প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
মাসি বহুবার ডাকলেও মালতীপুর থেকে কলকাতায় গিয়ে থাকা নিয়ে মায়ের বরাবর আপত্তি ছিল। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে দাদা একেবারে তালুইমশাই হয়ে বসল। তিনটে অপোগণ্ড বাচ্চা আর খান্ডারনি বউ নিয়ে দাদা নিজেও যে লেজে-গোবরে হয়ে আছে সেটা বোকা হলেও বুঝতে পারত রাকা। বাবা বেঁচে থাকতে মা তাকে আগলে আগলে রাখত। বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত রাকা সকাল আর রাতের মাঝের সময়টুকু কাটিয়েছে মাছ ধরে, ফুটবল খেলে। গাঁয়ে তার বাবার মুদির দোকান ভালোই চলে বটে কিন্তু বাবা মরে যেতে তার দখল নিয়ে নেয় দাদা। তাতে সস্তার বেবিফুড থেকে আলু, পেঁয়াজ পর্যন্ত পাওয়া যায়। বাবা মারা যাওয়ার পর, দাদা তাকে বহুবার দোকানে বসতে বলেছে। মায়ের মুখঝামটা আর বউদির গঞ্জনার চোটে তাকে শেষতক দোকানে বসতে রাজি হতে হয়। কিন্তু ছেলেবেলার টাইফয়েডের কারণেই হোক বা যাই হোক- ক্যাশ মেলাতে গিয়ে মাথাটা যেন ঘুমিয়ে পড়ত তার। তাই দিন তিনেক পরেই সে বুঝে গেল, এ কাজ তার দ্বারা হবে না। এই সময় কলকাতা থেকে মাসি এল মায়ের তত্ত্ব-তল্লাস নিতে। মাসি চালাক মানুষ। সেই কোন কালে মেসো মারা গিয়েছে দুই মেয়ের জন্ম দিয়ে। চার বাড়ি রান্না করে, শাড়িতে ফলস বসিয়ে, সোয়েটার বুনে দুই মেয়ের ভালো বিয়ে দিয়েছে। রান্নার কাজ ছেড়ে দিলেও বাড়িতে বসেই মাসে না-হোক পাঁচ-ছ’হাজার রোজগার করে সোয়েটার বুনে। ভয়ানক দজ্জাল আর মুখফোঁড় মাসি একাই তিনটে ব্যাটাছেলের মহড়া নিতে জানে।
তো সেবার, মাসি এসে হাজির পুজোর আগে আগে। দুপুরে মায়ের নিরিমিষ্যি হেঁশেলে খেয়ে উঠে পান মুখে দিয়ে বসে পাড়ল আসল কথা। মাসি দজ্জাল হলেও লোক খারাপ নয়। দুপুরে পান মুখে দিয়ে,বউদির সামনেই বলে বসল, রাকাকে আমায় দিবি দিদি? আমার তো ছেলে নেই। একা বেওয়া মানুষ। জ্বর হলে মুখে জল দেওয়ার কেউ জোটে না। বউদি কথা পড়তে দেয় না, ‘কী বল মাসি! দু-দুটো মেয়ে তোমার...অমন সব সোনার চাঁদ জামাইরা থাকতে তোমার আবার জনের অভাব?’
