প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
‘সুদখোরের টাকায় আমার একমাত্র ছেলের উপনয়ন হতে পারে না তারাপ্রসন্ন।...’ ‘জলসাঘর’ ছবির এই সংলাপ এখনও বাংলা ছবির দর্শকদের মনে গেঁথে আছে ছবি বিশ্বাসের অভিনয় গুণে। ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘দাদাঠাকুর’, ‘সবার উপরে’,‘সপ্তপদী’র মতো ছবিগুলি তো বটেই, ছবি বিশ্বাসকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয় আরও তিনটি ছবি। ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’ আর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন এই তিন ছবির পরিচালক সত্যজিৎ রায়। একটি সাক্ষাৎকারে বলেওছিলেন, ‘ছবিবাবু না থাকলে জলসাঘরের চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব হতো কি না, জানি না। বোধহয় হতো না। একদিকে বিশ্বম্ভর রায়ের দম্ভ ও অবিমৃশ্যকারিতা, অন্য দিকে তাঁর পুত্রবাৎসল্য ও সঙ্গীতপ্রিয় স্বভাব এবং সবশেষে তাঁর পতনের ট্র্যাজেডি— একাধারে সবগুলির অভিব্যক্তি একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।’
‘জলসাঘর’-এর জন্য ৫৫ বছরের প্রৌঢ়কে ঘোড়ায় চড়া শিখতে হয়েছিল। ওই বয়সে রাইডিং স্কুলে গিয়ে রোজ এক ঘণ্টা করে ঘোড়ায় চড়া রপ্ত করতেন। নিখুঁত অভিনেতা আর কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন বলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর পক্ষে। ‘দেবী’ ছবির শ্যুটিংয়ের সময় বেশি আঠা দিয়ে গোঁফ লাগানোর ব্যাপারে নাকি ঘোরতর আপত্তি ছিল ছবিবাবুর। তাঁর স্কিন খুব ডেলিকেট মানে সংবেদনশীল ছিল। বেশি সাঁটাসাঁটি করলে ঠিক অভিনয়টি কিন্তু হবে না— সত্যজিৎবাবুকে নাকি একথাও বলে দিয়েছিলেন স্পষ্টবক্তা ছবি বিশ্বাস।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি পেশাদার মঞ্চেও ছবি বিশ্বাসের অনায়াস বিচরণ ছিল। মিনার্ভা থিয়েটারে মঞ্চস্থ হল ‘ধাত্রীপান্না’। বনবীরের চরিত্রে অভিনয় করেন ছবি বিশ্বাস। বিপরীতে সরযূবালা। আর ছেলে কনকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বছর পাঁচেকের এক পুঁচকে মেয়ে। পরবর্তীকালে সেই ছোট্ট মেয়েটি হয়ে ওঠেন আজকের আর এক দিকপাল অভিনেত্রী। মাধবী মুখোপাধ্যায়। সেই কবেকার কথা! কিন্তু আজও মাধবীর স্মৃতিতে টাটকা। বলছিলেন, ‘তখন অবশ্য আমার নাম ছিল মাধুরী। অভিনয়ের অতকিছু বুঝতাম না। আমার নামটি ওঁর খুব বড় লাগত। তাই ছোট করে মাধু বলে ডাকতেন। পরে সকলের কাছেই এই নামটি পরিচিত হয়ে গেল।’ মন্মথ রায়ের ‘মীরকাশেম’ নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন ছবিবাবু। গিরিশ যুগের অভিনয়ের ধারা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন শিশির ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরীরা। একই মঞ্চে, একই ধারায় তাঁদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাসও। তবে নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখেই অভিনয় করেছেন তিনি। ‘দুই