প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
মহেশ্বর দণ্ডবতের সঙ্গে আমার আচমকাই আলাপ হয়েছিল। মানুষটা এত অদ্ভুত যে, ওঁকে ভোলা যায় না।
সময়টা ছিল সকাল, এই সাড়ে সাতটা মতো হবে। শীত সবে হামাগুড়ি দিয়ে আকাশে-বাতাসে ঢুকে রাজ কায়েম করতে শুরু করেছে। আমি বড় রাস্তার ধারে ফুটপাথের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিলাম। অফিসের বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
আজ, বুধবার, এই এলাকায় একটা হাট বসে— জামাকাপড়ের বড়সড় হাট। একটু দূরেই চোখে পড়ছে কাঠের ছোট-ছোট চৌকি পেতে হাটুরিয়ারা শীতের পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসে পড়েছে। তার ওপরে ঝুঁকে পড়েছে মানুষের ঝাঁক।
আমি অলসভাবে তাকাচ্ছিলাম চারপাশে। ব্যস্ত রাস্তায় বাস, গাড়ি, মোটরবাইক, সাইকেল ভ্যান সব এদিক-ওদিক ছুটে চলেছে। তারই মধ্যে লোকজন কায়দা করে রাস্তা পারাপার করছে। এসব দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, আমার বাসটা কখন আসবে।
হঠাৎ দেখি মোটামতন একজন ভদ্রলোক ফুটপাত ধরে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। শুধু এগিয়ে আসছেন না, আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেনও।
‘আরে, সকাল-সকাল এখানে দাঁড়িয়ে? কী বেপার?’ খুব-চেনা মানুষের মতো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন তিনি। তার সঙ্গে আন্তরিক হাসিটা এমন, যেন কত দিনের চেনা। ওঁর কথায় সামান্য হিন্দি টান টের পেলাম।
আমি মনের ভেতরে ডেসপারেটলি স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলাম। আমার সামনে একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটিকে আমি কি চিনি?
গোলগাল মুখ। মাজা রং। মুখে দিনদুয়েকের না কামানো খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। বয়স পঞ্চাশ-টঞ্চাশ হবে।
ওঁর গায়ে ফিকে রঙের শার্ট, তার ওপরে সরু-সরু খয়েরি স্ট্রাইপ। পায়ে পাজামা। মুখের হাসিটা একেবারে শিশুর মতো সরল।
না, মনের মধ্যে শত খোঁজাখুঁজি করেও কোনও মুখের স্মৃতির সঙ্গে এই মুখটাকে মেলাতে পারলাম না।
সামান্য দ্বিধা কাটিয়ে ওঁর কথার উত্তর দিলাম, ‘অফিসের বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি।’
‘আপনার নামটা কী যেন?’
একটু অস্বস্তি হলেও নিজের নাম বললাম। উত্তরে ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘আমার নাম মহেশ্বর দণ্ডবত।’ তারপর সামনের একটা গলির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ওই গল্লিটায় ঢুকে খানিকটা এগিয়ে গেলে একটা ছোটা কালীমন্দির পাবেন, পাশে একটা বড় বটগাছ। সেটার গা ঘেঁষে একটা সরু গল্লি ঢুকেছে— সেখানেই আমার ঘর।’
কী অদ্ভুত নাম! মহেশ্বর দণ্ডবত! আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না এখন আমার কী বলা উচিত। ঘাড় লম্বা করে দূরে রাস্তার দিকে তাকালাম। নাহ, অফিসের বাস এখনও মায়া।
‘বোলেন, আপনার খবর বোলেন। ওনেকদিন পর দেখা হল। বাড়ির সবকিছু কুশল-মঙ্গল আছে তো?’
নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। কী জবাব দেব এই প্রশ্নের?
কিন্তু চুপ করে থাকলে ব্যাপারটা আরও বোকা-বোকা হবে। তাই হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ, সব ভালো আছে।’
মনে-মনে আমি এলোমেলো অনেক কিছুই ভাবছিলাম। মহেশ্বর কি শেষ পর্যন্ত আমার কাছে টাকাপয়সা চাইবেন? কী জানি!
এরপর আমার বাড়ি কোনদিকে, কোন রাস্তায়, সেসব তথ্য জানার পর মহেশ্বর ওঁর নিজের গল্প শুরু করলেন।
‘এই তো, এখন নাতির একটা সোয়েটার কিনতে বেরিয়েছি। মাত্র সাড়ে চারবছর বয়স, কিন্তু বেজায় নটখট—সবসময় এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। আমার মেয়ে আর দামাদ তো ওকে নিয়ে একেবারে নাজেহাল। এই এক হপ্তা হল ওরা আমার কাছে থাকতে এসেছে। আমি ভালো-মন্দ বাজার-টাজার করছি। এ ছাড়া দামাদজির একঠো মোটরবাইক কেনার ব্যাপার আছে...’
