প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
সবচেয়ে করুণ অবস্থা সিপিএমের। বামফ্রন্ট একা কিছু করতে পারবে না, সেটা তারা জানে। তাই ফের কংগ্রেসকে সঙ্গে পাওয়ার জন্য অনেক দিন ধরেই সাধ্য-সাধনা করছিলেন সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুরা। প্রদেশ কংগ্রেসের বেশিরভাগ নেতারও তাতে আপত্তি ছিল না। কর্মী-সমর্থকদের চাওয়া-পাওয়ার ধার তারা কোনওদিনই ধারেননি। তবু হ্যাঁ, না—কোনওটাই বলছিলেন না প্রদেশ নেতারা। ঝুলিয়ে রেখেছিলেন অনেক দিন। হাইকমান্ডের হুকুমের দিকে তাকিয়ে। কারণ প্রদেশ নেতৃত্ব কী চায়, সেটা আবার হাইকমান্ড নামক রুগ্ন রাজবাড়ি তোয়াক্কা করে না। দিন কয়েক আগে সোনিয়া গান্ধীর মর্জির কথা রাহুলের কানে যায়। সেটা তিনি অধীর চৌধুরীকে রিলে করেন। অধীরও ঘোষণা করে দিলেন, ‘জোট হচ্ছে।’ হাত-এ ভোট দেওয়ার ‘অপরাধে’ একসময় যারা নিরীহ ভোটারের হাত পাঞ্জা থেকে কেটে নিয়েছিল, সেই দলের সঙ্গেই। আর যায় কোথায়! সিপিএম নেতারা আহ্লাদে আটখানা। যাক বাবা, সোনিয়া-রাহুল বাঁচালেন। এবার যৌথ আন্দোলন কর্মসূচিটুচি শুরু করা যাবে।
কিন্তু আসন রফার কী হবে? বেলা বয়ে যায়। সিপিএম চটজলদি আলোচনা চায়। অমনি অধীরপন্থী কংগ্রেসিরা দাবি ভাসিয়ে দিলেন, অধীরকেই জোটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রোজেক্ট করতে হবে। তা না-হলে জোট তো শুরুতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে পিছিয়ে যাবে। কেননা, তৃণমূলের যত সমস্যাই থাক, মুখ্যমন্ত্রীর মুখ নিয়ে কোনও সমস্যা তাদের নেই। এমনকী বিজেপির মতো দাপুটে দলেরও আপাতত মূল মুসিবত হল মুখ্যমন্ত্রীর মুখ। সেই বিচারে জোট, বিজেপির থেকে এগিয়ে থাকবে এবং অন্তত এই একটা ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সমকক্ষ’ বলেও ভোটারদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে তারা। যাই হোক, সাধের জোটসঙ্গীর এহেন আবদারে সূর্যকান্ত মিশ্র-বিমান বসুরা প্রমাদ গুনলেন। অস্বস্তিতে পড়েছেন, বেশ বিরক্তও যে, তাও তাঁরা বুঝিয়ে দিলেন মিডিয়ায় বিবৃতি দিয়ে।
ভোট বড় বালাই। আলিমুদ্দিনের কর্তারা অনেক তৈলমর্দন করে অবশেষে রবিবার কংগ্রেস নেতাদের বৈঠকে বসালেন। তাতেও কী বিড়ম্বনা—যে কংগ্রেস ২০১৬-য় ৯২টা আসনে লড়েছিল, সেই তারাই এবার চেয়ে বসল ১৩০টা! বিহার ভোটে ‘দারুণ’ ফল করার সুবাদে বামেরা যখন পুনর্যৌবন অনুভব করছে, তখন পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের এই আবদার খানিকটা আস্ফালন হয়ে যাচ্ছে না কি? ২৯৪ থেকে কংগ্রেসকে যদি ১৩০ দিতে হয় তবে, বামফ্রন্ট শরিকদের কী দেওয়া হবে? জোটে যদি আরও কিছু দল ঢোকে, তাদের জন্য কী পড়ে থাকবে? আসলে সবটাই প্রেশার পলিটিক্স। ‘পুওর থার্ড’ হওয়ার স্বপ্নে মশগুল কংগ্রেস এবং সিপিএম। জোট করে ২০১৬-য় কংগ্রেস ৪৪টা এবং সিপিএম ২৬টা আসন পেয়েছিল। একা লড়ে বিজেপি পেয়েছিল ৩টে। পৃথিবী উল্টে না-গেলে এবার লড়াইটা হতে চলেছে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। উল্লেখযোগ্য বাকিদের মধ্যে কংগ্রেস ও সিপিএমের লড়াইটা সিম্পলি থার্ড পজিশনটা দখলের। তার জন্যই এই চাপ সৃষ্টির কৌশল।
