প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
প্রতিটি বিশ্বাস হারানোর সময়ে মস্তিষ্ক অতীতের কিছু সত্য গল্প মনে করিয়ে দেয়। তেমনই একটি সত্য সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি। নাহলে মানুষের উপর থেকে সব বিশ্বাস হারিয়ে যেত হয়তো!
২০০৬! সাহিত্য অ্যাকাডেমি থেকে তরুণ সাহিত্যিকের উল্লেখযোগ্য কাজের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছি ট্রাভেল গ্রান্ট! যে কোনও একটি রাজ্য ভ্রমণ ও সেখানকার শিল্প সাহিত্য বিষয় জানা ও দেখার জন্য, পারস্পরিক সংস্কৃতি বিনিময়ের জন্য মূলত এই গ্রান্ট।
আমি মহারাষ্ট্র নির্বাচন করেছিলাম। বিশেষত মুম্বইয়ের নাট্যচর্চা, নাটক নিয়ে কৌতূহলী তাই এই নির্বাচন।
যাইহোক, এই প্রথম একলা ভ্রমণ। তাই উত্তেজনা প্রবল। গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে চেপে ছত্রিশ ঘণ্টা পার করে পৌঁছেছি স্বপ্নের শহরে। সাহিত্য অ্যাকাডেমির গেস্ট হাউসে থাকব তা নির্ধারিত ছিল। অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি মিস্টার ভাটমব্রেকার নির্দিষ্ট সময়ে রিসিভ করলেন। তিনদিন বম্বের আনাচকানাচ ঘুরে কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় সেরে এবং তাঁদের আতিথেয়তা গ্রহণ করে মুগ্ধ। মুগ্ধ আরবসাগরের অসাধারণ সৌন্দর্য দেখে। যে কলকাতা রাত ন’টার পর কার্যত ঘুমিয়ে পড়ে সেই কলকাতার মেয়ে হিসাবে চরম মুগ্ধ মুম্বইয়ের রাতের জীবন দেখে। কী নির্ভয়ে মধ্যরাতে মুম্বইবাসী জীবন উপভোগ করছে সমুদ্রের তীরে! এও এক অভিজ্ঞতা।
‘অজন্তা-ইলোরা ঘুরে এসো, যাও’, মিস্টার ভাটমব্রেকার বলতেই লাফিয়ে উঠেছি। অফিস থেকেই ওভার নাইট জার্নির বাসের টিকিট রিজার্ভ করে দিল সঙ্গে হোটেল বুকিং। যাত্রার দিনে অফিস সহকারী ভদ্রমহিলা বাসে তুলে দিলেন, জানিয়ে দিলেন ঠিক কোথায় আমাকে নামতে হবে। সেখানেই আমার জন্য অপেক্ষা করবে হোটেলের গাড়ি।
উত্তেজনা চূড়ান্ত, তাই সারারাত নির্ঘুম। হাঁ করে গিলে খাচ্ছি দু’পাশের সৌন্দর্য। শেষ রাতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। যখন ঘুম ভাঙল তাকিয়ে দেখলাম আমার আশপাশে কোনও যাত্রী নেই বাসে! বাসে একমাত্র যাত্রী আমি আর দু’জন কনডাক্টর ও ড্রাইভার সাহেব! সময়কাল ডিসেম্বর। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা এবং ঘুটঘুটে অন্ধকার চারপাশ! হাইওয়ে ধরে বাস ছুটছে! হঠাৎ আশ্চর্য এক শক্তি পেয়েছিলাম যেন! একটুও ভয় না পেয়ে ড্রাইভার সাহেবকে আমার গন্তব্যস্থল এসে গিয়েছে কি না জিজ্ঞেস করতে উনি অবাক হয়ে বললেন, ‘সে তো কখন চলে গিয়েছে!’
আমি আমার অতি দুর্বল হিন্দিতে বললাম, ‘আমার তো ওখানে নামার কথা ছিল। গাড়ি আসবে হোটেলে নিয়ে যেতে?’
