প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
৮ জানুয়ারি যখন এই নিবন্ধ লিখছি তখন কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতাটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য কিছু সংখ্যা যথেষ্ট। সংক্রামিতের সংখ্যা ১ কোটি ৪ লক্ষ ১৪ হাজার ৪৪ (দ্বিতীয় স্থানে, মার্কিন যুক্তরাষ্টের পরেই)। মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ ৫০ হাজার ৬০৬ (তৃতীয় স্থানে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রাজিলের পরে)। সক্রিয় কেসের সংখ্যা ২ লক্ষ ২২ হাজার ৪১৬। আমাদের মোট জনসংখ্যা ১৩৮ কোটি। সেই বিচারে নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করতে পারি আমরা। কিন্তু তাই বলে মহামারী নিয়ন্ত্রণ এবং ম্যানেজমেন্টের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিশ্চয় আমরা নই।
সারা পৃথিবীতে অনুমোদিত ভ্যাকসিন ছয়টি। রাশিয়া এবং চীনের ভ্যাকসিনগুলো সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না, যদিও সেগুলো তাদের দেশে ব্যাপকভাবে বণ্টন করা হচ্ছে। যত দূর জানি, অন্যকোনও স্বীকৃত নিয়ন্ত্রক সংস্থা রাশিয়ান কিংবা চীনা ভ্যাকসিনকে ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেয়নি।
চারটি ভ্যাকসিন, বিরাট সুযোগ
হাতে থাকছে চারটি। এক নম্বরে ফাইজারের তৈরি ভ্যাকসিন, যা যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ অনুমোদিত, বিজ্ঞানের জগতে এবং চিকিৎসক মহলে যেটা ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ বলে মান্যতা পাচ্ছে। ট্রায়ালের আবশ্যিক তিনটি পর্বে ভ্যাকসিনের তিনটি জিনিস যাচাই করে নেওয়া হয়ে গিয়েছে—প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউনোজেনিসিটি), কতটা নিরাপদ (সেফটি) আর কার্যকারিতা কেমন হবে (এফিসিয়েন্সি)। সমস্যা হল সংরক্ষণের শর্তাবলি (মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং ভারতের জন্য দামটা (এখনও যা ঠিক হয়নি)। ফাইজার ইতিমধ্যেই ড্রাগস কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার (ডিসিজিআই) কাছে ‘ইমারজেন্সি ইয়ুজ অ্যাপ্রুভাল’ চেয়ে আবেদন করেছে, কিন্তু তিন তিনবার সুযোগ পেয়েও তাদের কাজকর্ম নিয়ে ভারতীয় এক্সপার্ট কমিটির কাছে হাজির হয়নি। আমার অনুমান, তাদের ভ্যাকসিন ভারতের বাজারে বিপণন এবং বণ্টনে ফাইজার খুব একটা আগ্রহী নয়। কারণ তারা ধরে নিয়েছে যে এই ভ্যাকসিনের যা দাম তা ভারতের সামর্থ্যে কুলোবে না এবং ভ্যাকসিন সংরক্ষণের শর্তাবলিও ভারতের পক্ষে পূরণ করা কঠিন। যেহেতু ফাইজারের ভ্যাকসিনকে অনেক দেশ/নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছাড়পত্র দিয়েছে এবং এটার চাহিদা বিশ্বজুড়ে তুঙ্গে, তাই হয়তো ফাইজার ভ্যাকসিন দেওয়ার অগ্রাধিকারের তালিকায় ভারতকে অনেক পিছনের সারিতে রেখেছে।
দ্বিতীয় ভ্যাকসিনটা হল অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার। তাদের লাইসেন্স নিয়ে এটা ভারতের জন্য তৈরি করছে সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া। আমরা গর্ব করতে পারি যে একটা ভারতীয়
রিসার্চ-কাম-ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি কোভিশিল্ড নামের ভ্যাকসিন টেস্ট, প্রস্তুত ও বণ্টনের যোগ্য বিবেচিত হয়েছে।
মডার্না’রটি হল তৃতীয়। এটা এখনও ভারতের অনুমোদনের জন্য আবেদন করেনি।
অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক
চতুর্থ ভ্যাকসিনটা হল বায়োটেকের কোভ্যাকসিন। সংস্থাটি তার কাজে বিদেশি গবেষক ও বিজ্ঞানীদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ব্যবহার করে বটে, কোভ্যাকসিন ১০০ শতাংশ ভারতীয়। এটা ভারতের জন্য একটা গর্বের মুহূর্ত। ভ্যাকসিনের ছাড়পত্র দেওয়া নিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের কাদা ছিটানো হয়েছিল। গোড়াতেই ডিসিজিআই এবং সরকারের মুখপাত্রের (বিশেষ করে ডাঃ ভি কে পাল এবং ডাঃ বলরাম ভার্গব) তরফে স্পষ্ট করে দেওয়া উচিত যে, কোভ্যাকসিনের ইমারজেন্সি ইয়ুজ অ্যাপ্রুভাল দেওয়া হয়েছিল বণ্টন তথা তৃতীয় দফার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য। এর ফলাফলের (বিশেষ করে কার্যকারিতার ফল) নিরিখেই পরবর্তী পর্যায়ে বণ্টন ও ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এটা সত্যি যে নামী বিজ্ঞানী, ভাইরোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট এবং ডাক্তারদের অনেকে ভ্যাকসিনের তড়িঘড়ি ছাড়পত্র দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের প্রশ্ন, ফেজ থ্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই এই অনুমোদন দেওয়া হল কেন? বেপরো পরিস্থিতিতে বেপরোয়া সমাধানেরই প্রয়োজন। পরিমাণের দিক থেকে, ভারতের ভ্যাকসিনের প্রয়োজনটা বিপুল। এতটাই বেশি যে না সিরামের কোভিশিল্ড, না আমদানি করা ভ্যাকসিন—কারও পক্ষেই দ্রুত দেশজুড়ে সবাইকে দেওয়া তা সম্ভব হবে না। সম্ভাবনাময় জীবনদায়ী কাউকে বিকল্প হিসেবে প্রস্তুত রেখে দেওয়াই হবে বিবেচকের মতো কাজ। অতএব জরুরি প্রয়োজনের এই ‘ব্যাক-আপ’ ভ্যাকসিনের জন্য টেস্টিং প্রসেসটা দ্রুত সম্পূর্ণ করে রাখতে হবে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হল, আমরা যেন ডিসিজিআই এবং সরকারের প্রতি সহৃদয় থাকতে পারি।
কোভ্যাকসিন ‘ক্ষতিকর’ এরকম কোনও প্রমাণ নেই। ট্রায়ালগুলোর মধ্যে দিয়ে এই ভ্যাকসিন তার ‘ইমিউনোজেনিসিটি’ এবং ‘সেফটি’র দিকটি নিশ্চিত করেছে। ‘এফিসিয়েন্সি’র ব্যাপারেও কোনও বিরূপ রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। সবাই মিলে আমাদের আশা করা উচিত যে, জানুয়ারির শেষদিকে কোভ্যাকসিনের তৃতীয় দফার ট্রায়াল সম্পূর্ণ হবে এবং মার্চের ভিতের তার ফলাফলের মূল্যায়ন সম্পন্ন হয়ে যাবে। তারপর আমরা দু’টো ভ্যাকসিন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজ করতে পারব। এমনকী, উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও কিছু পরিমাণ ভ্যাকসিন রপ্তানি করতে পারব আমরা। এবং, এইভাবেই আমরা সেই গর্বের দেশগুলোর মধ্যে জায়গা করে নিতে পারব, যারা গবেষণা, আবিষ্কার, প্রস্তুত, বণ্টন এবং ভ্যাকসিনের ব্যবহার ১২ মাসের মধ্যে করতে সক্ষম হয়েছে।
আমার মনে হয়, সিরাম ইনস্টিটিউট এবং বায়োটেকের মধ্যে একটা ব্যবসায়িক স্বার্থ চেতনার ব্যাপার ছিল। আদার পুনাওয়ালা এবং কৃষ্ণ এল্লা দিন দু’য়েকের ভিতরে খুব শান্তিপূর্ণভাবে সেসব মিটিয়ে নিয়েছেন এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার জন্য অঙ্গীকার করেছেন। সংস্থার লাভ বজায় রেখেও জনকল্যাণের জন্য এইভাবেই এগিয়ে আসতে হয় ‘ফ্রন্টলাইন’ কোম্পানিগুলোকে—বিশেষ করে ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ ক্ষেত্রে এটাই কাম্য।
এবার শুরু হচ্ছে প্রকৃত পরীক্ষা
প্রকৃত পরীক্ষাটা এবারই শুরু হচ্ছে। ১৩৮ কোটি ভারতবাসীকে সরকার কীভাবে ভ্যাকসিন দেবে? এই সম্পর্কে কিছু মতামত:
১. অগ্রাধিকারের কিছু শ্রেণী অবশ্যই নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে। কোনও অবস্থাতেই সেই ‘অর্ডার’ ভাঙা চলবে না।
২. সরকারি হাসপাতাল এবং ভ্যাকসিন সেন্টার বা টিকাকরণ কেন্দ্রগুলি থেকে তা অবশ্যই বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য কিছু দাম ধার্য করা হলে, মানুষকে পিছিয়ে যাওয়ার এবং দুর্নীতিরও রাস্তা দেখানো হবে।
৪. যখন ভ্যাকসিনের জোগান বাড়বে তখন বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে টিকাকরণের কাজে শামিল করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো
যদি ভ্যাকসিন কিনে নিতে আগ্রহী হয় এবং তার
জন্য তাদের গ্রাহকদের কাছে দাম ধার্য করবে বলে, তখন দামটা সরকারকেই বেঁধে দিতে হবে। যেসব ব্যক্তির কিনে নেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে ভ্যাকসিন তাদের কাছেই তারা বেচবে।
৫. ভারতে প্রস্তুত ভ্যাকসিনকে আমরা যেমন
অন্য দেশে রপ্তানির জন্য অনুমতি দিয়েছি, তেমনি আমাদের উচিত ছাড়পত্র পাওয়া ভ্যাকসিনের আমদানি অনুমোদন করা। বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রোটেকশনইজম বা সংরক্ষণবাদ একটা নিন্দিত তত্ত্ব এবং বিশেষ করে পৃথিবী যখন মহামারীর কবলে তখন এই নীতি কোনওভাবেই গ্রহণীয় হতে পারে না।
৬. অজানা পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য আমাদের অবশ্যই তৈরি থাকতে হবে। সমাধান বের
করার ব্যাপারে আমাদের বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের উপর আমরা অবশ্যই আস্থা রাখব। শেষ বিচারে বিজ্ঞানেরই জয় হবে।