‘তা যদি বল, বিয়ের পর মেয়েরা পর। জামাইদের কথা যদি তোলো বাছা, ওরা সব পরের ছেলে আর কথায় আছে জন, জামাই, ভাগনা তিন নয় আপনা।’
বউদি কুঁদুলে হলেও মাসির সঙ্গে পেরে উঠবে কেন? সংসার থেকে রাকার মাইনাস হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় বউদিও বেশি কথা বাড়ায়নি। মা দু’ফোঁটা চোখের জল ফেললেও রাকাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে যায় ভবিষ্যতের কথা ভেবে। সেই থেকে রাকা কলকাতায়। আহা! এখানে রোজ সেই খেলা শুরুর সাইরেন আর সেই সঙ্গে উপরি মিলে গেল বুলি। মাসির পাশের বাড়িতে থাকে বুলিরা। বাড়ি মানে দু-কামরার ঘুপচি। বুলি প্রায়ই মাসির কাছে আসে। কুটনো কুটে দেয়, চায়ের জল বসায়, গল্প-গুজব করে। রাকার কথা জানত। মাসিই সাতখানা করে সে কথা বলেছে তাকে— ‘বোনপোটা গ্রামে বসে বসে বয়ে যাচ্ছিল, বুঝলি! তাই নিয়ে এলাম। শহর-বাজার এলাকা। যা হোক কিছু জুটে যাবে আর না হলে আমি তো রইলাম।’ প্রথমটায় তাকে দেখে বুলি মুখে কিছু বলেনি। কিন্তু মুখখানা তাকে দেখলে যে বেজার হয়ে যায় তা ঠিকই নজর করেছিল রাকা।
ঘরে বসে বসে দিন কাটাতে দিল না তাকে মাসি। রাকা কাজ পেল পাশের ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে। মাইনে পাঁচ হাজার টাকা। মাধ্যমিক পাশ অবধি তো দৌড়— এর বেশি আর কী-ই বা জুটবে! এমন সময়, মিত্তিরদের কুড়ি বছরের ড্রাইভার কাজ ছেড়ে দেওয়াতে তারা সেন্টার থেকে লোক আনা শুরু করল। ওদিকে সে গাড়ি মুছবে না, নতুন কাজ নিল সে। সপ্তাহে তিন দিন গাড়ি ধোওয়া-মোছা। এসবের মধ্যেই , বুলিকে দেখত রাকা। বুলির বিদ্যে ছয় ক্লাস পর্যন্ত। মা মারা গেছে জন্ম দিয়েই। বাপটা সারাদিন পান-সিগারেট বেচে আর রাতে ধেনো টেনে পড়ে থাকে।
রাকা মনে মনে বুলিকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখত না, তা নয়। কাঁচা বয়সের তো একটা ধর্ম থাকেই। বলতে নেই, বুলিকে দেখতেও বেশ ঢলঢল। তবে গোল বেঁধে আছে অন্য জায়গায়। মেয়েটা কেন কে জানে রাকাকে দেখলেই খ্যাপা কুকুরের মতো রেগে ওঠে আজকাল। ঘটনাটা যেদিন ঘটে, সেদিন ছিল রবিবার। রবিবার একটু দেরি করে সে কাজে যায়। সেদিন রাকা একটু গড়াচ্ছিল বিছানায়। মাসি বাজারে। এমন সময় তিনি এসে উদয় হলেন। সদ্য স্নান সারা, গোলাপি ছাপা শাড়িতে বুলিকে দেখে বেশ ঘোর লাগছিল রাকার। ঠিক যেন তাদের মালতীপুরের যমুনা টকিতে বহুকাল আগে দেখা, ‘আশ্রিতা’ সিনেমার মিঠু মুখার্জি! এই সব ভেবে বেশ পুলকই জাগছিল রাকার। এমন সময় বুলি খরখরিয়ে উঠল, ‘এত বেলা পর্যন্ত পড়ে পড়ে দামড়া ছেলে ঘুম মারে, এই প্রথম দেখলুম! তা আজকাল নেশা-ভাং ধরা হয়েছে নাকি বাবুর?’ বুলির কাছ থেকে খারাপ ব্যবহার পেতে অভ্যস্ত হলেও, সেদিন সদ্য ঘুম-ভাঙা রাকার হেব্বি রাগ হয়ে গেল, ‘এই শোনো, তুমি এত ফালতু কথা বল কেন বলত? কে তোমাকে এ বাড়িতে যেচে এসে এত ফোঁপর দালালি করতে বলেছে?’ বুলিও এত সহজে হেরে যাওয়ার পাত্রী নয়, ‘বলেছি বেশ করেছি! এহ! মাসির পয়সায় নবাবি করবে আর বড় বড় কথা। দারোয়ানি করে ক’পয়সা মাইনে পাও? শুনি?’
