প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
চাকরি জীবনে একবার ফিল্ম ডিভিশনের তথ্যচিত্র তৈরির কাজে জড়িত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। তথ্যচিত্রের বিষয় ছিল, আদিবাসীদের জীবনে কৃষি প্রশিক্ষণ প্রকল্প কীভাবে সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। পরিচালক দুমকা শহরের আশপাশের গ্রামে শ্যুটিং করবেন।
দুমকা শহরে আমাদের প্রকল্পের জেলা অফিস ছিল। অফিসের মাথা মোহন সিং। আমার অনুরোধে সব ব্যবস্থা করে দিল ও। পরিচালক আমাকে নিয়ে শ্যুটিংয়ের স্পট দেখে চিত্রনাট্য লিখে ফেললেন। নায়ক-নায়িকা ও লোকাল ম্যানেজার নির্বাচনও হয়ে গেল।
এবার আসল কাজ, সিনেমার ছবি তোলা। শ্যুটিংয়ের আগের দিন দুপুরে সাজসরঞ্জাম নিয়ে আমরা ম্যাসাঞ্জোরে সেচ দপ্তরের বাংলোয় পৌঁছে গেলাম। পরিচালকের সঙ্গী হলেন সাউন্ড রেকর্ডিস্ট ও ক্যামেরাম্যান। বাংলোয় পৌঁছবার পর লোকাল ম্যানেজার নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে এল। ওদের সঙ্গে কাজ নিয়ে কথা বলতে হবে। পরিচালক লোকাল ম্যানেজারের সহায়তায় বুঝিয়ে বললেন, উনি কী করতে চান। ওদের দু’জনকে কী করতে হবে। ওরা সবেতেই মাথা নাড়ল। কী বুঝল, কে জানে?
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ শ্যুটিং শুরু হল তথ্যচিত্রের শেষ দৃশ্য দিয়ে। লাল মাটির সরু রাস্তা। দু’পাশে পাকা ফসলের খেত। মাঝেমধ্যে শাল-পলাশের গাছ। চারদিকে রোদ। বাতাসে হালকা শীত। নায়ক-নায়িকাকে সাইকেলের রডে বসিয়ে কোথাও যাচ্ছে। দু’জনের মুখে হাসি, কথাবার্তা। নায়িকার হাতে ঝোলানো ট্রানজিস্টারে গান বাজছে। উন্নয়নের সুফলের প্রতীক।
জীবনে প্রথম সিনেমার শট। অনভিজ্ঞ নায়ক-নায়িকা। পরিচালক বারবার বলছেন, ক্যামেরার দিকে না তাকাতে। কিন্তু ওরা তাকাচ্ছে। রিটেকের পর রিটেক। অনেক কষ্টে তোলা হল শেষ দৃশ্যের ছবি।
এরপর চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে শস্যের খেত, শাল-মহুয়ার জঙ্গল, ঢেউ খেলানো প্রান্তর, শীতের শীর্ণ নদী, পাহাড়ের রেখা ও গ্রামের বাড়িঘরের ছবি তোলা হল।
আগে থেকে ঠিক ছিল, সন্ধে নাগাদ এক সাঁওতালি গ্রামে নাচের দৃশ্য তোলা হবে। ব্যবস্থার দায়িত্ব লোকাল ম্যানেজারের।
সন্ধের মুখে সেই গ্রামে গিয়ে দেখি সব ফাঁকা, নিঝুম। হ্যাজাক জ্বেলে একটা আধো-অন্ধকার খোলা জায়গায় লোকাল ম্যানেজার চুপচাপ বসে আছে। পাশে স্তব্ধ জেনারেটর ও তার চালক।
আমাদের দেখে লোকাল ম্যানেজার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই আদিবাসী গ্রামের মুখিয়াকে আগের দিন বলে নাচের ব্যবস্থা করে গিয়েছি। হাঁড়িয়া খাওয়ার টাকাও দিয়েছি। শিল্পীদের এতক্ষণে এসে যাওয়ার কথা। অথচ কেউ আসেনি। এক মরদ এসে বলে গেল, গাঁয়ের এক ঘরে বিকেলে বাচ্চা হয়েছে। সবাই মিলে দেখতে গেছে বাচ্চাকে। কখন আসবে এখানে, তা বলেনি।’
