প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
এটা যে-সময়ের ঘটনা, তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি— কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়। হস্টেলে থাকি। হস্টেল থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে হস্টেল— যাতায়াত লেগেই থাকত লোকাল ট্রেনে। বাড়ি থেকে হস্টেলে ফিরছি সেদিন। সম্ভবত কোনও এক শনিবার ছিল সেটা। সকাল থেকে রাত— দিনের যে কোনও সময় কৃষ্ণনগর-শিয়ালদা লাইনের ট্রেনে ভিড়ের বহর তো সবারই জানা। তাই নামার সময়ের দুর্ভোগ এড়াতে গন্তব্যের বেশ কয়েকটা আগের স্টেশন থেকেই গাদাগাদি ভিড় ঠেলে দরজার কাছাকাছি, বাইরের দিকটায় এগিয়ে এসে দাঁড়াতাম। সেদিনও তা-ই দাঁড়িয়েছি। চাকদার একটা কি দুটো স্টেশন আগে ট্রেনটা থামতেই হঠাৎ দেখি দুই হাতে বড় বড় দুটো ব্যাগ নিয়ে একটা লোক সামনে একটা বাচ্চা ছেলেকে ঠেলেঠুলে কোনওমতে উঠিয়ে দিয়েই ব্যাগসুদ্ধ নিজেও হুড়মুড় করে উঠে পড়ল ট্রেনে। দু’-হাতের বড় বড় ব্যাগ দুটো— যতদূর মনে হল বিস্কুটের প্যাকেটে ভর্তি। চায়ের দোকানে বেকারি বিস্কুট কিংবা টোস্ট বিস্কুট জাতীয় যেসব বিস্কুট পাওয়া যায়, সেই জিনিস। যাই হোক, হাঁপাতে হাঁপাতে কোনওক্রমে উঠেই আমার দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের সুরে লোকটা বলল, ‘ছেলেটাকে এই একটুখানি ধরবেন, দাদা? ব্যাগ-দু’খানা একটু সামলে নিই।’ এসব ক্ষেত্রে না করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আর স্বভাবগতভাবেও আমার বাচ্চাদের ভারী ভালোলাগে। কাজেই নির্দ্বিধায় ছেলেটিকে ধরে রইলাম। মাঝে মাঝে একটু একটু আদর করছি, টিপে দিচ্ছি কচি কচি গাল দুটো, নেড়ে দিচ্ছি ফুরফুরে নরম চুল, ‘নাম কী রে তোর’ কিংবা ‘কোন ক্লাসে পড়িস’— এরকম দুটো-একটা কথাও বলছি থেকে থেকে। ছেলেটাও খুব মিশুকে প্রকৃতির, কথায় কথায় অনায়াসে একদম সহজ হয়ে এল আমার সঙ্গে। আমার গায়ের উপর ভর দিয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে রইল– যেন কতদিনের চেনা!
এদিকে ট্রেন চাকদা ঢুকতে ঢুকতেই লোকটা আমায় বলতে শুরু করল, ‘দাদা, ছেলেটাকে একটুখানি ধরে রাখবেন প্লিজ, আমি স্টেশনে নেমে সামনের চায়ের দোকানে ব্যাগ দুটো জাস্ট দিয়েই চলে আসছি এক মিনিটে।’ বলতে বলতেই স্টেশন এসে পড়ে, আর আমায় ‘হ্যাঁ’ কি ‘না’ বলার সুযোগটুকুও না দিয়ে লোকটা হুড়মুড় করে ব্যাগসুদ্ধ নেমে যায় ট্রেন থেকে। আমি ভাবলাম যাক, ঠিক আছে— ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ ছেলেটাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছি, কথাবার্তা বলছি, আর ছেলেটাও খুব ক্যাজুয়ালি মিশে যাচ্ছে আমার সঙ্গে। সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যাওয়ার ক্ষমতা তার মধ্যে ভরপুর। সেদিক থেকে কোনও সমস্যা নেই।
কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। সেই যে লোকটা গেল তো গেলই, কিছুতেই আর সে উঠে আসছে না! যদিও চাকদা স্টেশনে এই লাইনের লোকাল ট্রেনগুলো বেশ কিছুক্ষণ থামে, তবু সেই সময়টাও তো শেষের পথে— ট্রেন ছেড়ে দেবে আর একটু পরেই! অথচ, আশপাশে লোকটার টিকিটিও নেই। হঠাৎই ভীষণ ভয় পেতে শুরু করি আমি। লোকটা যদি আর না আসে! ছেলেটাকে এইভাবে ছেড়ে রেখে যাওয়াই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তার! কী হবে তখন? ছেলেটাকে নিয়ে তবে কী করব আমি? এইসব হাজারো আশঙ্কা আর দুশ্চিন্তায় মাথা ভারী হয়ে আসে আমার। দরদর করে ঘামতে থাকি। ট্রেনটা যতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, তার প্রতিটা সেকেন্ড, প্রতিটা সেকেন্ডের একেকখানা ভগ্নাংশও এবার আস্তে আস্তে অনন্তকাল