প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
আসলে ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবিটায় রহমতের বেশে ছবি বিশ্বাস এতটাই উচ্চমানের অভিনয় করেছেন যে সেটা দর্শকদের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। ছবির শেষে গল্পে দেখা যায় পিতৃহৃদয়ে কখনও দুই দেশের কাঁটাতার বেড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে না। অভিনয় দিয়ে সেই বোধ দর্শকদের মনেও সঞ্চারিত করে দেন তিনি। কান্নাহাসির দোলাচলে আকুল বাঙালি সেই আফগান পুরুষের বেশধারী বাঙালি অভিনেতাটিকেও আপন করে নেয় সহজেই।
গোপীমোহন লেনের বাসিন্দা শচীন্দ্রনাথ বসুর কন্যা নীহারবালা দেবী ওরফে সমীরাদেবীর সঙ্গে ছবি বিশ্বাসের বিয়ে হয়। তাঁদের দুই পুত্র মলয় ও দিলীপ এবং একটি মাত্র কন্যা মঞ্জুলা। বার্লিনে সেই প্রশ্নকর্তাকে যেমন জবাব দিয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস, তেমনই সহকর্মীদের সঙ্গেও মজা করার ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি ছিল না। ওইরকম ব্যারিটোন কণ্ঠস্বর আর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলেও মজা করার সময় একেবারে অন্যরকম মানুষ হয়ে যেতেন তিনি। এক শীতের রাতের ঘটনা। ছবি বিশ্বাস তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। শ্যুটিং সেরে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। বাঁশদ্রোণীতে তাঁর বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই পাহারারত এক পুলিস কনস্টেবলকে দেখতে পেলেন। প্রচণ্ড ঠান্ডায় সেই কনস্টেবল তখন রীতিমতো কাঁপছেন। তাঁকে গিয়ে ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘ইস, তোমার কী কষ্ট! যাও তুমি আমার বাড়ি গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়। আমি তোমার হয়ে পাহারা দিচ্ছি, তাঁর এহেন আবদারে মহা ফাঁপরে পড়লেন ওই কনস্টেবল। তিনি কীভাবে অভিনেতাকে নিরস্ত করবেন যখন ভেবে পাচ্ছেন না, তখন ত্রাতা হয়ে দেখা দেন ছবি বিশ্বাসের স্ত্রী। তাঁর হস্তক্ষেপেই শেষপর্যন্ত বিষয়টি মেটে। যে যার নিজের জায়গায় ফিরে যান।
ছবি বিশ্বাস সিরিয়াস অ্যাক্টর হলেও তাঁর কমেডি সেন্সও ছিল দুর্দান্ত। ১৯৫৮-’৫৯ সালের একটি ঘটনা। বউবাজার থেকে ট্যাক্সিতে বসুশ্রী সিনেমায় যাচ্ছেন তিনি। ট্যাক্সি ড্রাইভার কমবয়সি, ফক্কড় গোছের বাঙালি ছেলে। তাঁকে চিনতে পেরে একটু স্মার্টনেস দেখানোর চেষ্টায় তাঁকে ‘জ্যাঠাবাবু’ বলে ডাকতে লাগল। বোকা লোক অযথা স্মার্টনেস দেখানোর চেষ্টা করলে ছবি বিশ্বাস ভয়ঙ্কর রেগে যেতেন এবং তাকে তুলোধনা করতেন। তিনি ছোকরাটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জ্যাঠাবাবু! আমি যে তোমার বাবার থেকে বয়সে বড় তা তুমি কী করে জানলে?’
