প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
তবে ভোট প্রচারে যে তাঁর দল এবার রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরতে চাইবে, তার ইঙ্গিত মিলেছে দফায় দফায়। আর তিনি? বঙ্গ নিয়ে স্বপ্ন ফেরি করা শুরু করেছেন সংগঠিতভাবেই। অঙ্ক কষে। সম্প্রতি কলকাতার বণিকসভা ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) বার্ষিক অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ওরে, নূতন যুগের ভোরে’ আবৃত্তি করেছেন। হিন্দি টানে বাংলায়। ভয়ঙ্কর উচ্চারণে বলেছেন, ‘চোলায় চোলায় বাজবে জয়ের বেরি...।’ এই আবৃত্তি পাঠে আপনি হাসি চাপতে না পারলেও, তাঁর ‘হিপনোসিস’-এর ক্ষমতা টের পায় এই বাংলাও। অন্তত তাঁর ভক্তদের প্রচার দেখে তাই-ই মনে হওয়া স্বাভাবিক। এটা নাকি ছিল, রবীন্দ্রচর্চার নিদর্শন! কিন্তু ভাষা নিয়ে আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে ভোটকে পাখির চোখ করলে তা আমবাঙালির কাছে সহজেই ধরা পড়ে! আজ রবীন্দ্রনাথের মতো দাড়ি রাখছেন, তাঁর সাকরেদরা বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান বলছেন, রবীন্দ্রনাথের মেজদাকে বড়দা বানাচ্ছেন—এরকম আরও কত কী! ভোট বড় বালাই।
তিনি নরেন্দ্র মোদি। কখন কোথায় কাকে ফুল দিতে হয়, এটা তাঁর নখদর্পণে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গুজরাতের কত নিবিড় সম্পর্ক ছিল তা প্রমাণে প্রাণপাত করে চলেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক স্বপ্ন ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নাকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গির-ই অনুসারী! বিস্ময়ের সীমানাটা আদতে পলকা নয়, তবে এইসব কথাবার্তা শুনে তা অচিরেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে।
কিছুতেই তাকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না! তবু তিনি থামছেন না। পরম বিজ্ঞের মতো তিনি বলেই চলেছেন, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নাকি ‘বেদ থেকে বিবেকানন্দ’ সবই পাওয়া যায়! অর্থাৎ একের ভিতর সব! তাঁর সুরেই সুর মিলিয়ে এবার বিজেপি বাংলায় ভোটে নেমেছে। মাস কয়েকের জন্য রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন, শ্রীচৈতন্য... বাংলার মনীষীরাই হয়ে উঠছেন গেরুয়া বাহিনীর প্রচারের অনুঘটক। এটা স্পষ্ট, ‘বহিরাগত’ তকমা ঘোচাতে বিজেপিকে নিরুপায় হয়েই বাংলার মনীষীদের আশ্রয় খুঁজতে হচ্ছে। বাংলার মনীষীরা কোন দলে, ভোট-হাওয়ায় সেই ধন্দ উস্কে দিতে চাইছে বিজেপি। ভোটের প্রথম রাউন্ডেই বিজেপির মধ্যে ‘বাঙালি’ হয়ে ওঠার এক তীব্র তাড়না নজরে পড়ছে। যেটাকে বলা যেতে পারে, বাঙালি তাস খেলা! বাঙালি-অবাঙালি রাজনীতি। সোজা কথায়, এই রাজ্যে বাঙালির বেশে বিজেপি নিজেকে দ্রুত গ্রহণীয় ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে চাইছে।
আর তা করতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খাচ্ছেন বিজেপি নেতারা। কাটোয়ার জগদানন্দপুরে চৈতন্যদেবের দীক্ষাস্থল নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে বসেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা। রাধাগোবিন্দের যে মন্দিরে তিনি গিয়েছিলেন, সেখানেই চৈতন্যদেব দীক্ষা নিয়েছিলেন বলে দাবি করে বসেন তিনি। অথচ মন্দিরটি তৈরি হয়েছে চৈতন্যদেবের প্রয়াণের প্রায় তিনশো বছর পরে। এসব দেখে এরাজ্যের মানুষ বলছেন, বহিরাগতরা বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি জানে না। তারই প্রকাশ ঘটছে পদে পদে।