মহেশ্বর দণ্ডবতের অটোবায়োগ্রাফি শুনতে-শুনতে আমার অফিসের বাস এসে গেল, আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কোনওরকমে ওঁকে ‘আচ্ছা, আজ আসি,’ বলে বিদায় নিলাম।
এরপর থেকে ভোরবেলায় অফিসের বাসের জন্য আমি একটু আনকমন জায়গায় দাঁড়াতাম, যাতে ওঁর সঙ্গে দেখা না হয়। এপাশ-ওপাশ নজর চালিয়ে দেখেও নিতাম, মহেশ্বর কোথাও নেই তো?
এরপর বেশ কিছুদিন ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তারপর হঠাৎই একদিন, সেদিন হাটবার ছিল, ভিড়ের মাঝে ওঁকে দেখতে পেলাম। একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন আমার কাছ থেকে দশ-বারো মিটার তফাতে। ওঁদের দুপাশ দিয়ে লোকজন যাতায়াত করছে।
ঘড়ি দেখলাম। আমার অফিসের বাস আসতে এখনও অনেক দেরি। তা হলে মহেশ্বরের সঙ্গে একটু মজা করলে হয়! যাই, গিয়ে ওঁদের আলাপের মধ্যে ঢুকে পড়ি।
কিন্তু ওঁদের কাছকাছি পৌঁছতেই যে-কথাগুলো আমার কানে এল তাতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
এসব কী বলছেন মহেশ্বর! আমাকে আগেরদিন যেসব কথা উনি বলেছিলেন হুবহু সেই কথাগুলো বলছেন! যেন টিভি সিরিয়ালের রিপিট টেলিকাস্ট চলছে।
‘এই তো, এখন নাতির একটা সোয়েটার কিনতে বেরিয়েছি। মাত্র সাড়ে চারবছর বয়স, কিন্তু বেজায় নটখট...’
আমি চুপচাপ সরে এলাম। অবাক হয়ে মহেশ্বরের ব্যাপারটা ভাবতে লাগলাম। কেসটা কী? মানুষটা কি চিট, না কি পাগল? উহুঁ, চিট নয়, কারণ, তিনি তো টাকাপয়সা চাননি আমার কাছে। আর ওঁকে আমার মোটেও পাগল বলে মনে হয়নি।
এই ধাঁধাটার কোনও উত্তর খুঁজে পেলাম না। কিন্তু প্রশ্নটা মনের ভেতরে খোঁচা মারতে লাগল। এরপর থেকে রোজই ভাবতাম, হঠাৎ করে যদি মহেশ্বর দণ্ডবতকে একা দেখতে পাই তা হলে ওঁকে চেপে ধরব। এই ধাঁধার উত্তর জানতে চাইব। কিন্তু সে-সুযোগ আর হয়নি। দু-দিন ওঁর দেখানো গলিটায় ঢুকে একা-একাই ওঁর আস্তানার খোঁজ করেছি, কিন্তু পাইনি।
শেষে একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে আমার হঠাৎ কেমন গোঁ চাপল। তখন সন্ধে অনেকটা গড়িয়ে গেছে। আকাশে একটা মস্ত বড় সুন্দর চাঁদ।
একটু ঠাহর করে মহেশ্বরের দেখানো গলিটায় ঢুকে পড়লাম। একটু এগিয়ে ওঁর বলা বটগাছটাকে দেখতে পেলাম। তার গোড়াটা বেদির মতো বাঁধানো। ওটার লাগোয়া একটা ছোট্ট কালীমন্দির। তার পাশ দিয়ে ঢুকে গিয়েছে আঁকাবাঁকা একটা সরু গলি। অন্ধকার গলিটায় একটা টিমটিমে বাল্ব জ্বলছে।
গলিতে ঢুকতে ভরসা পেলাম না। বটগাছের বেদিতে একজন বুড়োমানুষ চাদর জড়িয়ে একা বসে ছিল। একটু ইতস্তত করে তাকেই জিজ্ঞেস করলাম মহেশ্বরের কথা।
আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে রইল সে। তারপর ঘষা গলায় বলল, ‘ও, মহেশ্বর! ওর তো মাথার ঠিক নেই। মাস দেড়েক হল ওর জামাই, মেয়ে আর নাতি রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। হাই রোডে ওরা বাইক চালিয়ে আসছিল। ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা। আর ওর বউটা তো আগেই ক্যান্সারে চলে গিয়েছিল। এখন রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে এর-তার সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে। দুঃখ ভোলার চেষ্টা করে। এ ছাড়া আর কী-ই বা করবে বলুন!’
কোনও কথা না বলে চুপচাপ সরে এলাম।
আকাশের চাঁদের দিকে চোখ গেল আবার। চাঁদটাকে আর আগের মতো সুন্দর লাগছিল না।