দীর্ঘ মনে হতে থাকে। মনে মনে যেন এক রকম বিশ্বাস করেই ফেলেছি যে, লোকটা আর আসবে না। কিন্তু তাহলে বাচ্চাটাকে নিয়ে আমার করণীয়ই বা কী? সবমিলিয়ে ভয়ঙ্কর একটা অস্থিরতা ঘিরে ধরে আমায়। বারবার উঠছি নামছি, এদিকে ওদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি লোকটাকে। স্টেশনের প্রতিটা লোককে তার বর্ণনা দিয়ে পাখিপড়া করে জিজ্ঞেস করছি— কেউ তাকে দেখেছে কি না, আবার ফিরে ফিরে এসে বাচ্চাটাকে দেখে যাচ্ছি যে সে আবার ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে আছে তো! কে একজন বলল, লোকটা নাকি স্টেশনের কালীমন্দিরটার পাশ দিয়ে কোথায় একটা ঢুকে গিয়েছে, আর বেরয়নি। এই কথা শুনে আরও ভয় পেয়ে গেলাম আমি। ওইটুকু সময়ের মধ্যে কত না চিন্তা ঘুরে চলেছে মাথায়। আমায় কি ফাঁসানো হল তাহলে? ইউনিভার্সিটি যাওয়া তো মাথায় উঠেছে, এবার কি তাহলে থানা-পুলিস করতে হবে ছেলেটাকে নিয়ে? নাকি ওকে ট্রেনের মধ্যে রেখেই নেমে পড়ব নিজের মতো? এ কথা ভাবতে আবার বিবেকের দংশন হচ্ছে খুব। হাজার হোক ওই একরত্তি বাচ্চা— মানুষের প্রতি মানুষের একটা নৈতিক দায়িত্বও তো আছে! এইসব সাতপাঁচ হাজারো কথা ভাবতে ভাবতে কেমন যেন দিশাহারা লাগছে আমার। এর মধ্যেই হুইসল বেজে গেল, আস্তে আস্তে নড়তেও শুরু ক’রে দিল ট্রেনটা। ততক্ষণে আমি মোটামুটি নিশ্চিতই হয়ে গিয়েছি যে, বিরাট একটা বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি অলরেডি, আর নিস্তার নেই! আশপাশের সহযাত্রীদের বলতে তারা কেমন একটা সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে আমায়, বিশ্বাস করে না। তারা হয়তো এতক্ষণ এতসব ব্যাপারস্যাপার খেয়ালও করেনি। এদিকে এতকিছুর মধ্যেও বাচ্চা ছেলেটা কিন্তু আশ্চর্যরকম নির্বিকার, একমনে আমার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে– কোনওই হেলদোল নেই তার! জীবনে এইরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় আমি কোনওদিন পড়িনি। কী করব, কোথায় যাব, নেমে পড়ব কি না— কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এদিকে ছেলেটা পরম বিশ্বাসে আমার গায়ে ভর দিয়ে ঠায় এক রকম দাঁড়িয়ে রয়েছে!
তারপর যখন ট্রেনটা আস্তে আস্তে বেশ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে, চলতে শুরু করে দিয়েছে বেশ একটু জোরেই, তখন দেখি সেই লোকটা হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসছে কামরার দিকে। কোনওরকমে হাঁকড়পাঁকড় করে হাতলটা ধরে ট্রেনে উঠে বেশ খানিকটা শ্বাস নিয়ে বলে, ‘দাদা, খুবই দুঃখিত। এইসব মালপত্র দিয়ে টাকাটা বুঝে নিয়ে আসতে আসতে এতটা দেরি হয়ে গেল। কিছু মনে করবেন না। আমরা তো এইভাবেই ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করি। এরকম হুটোপাটা ঝোলাঝুলি করেই আসতে হয় রোজ।’ আমি তো প্রায় চিৎকার করে উঠে বললাম, ‘আপনি মশাই আমাকে কীরকম একটা টেনশনের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন, বলুন তো! কী অবস্থা হয়েছিল জানেন আমার!’ সেই লোকটি ভীষণ লজ্জিত হয়ে বারবার মাপটাপ চায়। তারপর কল্যাণী পর্যন্ত বাদ বাকি পথটা যেন আমায় সে-যাবৎ জীবনের পরমতম প্রশান্তির অনুভূতি দিয়েছিল।
স্টেশনের ওইটুকু সময় আমায় জীবনে প্রথম অভিভাবকত্ব শিখিয়েছিল। অচেনা অজানা ওই বাচ্চা ছেলেটার প্রতি আমি জীবনে প্রথম অভিভাবকসুলভ দায়দায়িত্ব অনুভব করেছিলাম। ছেলেটি বা লোকটির সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি আমার। কিন্তু আজ যখন নিজের এ-যাবৎ জীবনটাকে ফিরে দেখি, তখন বেশ বুঝতে পারি যে বয়ঃজ্যেষ্ঠ অভিভাবকের কর্তব্যবোধ এই ঘটনাটিই প্রথম জাগিয়ে তুলেছিল আমার মধ্যে।