গত লোকসভা ভোটের শিক্ষা বলছে, অমিত শাহের রোড-শো থেকে তাণ্ডবে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙচুরের পরে শহরে বিজেপির ফল খারাপ হয়েছিল। সেই ঘটনা বাঙালির আবেগের বারুদে অনেকটাই ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। অতএব, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ থেকে সুভাষচন্দ্র—সবাইকে দলে টানতে হবে। নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে তাঁরা ওঁদের কখনও মাথায় তোলেন, কখনও পায়ে ঠেলেন। আজ বিজেপি যে ‘বাঙালি’র কথা বলছে, এই বাঙালি অবশ্য আমাদের মতো আমজনতা নয়। এ হল ভোটের বাঙালি। এর জন্য হাত-পা-মুখের অবয়ব লাগে না। দরকার আবেগ সৃষ্টির। রাজ্যের রাজনীতিতে এখন সেই পর্ব শুরু হয়েছে। বাঙালির মন জয়ে দিল্লির নেতা অবতারদের রকমারি বাংলা উপস্থাপনায় আপাতত ফাঁক থাকছে না।
ছুটি পেলে সাত দিনের জন্য শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে কাটাতে চান। ভোটের দামামা বাজতেই বলে গিয়েছেন অমিত শাহ। বোলপুরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে সেদিন বলেছিলেন, ‘আজ অত্যন্ত সৌভাগ্যের দিন। বিশ্বভারতীতে এসে সেই মহামানবকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পেলাম, যিনি গোটা বিশ্বে ভারতীয় জ্ঞান, দর্শন, কলা, সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের সামঞ্জস্য স্থাপনের কাজ করেছিলেন শান্তিনিকেতনে। প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষে আবারও ভারতীয় ভাবধারাকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে।’ হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ নিয়ে অমিতভাইয়ের বক্তব্যটা মনে আছে? বললেন, রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দিয়ে নোবেল পুরস্কারই তার মহত্ত্ব বাড়িয়েছে। আহ্, এত বড় আর একেবারে ঠিকঠাক কথাটা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আগে কে কবে বলেছে বলুন? অথচ, সেদিন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের স্বীকৃত ‘শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস’-এর প্রধান দীননাথ বাত্রা কিংবা সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর কথা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললেন না। কী বলেছেন স্বামী? বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীতটি অর্থের দিক থেকে সঙ্কীর্ণ, ভারতের নবীন প্রজন্মের ইচ্ছে এটি পাল্টানো হোক। হ্যাঁ, উনি তো তাঁরই পার্টির সাংসদ।
মোদি-শাহ জুটির খুবই নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত দীননাথ বাত্রার কথাই ভাবুন। উনি প্রস্তাব দিয়েছেন এনসিইআরটি-কে। দেশের স্কুল কলেজের টেক্সট বইগুলির অনেক কিছুই পাল্টাতে হবে। অনেক কিছুই মানে, যা কিছু ‘বেসলেস অ্যান্ড বায়াস্ড’। বাত্রা সাহেবের মতে, ‘বিপ্লবী কবি’ পাশ-এর কাব্য থেকে সব ইংরেজি, উর্দু, আরবি শব্দ বাদ দিতে হবে। বাদ দিতে হবে মির্জা গালিবের দু’টি কবিতা, বাদ দিতে হবে শিল্পী এমএফ হুসেনের আত্মজীবনীর নির্বাচিত অংশ। আর