প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
তরুণ লেখক বন্ধুকে আমি ফোন করলাম দুপুর গড়িয়ে এলে। ভাবলাম ফোন কি ধরবে? আমার বয়স হয়েছে। কোভিডের ভয়ে আট মাস নিভৃতযাপন করছি। বাড়ি থেকে বের হই না বড় একটা। হাঁটা হয় বেশ ভোরে, তাও এই ক’দিন। আগে ছাদে আকাশের নীচে হাঁটতাম। সারাদিন করব কী? সকালে কাগজ কলম নিয়ে মানে ল্যাপটপ খুলে বসি। আগডুম বাগডুম লিখি। তারপর স্নান এবং সামান্য ঘুম। ঘুমের আগে ফোন করি হয়তো চন্দননগরের বিশ্বজিৎ কিংবা চাকদহের গৌতম বা আরও পিছিয়ে রানাঘাটের মিলন বা বসিরহাটের অনিলকে। গড়গড়িয়ে কথা বলি। তার ভিতরেই তাদের কেউ হয়তো বলে, গগনদা আমার একটা ফোন আসছে, ফোনটা ধরি। হুঁ, ধরো। জানি ফোন ছাড়াবার ভালো উপায় হচ্ছে, আর একটি ফোন আসছে বলা। কিংবা ক্রমাগত হ্যালো হ্যালো করে যাওয়া। যেন ওদিকের কথা শোনাই যাচ্ছে না। আমার বয়স কম না। বুঝি আমার সঙ্গে তরুণ, অতি তরুণ কথা বলবে কেন? কী কথা বলবে। বুড়ো হলে জ্ঞান দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। আমার জ্ঞান শুনবে কেন তারা? কিন্তু স্বভাব যায় না ম’লে। মধ্যাহ্নের আহারের পর দিবা ঘুমের অভ্যাস আমার নেই। তখন বই নিয়ে বসি। পড়তে পড়তে বেলা গড়ায়, তখন মনে হয় ফোন করি। কথা বলি।
বছরটা একেবারে শূন্য গেল। সেই মার্চের পনেরো কুড়ি থেকে চলছে টানা। বাইশ তারিখে বর্ধমান যাওয়ার কথা ছিল। দোল পূর্ণিমা গেছে কোন তারিখে মনে নেই, অযোধ্যা পাহাড়ে বসন্ত উৎসবের আমন্ত্রণ ছিল। রাতের ট্রেনে রওনা, বরাভূম স্টেশনে নেমে ট্রেকারে চেপে অযোধ্যা পাহাড়। বসন্তোৎসব। যাওয়া হয়নি। তারপর দীর্ঘ গ্রীষ্ম গেল ভয়ের ভিতরে ডুবে। বর্ষা গেল। উম-পুন ঝড় গেল। বর্ষা শেষ হল। ঋতু বদল হতে হতে এখন অঘ্রান মাস। বিবাহের মাস। বন্ধু দেবাঞ্জনের মেয়ের বিয়ে হল। ফোনে জানাল। যাইনি। ভয়ে যায়নি। একা একা দিন কাটছে। ফোন করে দিন কাটছে। প্রতিটি ফোনের পর স্ত্রী বিরক্তি প্রকাশ করে। কেন ওদের বিরক্ত কর তুমি, ওদের তো কাজকম্মো আছে।
—যাদের নেই, তাদের ফোন করি।
—কাদের নেই?
—ইস্কুল খোলেনি, কলেজ খোলেনি, বাড়িতে বসে আছে।
—না বসে নেই, অনলাইন ক্লাস হয়।
—সন্ধ্যায় কি অনলাইন ক্লাস হয়?
উনি, শ্রীমতী চন্দ্রাবতী বলেন, তাদের তো অন্য কাজও আছে, এত ফোন করবে না।
চন্দ্রাবতীর চাপে আমার ফোন করা কমেছে। কিন্তু তিনি যখন পাশের ঘরে টেলিভিশনে সিনেমা কিংবা সিরিয়াল দেখেন আমি কানে হিয়ারিং কর্ড ফিট করে ফোন করি, সুজিত কেমন আছো?
—আছি, ভালো আছি।
—তোমাদের ওখানে করোনার দাপট কেমন?
