প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
সন্ন্যাস... গেরুয়া রং... যা আভরণ ছিল স্বামী বিবেকানন্দের। রংটা এক থাকলেও আজ ব্যাপারটা আবরণ হয়ে গিয়েছে। সোজা ভাষায় মোড়ক, ছদ্মবেশ। যার সঙ্গে হৃদয়ের কোনও সম্পর্ক নেই।
‘হৃদয়টাকে বিসর্জন’ দিলে গেরুয়াধারী আর সন্ন্যাসী থাকেন না... জীবন দিয়ে, কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে যা মাত্র ৩৯ বছরেই প্রমাণ করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। আজ আরও এক নরেন্দ্রর জমানা... নরেন্দ্র মোদি। স্বামীজিকে বারবার কথায় বার্তায় টেনে আনেন তিনি... তাঁর পরিব্রাজক সত্ত্বাকে, কর্মযোগকে, বাণীকে...। কিন্তু আত্মস্থ করেন কি? এ এক জটিল প্রশ্ন, যার উত্তর বছর বছর খুঁজে বেড়াচ্ছেন বোধবুদ্ধিসম্পন্ন তামাম ভারতবাসী। এখন সেই উত্তর খোঁজার ভার পড়েছে স্বামীজিরই রাজ্যবাসীর কাঁধে। বাংলার হাওয়ায় এখন ভোট ভোট গন্ধ। তাই নাকি এখানে এখন মোদি হাওয়া বইছে। গত দু’টি লোকসভা নির্বাচনের আশপাশ দিয়ে দেশের বাকি অংশে যেমনটা বয়েছিল, ঠিক তেমন কিন্তু নয়! সেবার দেশবাসী অনুভব করেছিল, ‘হ্যাঁ কিছু একটা হচ্ছে বটে’। বাংলায় তেমনটা হচ্ছে না। বঙ্গে হাওয়া বইছে কানে কানে। ফিসফিসিয়ে।
এ এক মজার কৌশল! কতকটা ভাড়া করা স্যুট-বুট পরে রাস্তায় বেরনোর মতো। মাথার ছাদ নেই তো কী, লোকের চোখ টাটিয়েই আনন্দ! বাংলায় বিজেপির নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক এখনও দুগ্ধপোষ্য স্তরে। ভরসা বলতে বাম-সিপিএমের পাল্টিবাজ ভোট এবং তৃণমূলের কিছু ছিদ্রান্বেষী গোষ্ঠীবাজ। এর জোরেই ‘হাওয়া হাওয়া’ জিগির তুলে বাংলা দখলের মরিয়া চেষ্টা চলছে। দল ভাঙানোর খেলায় আপাতত বঙ্গভূমি সরগরম। নিন্দুকে অবশ্য বলছে, ভোটের আগে তৃণমূল ভাঙানোর হিড়িকের পিছনে অন্য গল্প আছে। সেটা কী? আসলে বিজেপির কোমরে জোরটাই নেই। তাই এখান ওখান থেকে ধার করে কোমর বাঁধার চেষ্টাচরিত্র চলছে। দিল্লি দরবারের নেতামন্ত্রীরা আসছেন... বলে যাচ্ছেন, আমরা দুশো সিট পাব। সত্যি? সংশয়টা কিন্তু আদি বিজেপির অন্দরেই ঘোরাফেরা করছে। ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁরাই বলছেন, ২০০ আসন একটু বাড়াবাড়ি লাগছে। তাও তাঁরা গলা মেলাচ্ছেন, চায়ে পে চর্চা করছেন, তারপর দিনের শেষে বসছেন অঙ্ক কষতে... কোন জেলায় কত আসন পাওয়া যেতে পারে। রাজ্যের ‘আদি’ বিজেপি নেতাদের মধ্যে দিলীপ ঘোষ ছাড়া কারও মধ্যে এখনও সেই তেড়েফুঁড়ে ওঠার লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না! দিলীপবাবু গেরুয়া শিবিরের একনিষ্ঠ সৈনিক। সঙ্ঘের কঠোর অনুশাসনের ছাতা মাথায় নিয়ে ভোট রাজনীতিতে হাত পাকিয়েছেন। তাঁকে যদি কাল বলা হয়, আপনাকে বাংলার ভোট রাজনীতিতে আর দরকার নেই, তিনি সেই ছাতা মাথায় দিয়েই নিঃশব্দে ফিরে যাবেন। কিন্তু কামানেওয়ালা নেতা-কর্মীরা। যে কোনও রাজনৈতিক দলেই এই শ্রেণীর সংখ্যা এবং ভূমিকা, দুইই উল্লেখযোগ্য। তাঁরা হিসেব কষছেন এবং কষবেন... কী পেলাম, কী দিলাম, আর তৃণমূল থেকে এসে কী হারালাম।
এই হিসেবটা অবশ্য এখন তৃণমূলেই বেশি। যাঁরা একটা সময় ‘কিছু’ পাওয়ার এবং করেকম্মে খাওয়ার আশায় শাসক দলে ভিড় বাড়িয়েছিলেন, তাঁরা এখন ব্ল্যাকমেল করছেন... শীর্ষ নেতৃত্বকে। টিকিট না দিলেই বিজেপি চলে যাব। এই প্রবণতা এখন তৃণমূলে জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। প্রত্যেক জেলাতেই এই টিকিটপ্রার্থীদের গোষ্ঠী উঁকিঝুঁকি মারছে। সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন প্রায় সবটাই জানেন। আর তাই তিনিও কোমর বেঁধেছেন। প্রশাসনের পাশাপাশি দলের সংগঠনও আজ তাঁর সরাসরি নজরদারির আওতায়। তাঁর সাফ কথা, যাঁরা চলে যাচ্ছে যাক। এখনই যাক। তাহলেই ভালো হবে। ভোটের সময় পিছন থেকে