পুরুষ’, ‘বিজয়া’, ‘পথের দাবি’, ‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘সাজাহান’, ‘প্রফুল্ল’, ‘ডাকবাংলো’— একের পর এক নাটকে অমর হয়ে রয়েছে তাঁর অভিনয়। ‘রঙ্গসভা’ নামে একটি নাটকের দলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। মনোজ বসুর ‘বৃষ্টি’ উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘ডাকবাংলো’ প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৫৯ সালের ১২ মার্চ স্টার থিয়েটারে। প্রধান চরিত্র বিশ্বেশ্বরের ভূমিকায় ২৩৮ রজনী দাপিয়ে অভিনয় করেছিলেন ছবি বিশ্বাস। ঘটনাটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এর আগে হাঁপানির জন্য প্রায় ৯ বছর মঞ্চাভিনয় থেকে দূরে সরেছিলেন তিনি। ‘বিজয়া’ নাটকে রোমান্টিক ছবি বিশ্বাসকে এখনও ভুলতে পারেননি মাধবী। বলছিলেন, ‘ওঁর আর সরযূবালার জুটিটা অসাধারণ ছিল। ঝিন্দের বন্দি নাটকে ছবিবাবুর ডাবল রোল ছিল। আমার অবশ্য কোনও অভিনয় ছিল না। তা বলে আমি শুধু বসে থাকতাম না। মাঝেসাঝে নাচতাম।’
মঞ্চ থেকে ছবি, তারপর ছবি থেকে আবার মঞ্চ নিজের অভিনয় জীবন মেজাজে বয়ে নিয়ে গিয়েছেন ছবি বিশ্বাস। তাই ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নাটকের উপসর্গ পত্রে তাঁকে ‘নটসম্রাট’ আখ্যা দিয়েছিলেন মন্মথ রায়। ১৯৫২ সালে তৈরি পরিচালক প্রণব রায়ের ‘প্রার্থনা’ ছবিতে সুপ্রিয়া দেবীর ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মাধবী। তাঁর বাবা-মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ছবি বিশ্বাস ও মলিনা দেবী। ‘নির্বাক অভিনয় কতটা অসাধারণ হলে মন ছুঁয়ে যাওয়া যায় সেটাও ওঁর অভিনয় দেখে সহজেই বুঝেছি। এক এক সময় দেখেছি কথা না বলেও সাংকেতিক অভিনয়েও তিনি কী অনন্য ছিলেন! সেখান থেকে মূল্যায়ন করতে গেলে ছবি বিশ্বাসের মতো সাবলীল অভিনয় খুব বেশি দেখিনি,’ বলছিলেন গুণমুগ্ধ মাধবী।
অভিনয়ের পাশাপাশি একটা অভিভাবকসুলভ অবয়ব ছিল ছবি বিশ্বাসের। শিল্পী এবং কলাকুশলীদের আর্থিক ও অন্যান্য সমস্যায় সর্বদাই তাঁদের পাশে থেকেছেন তিনি। নিজে অভিনেতা হয়েও তাঁর বিশ্বাস ছিল, অভিনয় শিল্পে কলাকুশলীদের ভূমিকাই মুখ্য। মনে করতেন সিনেমার আয়ের অংশ কলাকুশলীদের মধ্যে আগে ভাগ করে দেওয়া উচিত। অভিনেতারা নেবেন সকলের শেষে। শিল্পী এবং কলাকুশলীদের সুযোগ সুবিধা দেখভালের জন্য ১৯৫৯ সালে বসুশ্রী সিনেমা হলের একটি ঘরে ‘অভিনেতৃ সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সভাপতি ছিলেন নরেশ মিত্র, সহ-সভাপতি অহীন্দ্র চৌধুরী। সেক্রেটারি ছিলেন ছবি বিশ্বাস। এই সংগঠনের পিছনের কাহিনি বলছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র গৌতম। তখনকার বেশিরভাগ অভিনেতাই এইসব আন্দোলন ইত্যাদি পছন্দ করতেন না। গৌতম বলছিলেন,‘আন্দোলন করতে বাবা খুব ভালোবাসতেন। অভিনয় ও আন্দোলন দুই ব্যাপারেই বাবার প্রচণ্ড উৎসাহ ছিল। আর মাথার উপর ছবি জ্যাঠামশাইয়ের হাত থাকায় বাবাকে সচরাচর কেউ ঘাঁটাতে সাহস পেত না।’