প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
ট্রাম্প সাহেবের মতো মোদিজিও সারাক্ষণ গণতন্ত্রের কথা বলেন, কিন্তু মানেন কতটুকু? যদি মানতেন, তবে দেশের মানুষের আজ এই দুর্দশা হতো না। তবে সবকিছু যে তিনি তালি মেরে উড়িয়ে দিতে পারবেন না, তা বুঝিয়ে দিয়েছে দেশের কৃষক আন্দোলন। কৃষকদের আন্দোলনে শামিল ট্রাক্টরের চাকায় ধূলিসাৎ মোদিজির সম্ভ্রম। কিছুতেই তিনি কৃষকদের কিনে ফেলতে পারছেন না। কৃষকরা আর যাই হোন, এদেশের রাজনৈতিক নেতা নন। যাঁদের অনেককেই কথায় কথায় কিনে নেওয়া যায়। সম্মানের প্রশ্নটিকে বড় না করে মোদিজি যদি কৃষকদের দাবি মেনে নেন, তবে দেশের মঙ্গল, দশের মানুষের মঙ্গল, কৃষকদের মঙ্গল, তাঁর পার্টিরও মঙ্গল। সেক্ষেত্রে মোদিজির কর্পোরেট এবং শিল্পপতি বন্ধুরা অবশ্য চটে যাবেন। তাঁদের ছক বানচাল হলে পার্টি ফান্ডে টাকা আসার স্রোত কমে যাবে, পিএম কেয়ার্স ফান্ডের মতো রহস্যজনক ফান্ডেও আমদানি কমে যাবে। সুতরাং তাঁর কাছে এখন অন্নদাতাদের সমস্যা তেমন ধর্তব্যের বিষয় নয়। তার থেকে বড় চ্যালেঞ্জ পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে মমতাকে কায়দা করে হারিয়ে রাজ্যটাকে দখল করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখলের বাসনার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। যে কোনও দলই ক্ষমতা চায়। কিন্তু প্রশ্নটা অন্যত্র। বিজেপি এরাজ্যের তৃণমূল, সিপিএম বা কংগ্রেসের মতো একেবারেই নয়। তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতি মেলে না। মেলে না তার কারণ এখানে বিজেপি ভুঁইফোড়। বাংলার জল-মাটির সঙ্গে এই বিজেপি বেড়ে ওঠেনি। এই বিজেপি বাংলায় নতুন আমদানি। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, এসবের সঙ্গে বিজেপির ডিএনএ মেলে না।
বিজেপি ভোটের ময়দানে নেমেই বিভেদের উপর জোর দিয়েছে। হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি বিভেদে কীভাবে ভোটবাক্সে ফায়দা তোলা যায়, তার নকশা তৈরি হচ্ছে। এই রাজ্যের কয়েকটি স্টেশনে টিকিট কাটতে গিয়ে বাংলায় কথা বলে টিকিট চাইলে কাউন্টারে বসা অবাঙালি কর্মী ‘বাংলাদেশি’ বলে বিদ্রুপ করছে। এটা ওই কর্মীর দোষ নয়। আসলে তার মনের মধ্যে বিভেদের ওই বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেটা আগে ছিল না। অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন কি তবে একদিন মিথ্যে হয়ে যাবে? ভারত কি তবে শুধুই হিন্দুদের? আর কারও নয়? বিজেপি জানে, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করতে না পারলে তাদের সিএএ-এনআরসি সব ব্যর্থ হয়ে যাবে। সারা দেশে একজন ব্যক্তিত্বই তাঁদের সব ভুলভাল কাজকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লড়াই জারি রাখতে পারেন। তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপির কাছে মমতা নামটাই জুজুর মতো। তাই যে কোনও প্রকারে তাঁকে সরাতে পারলেই অর্ধেক যুদ্ধজয় হয়ে যাবে বলে মনে করছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে জয় পেলেই তারা ভীমরবে নেমে পড়বে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে। তখন কি তবে বাঙালিদের ধরে ধরে ‘বাংলাদেশি’ ছাপ্পা মারা হবে? ভবিতব্যই জানে। তবে শেষ চেষ্টা হয়তো বিজেপির সফল হবে না। মানুষ অনেক সচেতন। ঘরপোড়া গোরু গেরুয়া মেঘ দেখলে ভয় পায়।
তাই মনে হয়,ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে কোনও রাজনৈতিক মেরুকরণ এবার হবে না। অনেকেই ধর্মের ভিত্তিতে, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোট করতে চাইছেন। বিজেপি এব্যাপারে জোড়া ফলা নিয়ে মমতার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাচ্ছে। এক ফলা তার আরএসএসের হিন্দুপ্রীতি। যে শক্তির বলে তারা হিন্দু ভোটারদের আবেগকে সম্বল করে ভোটবাক্সে ঝড় তুলতে চাইছে। আর একটি ফলা হল আসাদউদ্দিন ওয়াইসির মিম। মিমের মতো কাগুজে বাঘকে হেভি পাম্প দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নামিয়েছে বিজেপি। তবে আসরে নেমেই মিম বুঝেছে, হায়দরাবাদ, বিহার কিংবা উত্তরপ্রদেশের মুসলিমদের সঙ্গে এ রাজ্যের মুসলিমদের ফারাক আছে। এরাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায় বিশেষ করে বাঙালি মুসলিমরা অনেক বেশি শিক্ষিত, আধুনিকমনস্ক এবং সচেতন। পরের মুখে ঝাল খেয়ে তাঁরা রাতারাতি ভোলবদল করবেন না। মমতার রাজত্বে এখানে তাঁরা শান্তির বাতাবরণে বাস করছেন, অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের পরিবেশ এখানে কিন্তু কখনও গড়ে ওঠেনি। এই রাজ্যের মুসলিমদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলে দেখেছি, তাঁরা কেউ চান না, এই রাজ্যে গোধরার মতো একটা কাণ্ড হোক।