ছোকরা তাতেও না থেমে অনর্গল কথা বলেই যেতে লাগল। ট্যাক্সি বসুশ্রী পৌঁছলে, তিনি জানতে চাইলেন, ‘কত উঠেছে?’ ছোকরা উত্তর দিল, ‘দুই টাকা।’ তখন ছবি বিশ্বাস ছোকরাকে বলেন, ‘আচ্ছা ভাইপো, বউবাজার সোনাপট্টি থেকে কালীঘাটের বসুশ্রী পর্যন্ত যদি দুই টাকা ওঠে, তাহলে বসুশ্রী সিনেমা থেকে বউবাজার পর্যন্ত ট্যাক্সিতে যেতে কত টাকা উঠবে?’ ছোকরা এই প্রশ্নে অপ্রস্তুতে পড়ে খানিক মাথা চুলকে বলল, ‘এ আপনি কী বললেন জ্যাঠাবাবু! বউবাজার থেকে কালীঘাটের বসুশ্রী যতদূর, বসুশ্রী থেকে বউবাজারও তো ততদূরই। তাহলে একই টাকা উঠবে।’ ছবি বিশ্বাস তখন ছোকরার দিকে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তাই বুঝি! আচ্ছা ভাইপো বলো তো দুর্গাপুজোর কতদিন পরে কালীপুজো?’ ‘প্রায় এক মাস’, ছেলেটা উত্তর দেয়। তখন ছবি বিশ্বাস পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আর কালীপুজোর কতদিন পরে দুর্গাপুজো?’ ছোকরা এই প্রশ্নে আমতা আমতা করতে থাকে। তখন ছবি বিশ্বাস তাকে বলেন, ‘উত্তরটা খুঁজতে থাকো। যদি ভেবে পাও, তাহলে বসুশ্রীর ভেতরে গিয়ে আমাকে বলে এসো।’ বলেই গটগট করে হলের ভেতরে চলে গেলেন। ছোকরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়েই রইল।
ছবি বিশ্বাসের জীবনে এরকম ঘটনার নিদর্শন প্রচুর। একবার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস আর গঙ্গাপদ বসু কোনও একটি ছবির শ্যুটিং সেরে রাতে ট্রেনে ফিরছিলেন। এর আগে কোনও একসময় গঙ্গাপদ বসু প্রফেশনাল থিয়েটার সম্বন্ধে কটূক্তি করেছিলেন, যা স্বাভাবিকভাবেই পছন্দ হয়নি ছবি বিশ্বাসের। তিনি ঠিক করলেন গঙ্গাপদ বসুকে এর সমুচিত জবাব দেবেন। রাত ১২টা নাগাদ যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়েছেন সেই সময় ছবি বিশ্বাস এলেন গঙ্গাপদ বসুর কাছে। তাঁকে মৃদু ঠেলা দিয়ে বললেন, ‘কি ঘুমলে নাকি ভাই গঙ্গা?’ গঙ্গাপদ তখন নাক ডেকে ঘুমচ্ছেন। আচমকা ঠেলা খেয়ে ধড়পড় করে উঠে বসে গঙ্গাপদ বললেন, ‘ না না, ঘুমোইনি।’
ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘ভালো ভালো। তাহলে একটু গপ্পো করা যাক।’ বলে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। গঙ্গাপদ এদিকে ঝিমোবার চেষ্টা করছেন। তখনই ছবি বিশ্বাস কামরার বাকি সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ‘এই যে আমাদের গঙ্গাভাই, এ এক বিরাট ব্যাপার।’ তারপর হাতজোড় করে বলেই চললেন, ‘মা গঙ্গা, বুড়ি গঙ্গা, আদি গঙ্গা, আমার বাড়ির পাশে টালির গঙ্গা, তারপরেই আমাদের এই ভাই গঙ্গা। কী ঘুমলে ভাই?’
গঙ্গাপদ বসু বুঝতে পারলেন, তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সিনিয়র আর্টিস্টকে তখনকার দিনে জুনিয়র আর্টিস্টরা অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। উনিও চুপচাপ হাসলেন। এইভাবে রাত তিনটে পর্যন্ত চলল। ছবি বিশ্বাস তো হাঁপানির জন্য রাতে অনেকক্ষণ জেগে থাকতেন। ঘুমতে ঘুমতে গভীর রাত হয়ে যেত। রাত তিনটের সময় ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘আজ আর আড্ডা নয়। আমি এবার ঘুমতে চললাম। তুমিও ঘুমাও ভাই গঙ্গা।’ আর ঘুম! ততক্ষণে ঘুম চটকে গিয়ে গঙ্গাপদ বসুর মাথার চুল খাড়া হয়ে গিয়েছে। (ক্রমশ)
অরুণ মুখোপাধ্যায় ও ছবি বিশ্বাস।