‘কে তোমাকে দালালি করতে বলেছে? কেটে পড়ো মানে মানে।’
বুলিও ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নয়। সেও সুর চড়িয়ে জবাব দিয়ে দেয়, ‘ওসব ফালতু বাতেলা আমার জানা আছে। আবার বলছে, দালালি করি! অন্যের পা ধোওয়া গাড়ি মোছার চেয়ে ঢের বেশি ভালো।’ বলেই যেই সে পেছন ঘুরেছে, রাকা অমনি বাঘের মতো লাফিয়ে একটান তার চুল ধরে। তারপর যা হল, তাকে আর যাই হোক মারামারি বলা যায় না! বুলি গোড়ায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও হাল ছাড়ে বটে তবে তার আগে বিস্তর আচঁড় কেটে দেয় রাকার হাতে, মুখে, গলায়। তারপর বুলি পগারপার হয়েছে, মাসি বাজার নিয়ে ফিরেছে, রান্না করেছে কিছুই খেয়াল করতে পারেনি রাকা। আনমনে নিজেকে গালিগালাজ করতে করতে চা নিয়েছিল, স্নান সেরে খেতে বসেছিল। তবে যতই যাই হোক মাসির চোখ এড়ানো এত সহজ কাজ নয়। তাই যখন সে ভাতের সঙ্গে শুক্তো,ডাল, আলু পোস্ত একসঙ্গে মেখে গরাস তুলছিল, মাসি জানতে চাইল, ‘কী হল রে?’
‘কীসের কী হল?’
‘এমন দুধ দিয়ে,বড়ি দিয়ে শুক্তো রাঁধলুম, পোস্ত করলুম, ভাজা মুগের ডাল করলুম— সব যে এক সঙ্গে মুখে দিচ্ছিস বড়? কী হয়েছে বল দিকি বাপ? সকাল থেকে এট্টু যেন আনমনা দেখছি তোকে।’
‘কিছু না মাসি। ভাবছি ভাইপো-ভাইঝিগুলোকে বহু দিন দেখি না। একবার যেতে হবে গাঁয়ে। ছুটির কথা বলব গিয়ে বাবুদের।’
‘অ। তা দাদার ছায়েরা একেবারে স্বর্গে বাতি দেবেখন তোমার। আমি ভাবি,কী না কী!’
নিজেকে খুন করতে ইচ্ছে করছিল বড়। এমন একটা কাণ্ড যে, সে নিজে ঘটাতে পারে কিছুতেই সেটা মেনে নিতে পারছিল না। হায় হায়! শেষে একটা মেয়ের সে চুলের মুঠি ধরেছে! জোর করে চুমু খেয়েছে! বাড়িতে দাদা কক্ষনও বউদির গায়ে হাত তোলেনি। বাবাও মেয়েদের ভারী সম্মান করতেন চিরকাল।
এ কী বিপদের মধ্যে পড়ল সে! কলকাতায় থাকার সেই অমোঘ সাইরেনও আর বাজছে না দুপুর থেকে। সাইরেন ছাড়া কলকাতা তার সহ্য হবে কী করে! মাসি বোধহয় কিছু আন্দাজ করে ফেলেছে। মুখে কিছু বলেনি এখনও, তবে কখন যে বলে বসবে তার ঠিক নেই। ওদিকে বুলির মুখোমুখিই বা আর কী করে হবে সে? সারাদিন ডিউটিতে বসে ভাবল রাকা। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মাথার মধ্যে কারা যেন কথা বলে উঠল। নির্জন কুয়াশায় ছেয়ে গেল শ্যামপুকুরের গলি। কে যেন, হেঁকে বললে তাকে, পালা রে, রাকা পালা। কোথায় যাবে রাকা? বিষ খেতে পারলে, জ্বালা জুড়ত নিশ্চয়ই। কিন্তু এদিকে কোথায় কী পাওয়া যায় জানেও না। পাড়ার ওষুধের দোকানের লোকগুলো তাকে খুব ভালো করে চেনে। ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের ওষুধ এনে দেয় বলে। গাঁয়ের মেয়েরা ফলিডল গলায় ঢেলে সুইসাইড করে বটে। এ শহরে তেমন সহৃদয় ব্যক্তি সে কোথায় পাবে যে কি না তাকে বিনা প্রশ্নে ফলিডল এনে দেবে! তবে কী আবার সেই ধ্যাড়ধ্যাড়ে মালতীপুর? সেখানে ভাত ঠিকই জুটে যাবে কিন্তু নিজের রোজগারের অন্নের স্বাদ কী আর সেই হতচ্ছেদ্দার থালায় থাকবে? তার চেয়ে বরং কাশী যাওয়া যাক! শুনেছে সেখানে বড়লোকেদের ছত্তর আছে। দু’বেলা খাবার মেলে। আছেন বাবা বিশ্বনাথ। বাবার মন্দিরে মাথা ঠেকিয়ে রাবণ রাজাও নাকি উদ্ধার হয়ে গিয়েছিলেন, তার তো সামান্য চুমুর মামলা! মনে মনে ঠিক করে নিল রাকা। নাহ- বিশ্বনাথের এলাকাতেই চলে যাবে সে। মন্দিরে মাথা ঠুকবে। যদি পাপটুকু কেটে যায় বাবার দয়ায়, বাকি জীবনটা না হয় কাশীবাসী হয়েই থাকবে। মা-মাসির থেকে দূরে থাকবে ভেবে বুকটা সামান্য চিনচিনিয়ে উঠছে বটে তবে তার পরোয়া করলে চলবে না।