বিজেপি এখানে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য যত মমতাকে আক্রমণ করবে, ততই মানুষ মমতার পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন। কেননা মানুষ বুঝেছেন, মমতা মানে ভরসার একটা আশ্রয়। একবার ভাবুন তো! লকডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। কলকারখানা সব বন্ধ। মোদি সরকার থালা-বাটি বাজিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। বাংলার ঘরে ঘরে দরিদ্র মানুষের হাহাকার। ঘরের লক্ষ্মী যিনি, তিনি জানেন না, কী খেতে দেবেন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের, তাঁর স্বামীকে। ঘরের মেয়েরাই জানে, একমুঠো চাল ঘরে না থাকলে কী তার যন্ত্রণা। সেই সময় রাজ্য সরকারের বিনামূল্যে চাল মানুষকে অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাল। সেই সঙ্গে জুটল ছেলেমেয়ের স্কুল থেকে পাওয়া আলু, ডাল, ছোলা, সাবান, স্যানিটাইজার, মাস্ক।
লকডাউনে ভিন রাজ্যে আটকে পড়েছিলেন এ রাজ্যের বহু শ্রমিক। শত শত মাইল হেঁটে তাঁরা বাড়ি ফিরেছেন। অনেকে পথেই মারা গিয়েছেন। তাতেও লজ্জা কিংবা অনুশোচনায় কেঁপে ওঠেনি মোদিজির ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতি। মমতা সেই সময় বহু শ্রমিককে ভিন রাজ্য থেকে আনার ব্যবস্থা করে তাঁদের ঘরে ফিরিয়ে দিয়েছেন। মায়ের কোলে সন্তান, স্ত্রীর কাছে স্বামী, সন্তানদের কাছে বাবাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন মমতা। সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের রোজগারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জব কার্ড দিয়ে, ব্যবসার জন্য ঋণ দিয়ে তাঁদের থিতু করার চেষ্টা করেছেন। মনে হতে পারে সেটা হয়তো বিরাট কিছু নয়। কিন্তু তৃষ্ণার্ত মানুষের কাছে এক আঁচলা জলও জীবন সমান।
পাশাপাশি ঘরের মেয়েদের তিনি টেনে নিয়ে এসেছেন কাজের আঙিনায়। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে মেয়েদের হাতের কাজ বহু পরিবারকে বাঁচিয়েছে। মাস্ক, স্যানিটাইজার বানিয়ে সেই সময় মাসের শেষে পাঁচ-ছশো টাকা হাতে পাওয়াও যেন এক মুঠো জীবনদায়ী অক্সিজেনের মতো। উঁচু মসনদে বসে যদি নিচুতলার মানুষের কথা ভাবা না যায়, তবে দূরত্ব তৈরি হয়। সেই দূরত্ব বিপন্ন সময়ে মমতা হতে দেননি। মেয়েদের হাঁস-মুরগি পালনের মধ্য দিয়ে, ফলের বাগান তৈরির মধ্য দিয়ে, পুকুরে মাছ চাষ করার মধ্য দিয়ে তিনি চেষ্টা করেছিলেন মানুষের হাতে নগদ পয়সা পৌঁছে দিতে। ক্রয় বিক্রয়ের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে না পারলে ভরাডুবি হবেই। সেই অবস্থা হয়েছে দেশের অর্থনীতির। জিডিপির গঙ্গাযাত্রা করে ছেড়েছে মোদি সরকার।
উম-পুনের বিপদের সময় ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষকে সাহায্য করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, দুর্নীতি হয়েছে। অনেক নেতাই উম-পুনের বা অন্যান্য টাকা থেকে কাটমানি খেয়েছেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই আবার ‘চোর চোর’ আওয়াজ তুলে দৌড়ে গেরুয়া শিবিরে ঢুকে পড়েছেন। এখন ইমান-ধর্ম, কৃতজ্ঞতা ভুলে মমতাকে তেড়ে গালাগাল করছেন। অনেক আদি বিজেপি নেতার থেকে এঁরা বেশি গালাগাল করে বিজেপির প্রতি তাঁদের বিশুদ্ধ আনুগত্য প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। টিকিট চাই গো টিকিট! মমতাকে পেড়ে ফেলতে না পারলে যে গেরুয়া দল টিকিট দেবে না। এও এক দাসকৃত্য।
কিন্তু বহু রাজনৈতিক নেতা যেমন অকৃতজ্ঞ, সাধারণ মানুষ তেমন নন। তাই কৃতজ্ঞ মানুষ, বিশেষ করে এরাজ্যের মেয়েরা এবার ঢেলে ভোট দেবেন মমতাকে। বেশ কয়েকটি জেলায় বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, এ রাজ্যের মেয়েদের একটাই প্রতীক। এই রাজ্যের মেয়েদের সামনে একটা মুখ, সেই মুখ মমতার। তাই বলাই যায়, এবার ধর্ম,সম্প্রদায় বা ভাষাভাষীর ভিত্তিতে যতই ভোট ভাগের চেষ্টা হোক না কেন, মেয়েদের ভোট মমতার পক্ষেই।