অন্যদিকে, বিজেপিও প্রেশার পলিটিক্স করছে অন্য কায়দায়। অমিত শাহ এবং জে পি নাড্ডা চাপে রাখতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাঁরা চান বাংলার নেত্রীকে নার্ভাস করে দিতে। নার্ভের লড়াইয়ের মাধ্যমে শেষ হাসি হাসার প্ল্যান করেছেন মোদিজির ডান হাত, বাম হাত। বছর পয়লা স্বয়ং অমিত শাহ ‘নীলবাড়ি’ দখলের টার্গেট বেঁধে দিয়েছেন। কমপক্ষে ২০০ আসন চান। পার্টির ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্টের ভিত্তিতেই নাকি পদ্ম শিবির এতটা আশাবাদী। ২০১৯ লোকসভা ভোটের আগে শাহ বাংলার জন্য টার্গেট দিয়েছিলেন ২২। দিলীপ ঘোষরা হতাশ করেননি। ১৮টা কেন্দ্রে তাঁরা পদ্ম ফুটিয়ে ছেড়েছিলেন। ওই ভোটের নিরিখে ১২১টা বিধানসভা আসনে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে।
দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের ‘কার্যকর্তারা’ ধরে নিচ্ছেন, লোকসভা ইলেকশনের সময় বাংলায় বিজেপির যে ভিত তৈরি হয়ে গিয়েছে সেটা অটুট রয়েছে; ওইসঙ্গে গত দেড় বছরে আরও কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। নবান্ন দখলের ‘ম্যাজিক ফিগার’ হল ১৪৮। কিন্তু লাস্ট ল্যাপ পেরবার মতো ঠ্যাঙের জোর কি হয়েছে বিজেপির? এই প্রশ্নই তাড়া করে ফিরছে মোদি বাহিনীকে। রাজ্য বিজেপিকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেও হয়তো ভরসা হচ্ছে না তাদের। অতএব শেষ কৌশল প্রেশার পলিটিক্স।
প্রথমেই বাংলার মানুষকে শাহ খাওয়াবার চেষ্টা করলেন, ‘আমরা অন্তত ২০০’ আসন নিয়ে আসছি! মানে, ন্যূনতম প্রয়োজনের চেয়ে ঢের বেশি পাচ্ছি। কে না জানে এই হিউম্যান সাইকোলজি—‘জয়, মামার জয়’ বলতে পারার অধিক তৃপ্তি কোনও কিছুতেই খুঁজে পায় না মানুষ। ভূমিষ্ঠ হওয়াটাই একটা যুদ্ধ। ওই যুদ্ধজয়ের পর থেকেই মানুষকে নিত্য আরও অগুনতি ভয়ানক যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে এগতে হয়। সবাই জেতার জন্যই যুদ্ধ করে। কিন্তু জয় ক’জন আর পায়, ক’টা ক্ষেত্রে পায়? সীমাহীন দারিদ্র্য আর অকালমৃত্যুর মিছিলেই এর উত্তর নিহিত। তাই দুঃখী মানুষ তৃপ্তি খুঁজতে, সামনে আসা যে-কোনও জয়ের অংশীদার হতে চায়। তাতে বস্তুগত লাভ নাই-বা হল, ‘জয়ের অংশীদার আমি’—এই বোধটাই মানুষকে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। বিজেপি হাতিয়ার করতে চায় এই মনস্তত্ত্বকে।