বাদ দিতে হবে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার গোটাটাই। হ্যাঁ, গোটাটাই। কারণ একটাই, রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলি বিশেষ দলটির স্বার্থের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের সাথে মানবতার প্রভেদটা কোথায়, সেই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বৈপ্লবিক চিন্তাধারা তাঁর সমকালীন সময়ে শুধু এদেশেই নয়, প্রাচ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা পাশ্চাত্যের তরুণ সমাজেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। কী অদ্ভুত ঐতিহাসিক পুনরাবৃত্তি! একশো বছর আগেও (‘ন্যাশনালিজম’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৭ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন) ঠিক ওই একই কারণে রবীন্দ্রনাথকে একাদশ শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিলেবাস থেকে সরানোর দাবি উঠেছিল। আর আজ, তাঁরই দেশের একটি বিশেষ দল তাঁর লেখা ছেঁটে ফেলার প্রস্তাব তোলে। একইসঙ্গে বাদ নজরুলও। ফলে বাদ, সব বাঙালি বাদ। এঁদের একসময়ের ডাকসাইটে নেতা তো রবীন্দ্রনাথ, সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং নজরুল ইসলামের সংস্কৃতিকে ‘রসুন সংস্কৃতি’ বলে আখ্যা দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন। না, এখন অবশ্য এসব বলা যাবে না কিছু। সামনে ২০২১-এর নির্বাচন।
গেরুয়া বাহিনী নিশ্চিত জানে, সাম্প্রদায়িক পরিচিতিকে খণ্ডন করে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের নজির গড়েছে এই বাঙালিরাই। গো-বলয়ের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকরী বিকল্পের জন্ম দিয়েছে বাঙালির সংস্কৃতি। এবং সেটা আর্যাবর্তের একদম পাশেই। বাংলা ও বাঙালির বিরুদ্ধে গেরুয়া শিবিরের জাতক্রোধ তাই স্বাভাবিক। এই বাংলায় বাঙালি মুসলিম হোক আর হিন্দু বা বৌদ্ধ, সকলেরই মাতৃভাষা বাংলা। তা নিয়েই হিন্দিওয়ালাদের খুব ভয়। তাই বাঙালি আর বাংলার বিরুদ্ধে বিষ না ছড়িয়ে তাদের উপায় নেই। বিজেপি নেতারা ভালো করেই জানেন, তাঁদের চালচলন, রীতি-শিষ্টাচার, ভাষা প্রয়োগ ইত্যাদি অনেক কিছুই চেনা বাঙালি-সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না।
তাই, বাংলা দখল করতে গেলে আগে ‘বাঙালি’ হতে হবে। বিলকুল জানেন গেরুয়া শিবিরের নেতারা। তাই, বাংলার মাটি দখল করার লক্ষ্যে বিজেপি এখন ‘বাঙালি’ হয়ে উঠতে মরিয়া। ভিনরাজ্য থেকে বাংলায় ভোট করাতে আসা নেতাদেরও তারা ‘বাঙালিয়ানা’ শেখাচ্ছে বলে খবর। লক্ষ্য একটাই, চিন্তাভাবনার উদারতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা জ্ঞানচর্চার শেষ দূর্গ পশ্চিমবঙ্গের দখলদারী আগে নিতে হবে। তারপর..। হ্যাঁ, এই বাঙালিদেরই, একেবারে গলা টিপে মারা হবে। তারই মহড়া শুরু হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। বিদ্যাসাগর কলেজেই বিদ্যাসাগরকে ভাঙা, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনেই রবীন্দ্রনাথের উপরে অমিত দাদার ছবি ছাপানো— যাতে দাদার তুলনায় কবির তুচ্ছতা স্পষ্ট হয়। এসবের জন্য রয়েছে দলবদলু, কিছু পথ-হারানো বাঙালি। এরাই বিজেপির অস্ত্র। কিছু অর্থ, কিছু পদ। ব্যস! শাহরা জানেন, রাজাকাররা সব যুগে, সব দেশে একেবারে তৈরিই থাকে। শুধু সময়ের অপেক্ষা!