমান কাঞ্চনজঙ্ঘার মতোই আজও অবিচল রয়ে গেল।
ছবি: মঞ্জু দে ও সুনন্দা দেবীর সঙ্গে ছবি বিশ্বাস