প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
দলবদল—রাজ্য রাজনীতির গত দশ বছরের নতুন সংযোজন ২০১১ সালে বাংলায় রাজ্যপাটের পালাবদল ঘটেছে। বামবিরোধী শক্তি সমূহের সমাহার তখন। সিঙ্গুরসহ নানান আন্দোলনে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে তখন অতি ডান, অতি বাম অনেকেই। বিজেপি নেতাদের প্রত্যক্ষ সাহচর্য নিয়েই পূর্ববতী—বস্তুত একটা মহাজোট। রামধনু জোট। ভোটের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৈরি হল তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেসের জোট সরকার। তৃণমূল তখন কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের শরিক। এক বছর পার হতে না হতেই কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সরে আসল তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্য সরকার থেকে সরে গেল জাতীয় কংগ্রেস। দল ভাঙানো শুরু করল তৃণমূল কংগ্রেস। প্রথম দফাতেই সতেরো জন কংগ্রেস এবং ছয়জন বাম বিধায়ক। দলত্যাগ বিরোধী আইন কার্যকর করা হল না কারও বিরুদ্ধে। যে কংগ্রেসকে সঙ্গে করে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারে আসল, সেই কংগ্রেস দলটাকেই ভাঙাবার প্রবল প্রচেষ্টা চলল। উপনির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরেও কংগ্রেসের দু’জন দলত্যাগীকে মন্ত্রী পদে বহাল রাখল। চূড়ান্ত অনৈতিকতা। শুধু বিধায়ক না। পঞ্চায়েত, পুরসভা, জেলা পরিষদ, ক্লাব সব কিছুই দখল। নির্লজ্জ দখলদারি। একজনও তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচিত সদস্য নেই এমন পঞ্চায়েত, পুরসভাও দখল করল তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্য জুড়েই একই রকমভাবে দলত্যাগ, দল ভাঙানো। জবরদস্তি, লোক দেখানো, প্রশাসনিক চাপ, মিথ্যা মামলা সবই চলতে থাকল। তৃণমূল কংগ্রেসের দপ্তরে রোজই উৎসব চলছে! মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় দলত্যাগের হিড়িক। ‘উন্নয়নের জোয়ারে’ ভেসে তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা ধরার মহা সমারোহ। পতাকা না ধরলেই মিথ্যা মামলা। ধরলেই সাত খুন মাফ। গত দশ বছরে তৃণমূল কংগ্রেস তথা মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় এ এক নতুন অপসংস্কৃতির আমদানি যা অতীতে বঙ্গবাসী দেখেনি কখনও।
বিরোধী শূন্য রাজনীতিরই এ এক অপচেষ্টা দলত্যাগ কিংবা দল ভেঙে দল গঠনের পরম্পরা সাধারণভাবে আমাদের দেশে খুব একটা ছিল না। ১৯৬৭-তে একসঙ্গে দেশের অনেকগুলি রাজ্যে অকংগ্রেসি সরকার তৈরি হওয়ার পর এ ধরনের ঘটনা বেশিমাত্রায় চোখে পড়ে। লোকসভার প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল সুভাষ কাশ্যপ তাঁর প্রকাশিত বইয়ে লিখছেন যে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে বিভিন্ন রাজ্য মিলিয়ে দল ভাঙা-গড়ার ১৯৬৯টি ঘটনা ঘটে। সব রাজ্য মিলিয়ে ৩২ বার সরকারের পতন ঘটে। এ রাজ্যেও ১৯৬৭-তে যুক্তফ্রন্টের আমলে প্রফুল্ল ঘোষের নেতৃত্বে আরও ১৭ জন বিধায়ক দলত্যাগ করে সরকার গঠনের লক্ষ্যে পিডিএফ নামে নতুন মোর্চা গঠন করেন। পরবর্তীতে আবার সেই পিডিএফ থেকে পদত্যাগ করে ৩২ জন বেরিয়ে এসেছিলেন আইএনডিএফ নামে আরও একটি ফ্রন্ট গড়ার জন্য। দল ভেঙে দল গঠন। বাংলাতে ব্যতিক্রম এরকম নজিরও। যদিও উল্লিখিত দলত্যাগ বা দল গঠনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যুক্ত ছিল সরকার ফেলে দেওয়া বা সরকার গঠনের তৎপরতা।