সে রাতেই মাসিকে বলে মালতীপুর যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে পড়ে রাকা। একখানা চটের ব্যাগে গোটা কয়েক জামা-প্যান্ট, একটা গামছা গুছিয়ে নেওয়ার সময় জমানো হাজার তিনেক টাকাও সে পকেটে ভরে নেয়। মোবাইল ফোন ইচ্ছে করে ফেলে রাখে মাসির টাকা রাখার দেরাজে। রাত আটটা নাগাদ হাওড়া থেকে একখানা ট্রেন যায় কাশীতে, জানা ছিল তার।
অন্যান্য দিন, মাসির সিরিয়াল দেখার সময় হাজির থাকে বুলি। আজ অ্যাবসেন্ট। রাকা ডিউটি থেকে ফিরে এসেছিল বিকেল বিকেল। এসেই মাসিকে বলেছিল, দুটো ভাতে-ভাত বসিয়ে দাও মাসি। আজ রাতেই ট্রেন ধরব। বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে ঢের দেরি হয়ে যাবে। ওরা তো আবার তাড়াতাড়ি খেয়ে, শুয়ে পড়ে। ছেলের তক্ষুনি যাওয়ার কথায় মুখে আঁধার নামলেও মাসি ঘণ্টা দেড়েক বাদে যখন ভাত বেড়ে ডাকল, তখন নয় নয় করেও পাতের পাশে তিনখানা বাটি সাজানো। খেতে খেতেই যেন মাসিকে বিড়বিড় করতে বলতে শুনেছিল, ‘কী যে হল মেয়েটার! সারাদিন বিছানায় পড়ে আছে। খাওয়া-দাওয়াও করেনি।’ আরও যেন কি সব বলে যাচ্ছিল মাসি। খেয়ে উঠে আঁচাতে যতটুকু সময়— ব্যস! তারপর বেরিয়ে পড়েছিল। অফিস টাইম খতম হয়ে গেছে বটে কিন্তু কলকাতা শহরের জ্যাম বলে কথা! আজ রাকার কপাল খারাপ ছিল না, মানতেই হবে। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতে না পৌঁছতেই এসে গেল হাওড়ার মিনি। বসার জায়গাও মিলে গেল। হাতে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়াতে অসুবিধা হতো। দিনটা বোশেখ মাসের হলেও হাওয়া দিতে লাগল। বার কয়েক যেন মেঘের ডাকও শোনা গেল। কয়েক ঝলক ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগল রাকার। হাওড়ায় নামতে গিয়ে মহা ঝামেলা! কালবোশেখি ঝটপটাচ্ছে। সে কী বাজের শব্দ! একটা চায়ের দোকানের ত্রিপল উড়ে গেল প্রায় মাথার ওপর দিয়ে। ভীমবেগে উড়ে যাচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যাগ, ছেঁড়া কাগজ। স্টেশনে ঢুকে তবে স্বস্তি। কাউন্টারে বেজায় ভিড়। সওয়া ঘণ্টা টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে তবে তার পালা এল। যেই মাত্তর হাত বাড়াতে যাবে, অমনি পাশ থেকে চেনা গলা, ‘আমার টিকিটখানাও কেটে নিতে হবে।’
রাকার এক গাল মাছি! এ কাকে দেখছে সে!
‘সেই দুপুর থেকে পেছনে লেগে আছি! ফেলে পালিয়ে যাবে, সেটি হচ্ছে না!’
‘তা বলে এভাবে...আমার সঙ্গে...’ তোতলাতে থাকে রাকা আর তার অন্তহীন তোতলানোর মাঝেই বলে ওঠে সে মেয়ে, ‘তোমার সঙ্গে বলেই তো যাচ্ছি।’ তারপর ঝর্ণার মতো কত কী যে সব বলে যেতে থাকল— বৃষ্টির আওয়াজে ঢেকে গেল সব! রাকা বুঝতে পারল, শো শুরু হয়ে গেছে আবার।