ইতিমধ্যে অন্ধকার চারপাশ চেপে ধরেছে। বাড়ছে ঠান্ডাও। নাচের দৃশ্যে অংশ নিতে নায়ক-নায়িকাকে সঙ্গে আনা হয়েছিল। আমাদের দুর্গতি দেখে নায়ক বলল, গাঁয়ের লোকজন ওর চেনা। ও গিয়ে বাকিদের ডেকে আনছে।
নাচের মেয়েরা আসার আগেই পরিচালক সবাইকে তৈরি হয়ে নিতে বললেন। জেনারেটর চালু হল। ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা বসালেন। শ্যুটিং জোনে আলো ফেলল আর্কলাইট। তৈরি হয়ে নিলেন সাউন্ড রেকর্ডিস্ট। তারপর, শুরু হল আমাদের অপেক্ষা। ঠান্ডায় জমাট বাঁধা। মশার কামড়ে জর্জরিত হওয়া।
হঠাৎ কানে এল, কলকলানো হাসির শব্দ। নেশা জড়ানো গলায় কথাবার্তা। ওরা আসছে।
সবাই আসতেই নায়ক বুদ্ধি করে নাচের জায়গায় গিয়ে একটা মাদল নিয়ে বাজাতে শুরু করল। আর এক মরদ সুর তুলল বাঁশিতে। মাদলের তালে, বাঁশির সুরে তাল মিলিয়ে নাচের মেয়েরা শুরু করে দিল নাচ। মুখে গান। নায়িকাও যোগ দিল। শুরুতে ঝামেলা হলেও, পরিচালক কয়েক মিনিটের মধ্যে কাজ সেরে বললেন, ‘প্যাক আপ’।
কিন্তু ‘প্যাক আপ’ পুরো হল না। হাঁড়িয়ার নেশায় নাচ চলতেই লাগল। আসলে নাচের কলাকুশলীরা জানে না প্যাক আপ কাকে বলে। আমরা চলে এলাম।
আগের রাতে বুঝিনি, পরদিন সকালেও আমাদের কপালে দুর্গতি লেখা আছে। সেদিন সারাদিনের শ্যুটিং। সকাল হতেই শ্যুটিং স্পটে সবাই পৌঁছে গিয়েছি। মোহন সিং জিপ নিয়ে গ্রাম থেকে নায়ক-নায়িকাকে আনতে গিয়েছে।
জিপ খালি ফিরে এল। মোহন সিং জানাল, নায়ক-নায়িকা বাড়ি নেই। দুমকায় মহাজনের গদিতে মজুর খাটতে গিয়েছে।
নায়ক-নায়িকা না এলে পুরো শ্যুটিং বরবাদ। তড়িঘড়ি জিপ ছোটানো হল দুমকার দিকে। ওখানে পৌঁছে মহাজনের গদিগুলোয় খোঁজ করতে দেখা পেলাম নায়ক-নায়িকার। না জানিয়ে এভাবে চলে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতে নায়ক বলল, ‘কাল সিনেমার ছবি তুলে মজুরি পাইনি। আমাদের চাষবাস নেই। মজুরি না পেলে আমরা খাব কী?’
নায়কের কথা শুনে আমাদের চেতনা হল। সত্যিই তো, ওদের মজুরির ব্যাপারটা আমরা আগে ভেবে দেখিনি।
অভিনয় যাদের পেশা, তারা সিনেমায় কাজ করলে পারিশ্রমিক পায় তাহলে ওরা কেন পাবে না! এটা ওদের ন্যায্য প্রাপ্য। আদিবাসী হওয়ায় আমরা কেন ধরে নেব, সিনেমায় মুখ দেখানোর আনন্দে ওরা ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে বিনা মজুরিতে আমরা যা বলব, তাই করবে!
নায়কের থেকে ওদের একদিনের মজুরি জেনে পরিচালক আগের দিনের মজুরি দিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আজ থেকে রোজ কাজের শেষে তোমরা মজুরি পাবে।’
ওদের মুখে হাসি ফুটে উঠল।
শ্যুটিং স্পটে ফিরে আসার পর ক্যামেরাম্যান আমাকে ফিসফিস করে বললেন, ‘ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে সবাই এভাবে নিজের দর আপনা থেকেই বাড়াতে শিখে যায়। এ ব্যাপারে টলিউড, বলিউড, দুমকা—সব এক।’
ক্যামেরাম্যানের কথা শুনে আমি মৃদু হাসলাম। মনে হল, ওরা তো দর বাড়ায়নি। ওদের ন্যায্য দৈনিক মজুরিটুকু চেয়েছে।