পরিবর্তনের পর এ রাজ্যে যেভাবে দলত্যাগ বা দল ভাঙানোর খেলা চলছে তার সঙ্গে উপরোক্ত ঘটনাগুলির কোনও মিল নেই। প্রথমত, ১৯৮৫ সালে সংবিধানের দশম তফসিলে দলত্যাগ বিরোধী আইন সংযোজিত হয়। উপরোক্ত ঘটনাগুলি তার আগের। দ্বিতীয়ত, গত দশ বছরে এ রাজ্যে যে দলত্যাগ আর দল ভাঙানোর ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তার সঙ্গে সরকার ফেলে দেওয়া বা গঠন করার সম্পর্ক নেই। দু’দফায় দল ভাঙিয়ে তৃণমূল ক’জনকে দলে নিয়েছে সে হিসাব রাখাই দায়। কমবেশি ২৩ জন করে ৪৬ জন। সরকার গঠন বা রক্ষার জন্য তো এর দরকার ছিল না। তাহলে কেন? জবরদস্তি। আগ্রাসী মনোভাব। একক বা সীমাহীন ক্ষমতার ঝোঁকে বিরোধীশূন্য রাজনীতিই লক্ষ্য। বিরুদ্ধ মত বা প্রতিবাদের কণ্ঠকে রুদ্ধ করার স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা। পরিবর্তনের দশ বছরে বিরোধীদের অধিকার কেড়ে নেওয়া, দশ বছর চুপ করে থাকা কিংবা মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে রাখার নিদান, প্রশাসনিক সভার নামে নির্বাচিত বিরোধী সদস্যদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র দলীয় কর্মীদের সভায় প্রশাসনিক কর্তাদের হাজির করানো। দলবাজির চূড়ান্ত এই অনুশীলন স্বৈরতান্ত্রিকতার আস্ফালনেরই ইঙ্গিত দেয়।
কলুষিত হচ্ছে এ রাজ্যের রাজনীতি এই রাজ্যে দল ভাঙানোর অনৈতিক রাজনীতির যাঁরা প্রবর্তক, তাঁরা এখন হঠাৎ চিৎকার শুরু করলেন কেন? পাঁচিল ভেঙে পথ করেছে তৃণমূল। সেই পথ ধরেই বিজেপি আজ তৃণমূলের ঘর ভাঙছে। তৃণমূলের হয়ে দল ভাঙানোর খেলায় যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরাই এখন একই কাজ করছেন বিজেপি’র হয়ে। তখন মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়নের জোয়ারে অনুপ্রাণিত হয়ে তৃণমূল ভবনে গিয়ে জোড়াফুলের পতাকা হাতে যাঁরা ছবি তোলার ব্যবস্থা করেছিলেন, তাঁরাই এখন উন্নয়নের ভাটার প্রাবল্যে বিজেপি ভবনে গিয়ে পদ্মফুল ফোটাচ্ছেন। দলবদলু তৃণমূলীদের পিছনে রাজ্য পুলিসের প্রহরা। আর দলবদলু বিজেপি’র পিছনে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরা। দলবদলের খেলায় মানুষের কষ্টার্জিত করের টাকার এত বড় অপচয় কখনও এ রাজ্যে আগে কল্পনাও করা যেত না। ক্ষমতার তেজ আর দম্ভের পারস্পরিক আস্ফালন।
বিজেপি দল ভাঙানোর খেলায় পারদর্শী। সাম্প্রতিক সময়ে গোয়া, অরুণাচল, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ—একের পর এক রাজ্যে এমএলএ কেনাবেচার মাধ্যমে সরকার তৈরি করেছে। বেআইনি এবং নীতিহীন। এ রাজ্যেও বিজেপি একই কলুষিত রাজনীতি করছে। সর্বনাশ হয়েছে বাংলার কৃষ্টি, মনন, শ্লাঘা আর আত্মগরিমার। এ দায় কার?