—কমেছে মনে হয়।
—কী পড়লে?
—আবার বিভূতিভূষণ।
—তোমাদের ডুলং নদী কেমন আছে?
—ভালো আছে, গতকাল নদীর ধারে গিয়ে বসেছিলাম, ওপারে শাল জঙ্গল, আমাদের এখান থেকে সিংভূমের পাহাড় দেখা যায়।
—একবার তোমাদের ওখানে যেতে ইচ্ছে হয়।
সুজিত বলল, আসুন না, করোনা কমুক।
—কী করছ এখন।
—সিনেমা... গগনদা, আমাকে জ্যোতির্ময় ফোন করছে, ফোনটা ধরি।
আমার কী মনে হল, জ্যোতির্ময়কে একটি ফোন করি। জ্যোতির্ময় থাকে বাঁকুড়ায়। দেখি সুজিতকে সে ফোন করেছে কি না। কিন্তু ফোন করতে গিয়েও চুপ করে গেলাম। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমিই সব ফোন করি। আমারও ফোন আসে। পুরনো বন্ধু বহুদিন বাদে ফোন করে। সে বড় একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে। করোনা হয়েছিল। ২১ দিন হাসপাতালে থেকে বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু খুব সাবধানে আছে। করোনা পরবর্তী বিপদ না আসে। বন্ধু সুজন বলল, কে জানে তার হার্ট, লাংস নষ্ট করে দিয়ে গেছে কিনা ভাইরাস। এসব ফোন আমার ভালো লাগে না। সুজনই খবর দিল জিতেন চলে গেছে। সকালে বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিল। হার্ট অ্যাটাক। মন খারাপ লাগল। জিতেন আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিল। পত্র-পত্রিকায় কবিতা লিখত যৌবনে। তারপর ইউনিয়নের ম্যাগাজিনে লিখত। অবসরের পর রিইউনিয়নে গিয়ে কবিতা পড়ে শোনাত। মন সন্ধে থেকেই খারাপ। মনে হচ্ছিল আবার যদি কাউকে ফোন করি, সেও হয়তো কোনও খারাপ খবর দেবে। তাইই তো। চঞ্চল বসু পাড়ার লোক, মর্নিং ওয়াকের সঙ্গী, তাঁর কাছ থেকে খবর পেয়েছি জগন্নাথবাবু মারা গেছেন। কোভিড নেগেটিভ, জ্বর ছাড়ছিল না।
আমি ল্যাপটপে ইউটিউবে সিনেমা দেখি। ‘অপুর সংসার’ দেখছিলাম। বউ এসে বলল, আজ যে ফোন কম!
—সিনেমা দেখছি।
—সিনেমা তো এখন, তার আগে ফোন করনি তো।
চন্দ্রার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, কেউ ফোন ধরছে না বুঝি।
জিতেনের মৃত্যু সংবাদ দিলাম না। জিতেনকে চন্দ্রা চিনত না। হার্ট অ্যাটাক এক অদ্ভুত ঘটনা। এই আছে এই নেই। খবর দিয়ে আসে না। পরদিন বেলা গড়িয়ে আসতে ফোন করলাম শতাব্দকে। শতাব্দ আমেদ। থাকে সোনামুখী। আমি একসময় ওই অঞ্চলে কাটিয়েছি। সেই ৩৫ বছর আগে। শতাব্দর বয়স বছর ২৪। তার মানে আমি যখন ছিলাম ওই গঞ্জে, শতাব্দর জন্ম হয়নি। শতাব্দ গল্প লেখে। মাসখানেক আগে ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল অনেক। বলেছিলাম, ফোন কর না কেন?
—আপনাকে বিরক্ত করব, সেই ভয়ে ফোন করি না স্যার।
—স্যার আবার কী কথা শতাব্দ?
—আমাকে অলীক বসু স্যার বলতে বলেছেন, নাহলে নাকি কলকাতার লোক রাগ করে!
হা হা করে হেসেছিলাম। আমি তোমার সহযাত্রী লেখক শতাব্দ। স্যার বলতে হবে না। তখন শতাব্দ বলেছিল, স্যার মানে মহাশয়, তাহলে কি মহাশয় বলব স্যার?