কনডাক্টর দু’জন ও ড্রাইভার সাহেব নিজেদের মধ্যে মারাঠি ভাষায় কিছু আলোচনা করলেন। আমাকে বললেন, ‘ভয় পাবেন না। বাস আরেকটু পর ইউটার্ন নিয়ে ওই জায়গাতেই যাবে। আপনাকে নামিয়ে দেব।’
বাস চলছে হাইওয়ের নির্জন রাস্তা ধরে। দু’পাশে কুয়াশার অতি ঘন আস্তরণ ছাড়া কিছু নেই। জনমানবহীন! একটু বুঝি ভয় পেলাম এবার। অনেকদূর এসেও ইউটার্ন নিচ্ছে না দেখে। কণ্ঠস্বরে সাহস এনে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কতদূর?’
ড্রাইভার সাহেব বললেন, ‘আগের মোড় থেকেই নেব। আপ ডরিয়ে মত।’
একটু পরে সত্যিই ইউটার্ন নিয়ে আবার চলছে তো চলছেই বাস! খুব বেশি বিপদের মধ্যে পড়েছি বুঝলে বোধহয় ভয়ডরহীন হয়ে যায় মানুষ, অন্তত আমার তাই হয়েছিল। আরও কিছুক্ষণ যাবার পর জানলা থেকে দেখতে পেলাম অনতিদূরেই অনেক বাস দাঁড়িয়ে সারি সারি! এবং বেশ কিছু লোকজন!
আমাদের বাস থামতেই ড্রাইভার সাহেব কন্ডাকটররা আগে নেমে উপস্থিত ড্রাইভার, কনডাক্টর, হেল্পার মেকানিক শ্রেণীর লোকজনদের কিছু বললেন। বাস থেকে আমি নেমে আসতেই সবাই উত্তেজিত। একজন জিজ্ঞেস করল আমার কাছে কারওর কনট্যাক্ট নম্বর আছে কি না।
হোটেলের নম্বর এবং মিস্টার ভাটমব্রেকারের নম্বর দিতে ছেলেটি পাশেই একটি ঝুপড়ির মধ্যে এসটিডি বুথে ঢুকে ফোন করতে চলে গেল। আমার মোবাইলে চার্জ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে! হঠাৎ হাইওয়ের কালভার্ট পেরিয়ে একটি ছেলে আরেকটি ছেলেকে টানতে টানতে নিয়ে এসে বলল, ম্যাডাম, এই আপনার গাড়ির ড্রাইভার। ক্লাসিক হোটেলের গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই গাড়িতেই আপনি হোটেলে যাবেন।
অন্যরা তখন ওই ড্রাইভার ছেলেটিকে বকাবকি শুরু করে দিয়েছে, যে কেন ছেলেটি বাস থামায়নি যখন জানত এই বাসেই গেস্ট আসছে! প্যাসেঞ্জার তো ভুলে যেতেই পারে। কিন্তু ছেলেটির দায়িত্ব ছিল বাস থামিয়ে খোঁজ করার যে এই নামে তাদের গেস্ট আসার কথা এই বাসে!
তখনও আলো ফোটেনি ভোরের। হোটেলের গাড়িতে উঠলাম। অন্তত ষাট সত্তরজন যাদের আমাদের শ্রেণীতে স্থান দিতে কুণ্ঠা করি, তারা হাত নেড়ে সাবধানে যেতে বলে বিদায় জানাল।
ওই ভোররাতে অচেনা, নির্জন পরিবেশে একলা মেয়ে আমি নিরাপদে ফিরে এসেছিলাম জীবনে। অনেককিছু হতে পারত! কিন্তু প্রমাণ হল সকলেই মনুষ্যত্ব হারাননি।
মানুষের উপর যখন বিশ্বাস হারাই, তখন সেই রাতের কথা মনে করি। চলার পথে একলা ভ্রমণ মানুষকে অনেক কিছু শেখায়।