তৃণমূল-বিজেপি। একই ছাঁচ। একই ডিএনএ।
এখন সদ্য বিজেপিতে যুক্ত দলত্যাগী প্রাক্তন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী হুংকার ছেড়ে বলছেন—‘তোলাবাজ ভাইপো হঠাও’। ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ পাল্টা হুংকার দিচ্ছেন ‘ঘুষের টাকায় তোলা নেওয়ার ভিডিওতে কাদের ছবি দেখা যাচ্ছে?’ নেতারা বলছেন—‘দশ বছর দলে থেকে করেকম্মে খেয়ে, এখন বিজেপিতে যাওয়া?’ মানুষ বুঝছে, ভাইপোও ঠিক বলছেন। অধিকারীবাবুও ঠিক বলছেন। আমরা যা বলেছিলাম তৃণমূল সম্পর্কে, দু’পক্ষের পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে, এখন সেই সত্য তথ্যই প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। মোদ্দা কথা প্রতারিত, শোষিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। চিটফান্ডে সর্বস্ব খুইয়ে, শিক্ষক অথবা সরকারি চাকরির নিয়োগে কিংবা সরকারি যে কোনও পরিষেবার সুবিধা নিতে ঘুষের রাজত্বে আজ সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। বিপর্যস্ত অবস্থা তাদের। নীতি, মূল্যবোধ বিবর্জিত ক্ষমতা, অর্থ আর দম্ভের রাজনীতির শিকার বাংলার আপামর জনসাধারণ। কয়লা, গোরু, সোনা কিংবা বালি-পাথর জড়িয়ে পাচার চক্র এখন বিভাজিত। হয় তৃণমূল-তৃণমূলে, নয়তো তৃণমূল-বিজেপিতে। একই ছাঁচ দু’দলের। একই ডিএনএ-তে গড়া এই লুটেরা বাহিনী। সমার্থক। রং আর পতাকা আপাতত আলাদা। কিন্তু মিলে যেতে কতক্ষণ?
বামপন্থার গর্ববোধ
বিলাপ করে কী লাভ? বাংলার সমাজজীবনে স্বচ্ছতা, মূল্যবোধ, নীতি, বিবেচনা, রাজনৈতিক সংস্কৃতির মননটাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বাম আমলে গড়ে ওঠা নজিরগুলো সারা দেশেরই নজর কেড়েছে। ৩৪ বছরের বাম শাসনে দলত্যাগ বা দল ভাঙানোর রাজনীতি এ রাজ্যের মানুষ দেখেনি। সারা দেশে যখন ‘আয়ারাম গয়ারাম’-এর চর্চা, তখন পশ্চিমবাংলায় বিরোধীদল পূর্ণ অধিকার নিয়েই একের পর এক পঞ্চায়েত বা পুরসভা চালিয়ে গেছে। সরকারের পূর্ণ মদত এবং সহযোগিতা পেয়েছে। আজকের দিনে এরকম ছবি চেতনারও অতীত। সারা দেশ দেখেছে, বাম আমলে জেলা পরিষদের বিরোধী নেতাকে ‘অধ্যক্ষ’ পদ তৈরি করে প্রশাসনিকভাবেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পঞ্চায়েত সংক্রান্ত যে কোনও অভিযোগ খতিয়ে দেখতে। মানুষের ভিন্নমত, স্বাধীন রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং বিরোধীদল সমূহের অধিকার এ রাজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল তো বটেই। সর্ব ভারতীয় প্রিসাইডিং অফিসারদের পরামর্শক্রমে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন লোকসভার স্পিকার দলত্যাগ বিরোধী আইন এবং তার প্রয়োগের খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখার জন্য রাজ্যের তৎকালীন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে, এ রাজ্যের চাইতে এ বিষয়ে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান কার হতে পারে? সেই মর্যাদা এবং গর্ববোধটাকে রোজই ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে সচেতনভাবে।