শতাব্দ রসিক যুবক। গল্প লেখে। ওর গল্প পড়ে আমার ভালোও লেগেছে। এখন নানা জায়গায় ওর লেখা বেরতে শুরু করেছে। ক’দিন আগে বর্ষার আমন ধান রোপণ নিয়ে একটি গল্প লিখেছিল। ঘন মেঘের বিবরণ দিয়েছিল কী ভালো। মেঘ নীচে নেমে এসেছে। চিকুর হানা শুরু হয়ে গেছে। বজ্রপাত হতে পারে। বাপ তার ভিতরে ছেলেকে ধান রোয়ার কাজ শেখাচ্ছে। পড়তে পড়তে মনে পড়ে গিয়েছিল আমার যৌবনকালের কথা। সোনামুখীর সবুজ কৃষিক্ষেত্রের মাথায় ঘন মেঘ। শতাব্দ আমার ফোন ধরল না। মন খারাপ হল আরও। জিতেন আমার সঙ্গে সোনামুখীতেই চাকরি করেছে। সোনামুখীর কথা শুনতেই শতাব্দকে ফোন করা। শিবুদার চায়ের দোকানটি আছে? ন্যারো গেজ ট্রেন এখন ব্রড গেজ হয়ে গেছে। লালমাটি, শাল জঙ্গল। এখন কি পাতা ঝরতে আরম্ভ করেছে শতাব্দ? আমি আর জিতেন পাতা ঝরা শালবনে ঘুরেছি শীতের দিনে। তখন দলমার হাতি নেমে আসত না ওদিকে। এখন হাতির উপদ্রব খুব বেশি। সোনামুখী থেকে বেলিয়াতোড়ে যেতে একটি গ্রামে হেমন্ত দাস বাউল থাকতেন। তাঁর আখড়ায় গিয়ে আমরা দুই বন্ধু গান শুনেছি। শতাব্দ এবং সোনামুখীর কথা মানে মৃত বন্ধুকে স্মরণ করা। ফোন এল। রিং টোন বদলেছি আমি আজই ভোরে। ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে...’ গানটি গায়ে শিহরন নিয়ে এল। ভুলেই গেছি ভোরে এই গান নিয়ে এসেছি জিতেনকে স্মরণ করতে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে খুব পছন্দ করত জিতেন। আমার একটি ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল। ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটে হেমন্তর পঞ্চাশটি গান ভরে জিতেন আমাকে উপহার দিয়েছিল। তার প্রথম গান এই গান। শেষ গানও ছিল এই গান। জিতেন বলেছিল আরম্ভে শুনবি। শেষেও শুনবি। গানটা আমাকে মনে করাবে গগন।
—মহাশয় ফোন করেছিলেন? শতাব্দ জিজ্ঞেস করে।
—আমি না করলে মনে পড়ে না লেখক আমাকে?
—খুব কাজের চাপ মহাশয়।
—কাজ তো চিরকাল আছে, ফোন করা যায় না একটা?
শতাব্দ বলল, বেশি কথা বলি কখন মহাশয়, ধান কাটা হচ্ছে, ভোরে বেরিয়ে যাই, কাটছি, আঁটি বাঁধছি, ঘর আনছি, আব্বার বয়স হয়েছে মহাশয়।
—ধান কাটা চলছে এখন?
—হ্যাঁ মহাশয়, এখন আমার সময় নেই, আমি তো এক ছেলে, বোন আছে এক। সে ছোট। সেও কাজ করে মহাশয়, উঠোন নিকিয়েছে গোবরে, খেজুর পাতার পাটি বুনেছে সে, সেই পাটিতেই ধানের বোঝা রাখছি।
সেই যে বাপ-বেটায় ধান রোয়া করছিল বর্ষার মেঘের নীচে, সেই ধান ঘরে উঠছে। ওদের মজুর নেই। ওদের সে ক্ষমতা নেই, জোয়ান ছেলে নিজেই করছে সব।
—তোমার বাবার বয়স হয়েছে, উনিও কি?