প্রথমে শুরু করেছিল কয়েকটা সেন্ট্রাল এজেন্সিকে দিয়ে কিছু তৃণমূল নেতার শ্রীঘরবাসের ব্যবস্থা। তারপর পাড়ায় পাড়ায় পায়ে পা বাধিয়ে বিবাদ-সংঘর্ষ। ছোট ছোট জনসভা। ক্রমে আমদানি করল দলিত বাড়িতে অন্নগ্রহণের ‘উদারতা’। অতঃপর দিল্লি থেকে একের পর এক নেতাকে এনে সভা করে ‘সমর্থক’ জড়ো করার কম্পিটিশনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা। দলবদলে উৎসাহ দেওয়া এবং কতকাংশে হয়তো বাধ্যও করা। দেড় বছর যাবৎ রাজ্যপাল জগদীপ ধনকরকে নজিরবিহীনভাবে ব্যবহার করা। একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদকে লাগাতার দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেই নিন্দার ঝড় বইছে। তবু কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্যপাল যেন নির্বিকার। এমনকী মাঝেমধ্যে ৩৫৬ ধারারও ভয় দেখানো হচ্ছে মমতার সরকারকে।
এসবের মধ্য দিয়ে মোদির পার্টি যখন ‘দিগ্বিজয়ের’ ব্যাপারে অনেকখানি আশাবাদী, তখনই বাংলার আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ২০০ আসন জয়ের ফানুস। ব্যাপারটাকে আরও এস্টাবলিশ করার জন্য ‘ভাবী মুখ্যমন্ত্রী’র অফিস (সিএমও) গোছানোরও একটা নকশা বাজারে ছেড়ে দিয়েছে তারা। তাদের তরফে দাবি করা হয়েছে, ২০১৪ সালে প্রথম মোদি সরকার গঠনের আগেও নাকি প্রধানমন্ত্রীর অফিস (পিএমও) গঠনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে রেখেছিল বিজেপি। এবার আরও শুরু হয়ে গিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে সামনে রেখে নবান্নের উপর নানাভাবে চাপসৃষ্টি। যেমন নিয়মিত আইনশৃঙ্খলার রিপোর্ট দাবি। রাজ্যের সিইও দপ্তরের উপর কমিশনের কড়া নজরদারি। এমনকী ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ব্যবহারে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণই কায়েম করতে চায় বিজেপি। তাই রাজ্যকে একটা ‘মউ’ স্বাক্ষর করার জন্য বিস্ময়কর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে।
এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর মুখ নিয়েও যে বিজেপি আর বিপাকে নেই—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগঠনের গোত্রে উঠে এসেছে—সেটা বুঝিয়ে দিতেই হয়তো সম্প্রতি এক নাটক করেছে তারা। বিজেপির এক এমপি দলের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দিলীপ ঘোষের নাম ঘোষণা করে বসেছেন। যদিও তা নিয়ে প্রত্যাশিত ‘ভর্ৎসনা’র কৌশলও আমরা দেখেছি। ভোটের মুখে পাল্টিবাজদের নিয়েও বিজেপির ভিতরে জোর অশান্তি চলছে। বিজেপি নেতৃত্ব ভাবছে, নাটক আর প্রেশার পলিটিক্স দিয়েই হাঁড়ির হাল মেরামত করে ফেলবে। কিন্তু মাস্টার স্ট্রোকের পলিটিক্সে আজও যিনি অদ্বিতীয় সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বুঝিয়ে দিয়েছেন, নন্দীগ্রাম ভাঙিয়ে একটি পরিবারের রাজনীতিকে আর একপাও এগতে দেবেন না তিনি। সেখান থেকে তৃণমূলের প্রার্থী জননেত্রীই স্বয়ং।
২০১৬ সালে তৃণমূল ২১১টা আসনে জিতেছিল। ১৭ জানুয়ারি অনুব্রত মণ্ডল তারাপীঠে পুজো দিয়ে মায়ের কাছে দলের জন্য ২২০টা আসন জয়ের আবেদন করেছেন। অনুব্রতর দাবি, মা সেটা মঞ্জুর করেছেন। ২০১৬-তে চেয়েছিলেন ২১০-২২০টা, মা দিয়েছিলেন ২১১।
নার্ভের এই লড়াই আগামিদিনে আরও আকর্ষণীয় হতে চলেছে (শুধু রক্তপাত/অশান্তি না-হলেই চলবে)। আমাদের নজর সেদিকেই থাক।