তৃণমূলই রাজ্য বিজেপি’র সাপ্লাই লাইন
এতদিন অন্য দল ভেঙে তৃণমূলে যোগদান হচ্ছিল। এখন তৃণমূল ভেঙে বিজেপি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভিন্ন দল ভেঙে তৃণমূল যাকে দলে নিয়েছে, পাঁচ বছর সময় সীমার মধ্যে তারাও দ্বিতীয়বার দল ভেঙে আবার বিজেপিতে যাচ্ছে—এ ঘটনাও বিরল নয়। সম্প্রতি, লোকসভা সদস্য সুনীল মণ্ডল দলত্যাগ করে বিজেপিতে গেছেন বলে অভিযোগ জানিয়ে লোকসভার স্পিকারের কাছে তাঁর সদস্যপদ খারিজের আবেদন জানিয়েছেন তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা। তা বেশ! কিন্তু এ রাজ্যে দল ভেঙে যাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসে গেছেন তাঁদের সদস্যপদ খারিজের প্রশ্নে তৃণমূল নেতৃত্বের অবস্থান কী? চার বছর হয়ে গেল। দরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু তথাস্তু। শুধু সময় নষ্ট করা হচ্ছে। বরং তৃণমূল নেতৃত্ব তাঁদের প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। কিংবা রাজ্যে যাঁরা তৃণমূল ভেঙে ভিন্ন দলে চলে গেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সদস্যপদ খারিজের অভিযোগ তৃণমূল কংগ্রেস দল থেকে আজও জমা দেওয়া হল না কেন? বস্তুতপক্ষে রাজ্যে বিজেপি’র সাপ্লাই লাইনই তো এখন তৃণমূল।
ফারাক মূল্যবোধেই
ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, তখন বিরোধী দলের নেতা জ্যোতি বসু। রাজনৈতিক মতপার্থক্য কম ছিল না। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বিধানচন্দ্র রায় গড়ে তুললেন সল্টলেক। তাঁর অবর্তমানে তাঁরই সময়ের বিরোধী নেতা জ্যোতি বসু, সল্টলেককে ‘বিধাননগর’ নামাঙ্কিত করার মধ্য দিয়ে যেমন বিধানচন্দ্র রায়কে যথার্থ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, তেমনই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন। বামফ্রন্টের সময়কালে কলকাতার উপকণ্ঠে রাজারহাটে গড়ে উঠল নতুন শহর। জ্যোতি বসুর ভাবনায় এবং নেতৃত্বে, কেন্দ্রীয় সরকারসহ সবাইকে যুক্ত করে বিশাল শহর। সল্টলেকের তিনগুণ। আধুনিক এবং সার্বিক পরিকল্পিত একটি নগর। জ্যোতি বসুর প্রয়াণের পর তৎকালীন সরকার নতুন এই শহরকে ‘জ্যোতি বসু নগর’ নামাঙ্কিত করলেন। পরিবর্তনের পর তৃণমূল সরকার তা খারিজ করে দিল। ক্ষমতার জোরে। দম্ভে। এটা লজ্জার এবং দুর্ভাগ্যের। এখান থেকে বাংলার সমাজ জীবনকে বেরতেই হবে। দায়িত্বটা সবার। প্রতিটি সচেতন নাগরিকেরই। আদর্শ, নৈতিকতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুশীলনে বামপন্থার বিকল্প কোথায়? সমসাময়িক ঘটনাবলি সেটাই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করছে।