কথা অসমাপ্ত থেকে গেল, শতাব্দ বলল, আব্বু পারে, তবে বেশি পারে না, নিচু হয়ে কোমর বাঁকিয়ে ধান কাটায় কষ্ট কম না।
ধান উঠলে নিশ্চিন্ত। আমি বললাম।
শতাব্দ বলল, মেশিনে ঝাড়তে হবে, কলে নিয়ে গিয়ে ভানতে হবে।
—এখন আর ঢেঁকি নেই না শতাব্দ?
—না, কবে উঠে গেছে ঢেঁকি মহাশয়।
আমি গগন সরকার। কম বয়সে গ্রামে চাকরি করেছি। গ্রাম যা দেখেছি তা লিখেছি। কিন্তু আমি ভাবতে পারছি না শতাব্দ গল্প লেখে আবার ধান কাটে। ধান উঠলে সর্ষে বুনবে। এই এখনই সর্ষে বুনতে শুরু করেছে। আর শীতের সব্জি। বাঁধা কপি, মুলো, পালং...। বুনবে শতাব্দ নিজেই। আব্বু পারে না। বয়স হয়েছে। চাষা খাটতে খাটতে তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যায় মহাশয়। আমি বললাম, লিখছ।
—সারাদিন এইসব করে সন্ধের পর শরীর আর নেয় না মহাশয়।
তাহলে? জিজ্ঞেস করলাম উদ্বিগ্ন হয়ে।
—লিখতে সময় পাচ্ছি না, অথচ লেখা মাথায় এসে গেছে।
—তাহলে লিখতে তো হবে।
হ্যাঁ মহাশয়, লিখতে হবে, না লিখলে হবে না। শতাব্দ বলল।
—তাহলে লিখে ফেল।
—না লিখতে পেরে খুব কষ্ট হচ্ছে, লেখা এসে গেছে, কিন্তু সময় নাই।
তোমায় একটা সময় বের করতে হবে। বললাম।
শতাব্দ বলল, মহাশয়, একটা গল্প মাথায় ঘুরছে খুব, এদিকে ধান কাটা লাগল, শীতের চাষ লাগল, দিল্লি তো যাব না, দিল্লির দিকে চাষিরা হাঁটছে, কতকাল ধরে চাষিদের সব্বোনাশ হয়ে যাচ্ছে, আরও সব্বোনাশ সামনে, চাষি গলায় দড়ি দিচ্ছে ফসলের দাম না পেয়ে,... গল্প এসে গেছে, আমি তো চাষি, মহাশয়, মিছিলে নাই বলে লিখতে পারব না! মহাশয়, আমি বলতে পারব না— পরের দিন লিখব, চাষ পরের দিন হয় না। শিবরাম এমন বলেছিলেন না, পরের দিন লেখেন।
হ্যাঁ, ঠাট্টা করে, আলিস্যি করে, কিন্তু এই গল্প দিনের দিন না লিখলে হবে না, আমি বললাম।
তারপর আমি আর শতাব্দ আলোচনা করতে লাগলাম কখন লেখা যায়। দিনের দিনেই। সন্ধেতে ঘুম আসে। ঘুমিয়ে নাও, তারপর ঘণ্টা খানেক বাদে উঠে পড়।
শতাব্দ বলে, ভাবতে হবে মহাশয়, আপনি বলুন, বলুন না, কিছু পরামর্শ দিন। আমি আর শতাব্দ আলাপ করতে লাগলাম, সারাদিনের খাটনির পর যে ঘুমটি আসে, সেই ঘুম ছাড়িয়ে উঠবে কী করে এই লেখক। লেখক ধান কাটেন। লেখক বীজ বোনেন। লেখক লেখেন। লেখাও তো বীজ বোনা, পরের দিনের কথা ভেব না শতাব্দ, চাষ পরের দিন হয় না। আচ্ছা লেখক, সোনামুখীর শিবুদার চায়ের দোকান চেনো?
কে বটে? শতাব্দ বলে, আপনার আমলের কেউ নাই মহাশয়।
জিতেনের কথাটি আমি বলতে পারলাম না শতাব্দকে। ফোন নীরব হল আবার বেজে ওঠার জন্য। আমার কত সময়। কিন্তু আমার দিন যায় পরের দিন নয়, আগের দিনের কথা ভেবে। সে আমলের কথা ভেবে।