ছুরি মারার কেউ থাকবে না। খেটে জয় উপার্জন করতে পারলে সেটাই হবে নিষ্কলঙ্ক পাওনা। বিজেপি বাংলায় কোনওদিনই সেভাবে ছিল না। এখনও শিবরাত্রির সলতের সঙ্গেই শুধু গেরুয়া শিবিরকে তুলনা করা যায়। অর্থাৎ, তাদের হারানোর কিছু নেই। যা পাবে, সেটাই বোনাস। ঘায়েল করতে হবে শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেই চেষ্টাই চলছে... কানে কানে। হুইসপারিং ক্যাম্পেনের মাধ্যমে। শুধু মুখ্যমন্ত্রী এবং ভাইপো রাজনীতি। বিজেপি জানে, এটাই পারে তাদের ডিভিডেন্ড দিতে। আর তো ‘ধর্ম’ রয়েইছে।
‘কুসংস্কার মানুষের শত্রু বটে, কিন্তু ধর্মান্ধতা আরও খারাপ।’
স্বামীজির অনেক বাণীই নরেন্দ্র মোদি উল্লেখ করেন। কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে এই সারসত্যটা তিনি সযত্নে এড়িয়ে যান। স্বামীজির সবকিছু ‘ফলো’ করলে বিজেপি আর যাই হোক, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মোড়কটাকে একেবারেই ধরে রাখতে পারবে না। ভারতে যে এখনও ভোটের সময় ধর্ম বিক্রি হয়, সেটা প্রায় সবাই জানে। কিন্তু বিজেপি সবচেয়ে ভালো জানে, এই তত্ত্বটিকে ভোট রাজনীতিতে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়... যেখানে যেমন প্রয়োজন। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে কয়েকটা শব্দ বেশিরকম শোনা যায়... ‘লাভ জেহাদ’, ‘ঘর ওয়াপসি’। মূলত ভারতের গো-বলয়ে এখনও জাতপাত, ধর্মের নামে রাজনীতিটা পাবলিক বেশি খায়। অন্য ধর্ম,
নিচু জাতের হাতে জল খেলে হয়তো ওখানে কারও কারও গায়ে চাকা চাকা দাগ পড়ে যায়। তাই বিজেপির এই রাজনীতিটা ওখানে হিট। পশ্চিমবঙ্গে সেটা চলবে না। তাই এখানে অন্য অঙ্ক আছে। কট্টর মুসলিম পার্টিগুলি এনডিএর শরিক না হতে পারে, কিন্তু বিজেপির সঙ্গী হতে আপত্তি কোথায়! তাই আপাতত বাংলার বাজারে এসেছে মিম। উর্দুভাষী মুসলিমদের সমর্থন চায় তারা। লড়তে চায় আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনেও। কিন্তু বাংলার মাটিতে উর্দুভাষী মুসলিমের সংখ্যা কত? খুব বেশি হলে ২০ লক্ষ! তাঁদের সবাই আবার ভোট দেন না। তাহলে কী ভরসায় মিম বাংলার মাটিতে তাল ঠুকবে? ভরসা আছে... মুসলিম ‘মহাজোট’। সব মুসলিম সংগঠনকে এক ছাতার তলায় আনতে চায় তারা। কিন্তু শুধু মুসলিম কোথায়? দলিত, তফসিলি সংগঠনগুলির সঙ্গেও যে তারা বৈঠক করছে! তাহলে এই মুসলিম মহাজোটের ধাপ্পা দেওয়ার মানেটা কী? সোজা কথায়, তারা চাইছে তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসাতে। অর্থাৎ মোদি জনতা পার্টির সুবিধা করে দেওয়া। সিপিএমের ভোট, মুসলিম ভোট, দলিত ভোট... কাটাকুটি হলে বেশিরভাগটাই যাবে তৃণমূলের ভাঁড়ার থেকে। আর শেষ পর্যন্ত লাভ হবে বিজেপির। সবটাই অঙ্ক। স্বামীজি কি এই অঙ্ক শিখিয়ে গিয়েছিলেন?
স্বামীজি বলতেন, ‘এমন ধর্ম চাই, যার মূল মন্ত্র হবে মানবপ্রেম। এমন ধর্ম চাই, যা মানুষকে, বিশেষ করে অবহেলিত, পদদলিত মানুষকে প্রত্যক্ষ মানুষ বলে প্রচার করবে। খালি পেটে ধর্ম হয় না। ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে ধর্ম বা ঈশ্বর অর্থহীন।’ নাঃ... যে পরিব্রাজক এমন কথা বলতে পারেন, তাঁকে বিজেপি অন্তত অনুসরণ করে না। করতে পারে না। মানুষের স্বার্থে রাজনীতি নয়, ধর্ম নয়... সবটাই ভোটের স্বার্থে। ক্ষমতার দামামা বাজানোর আকাঙ্ক্ষায়। এখন যা সীমাবদ্ধ হয়েছে বাংলা দখলের রাজনীতিতে। তিনি বলেছিলেন, ‘যেখানেই দেখিবে কোনও অলৌকিক পবিত্রতা ও অসামান্য শক্তি মানুষকে উন্নত ও পবিত্র করিতেছে, জানিও সেখানে আমারই বহিঃপ্রকাশ।’ বিজেপির রাজনীতিতে শক্তি আছে, মানুষকে বিস্মিত করে দেওয়ার মতো ‘অলৌকিক’ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কর্মকাণ্ডও আছে। কিন্তু পবিত্রতা ও মানুষকে উন্নত করার প্রয়াস?... দেখি নাই তারে।