প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
ছবি বিশ্বাসকে সমীহ করতেন উত্তমকুমারও। তাঁর অভিনয়ের একনিষ্ঠ ভক্ত যেমন ছিলেন, তেমনই যতটা পারতেন তাঁর কাছ থেকে অভিনয় আত্মস্থ করার চেষ্টা করতেন মহানায়ক। সেইসঙ্গে ছিল অসম্ভব শ্রদ্ধা। তার সাক্ষীও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। টেকনিশিয়ান্স স্টুডিওর ১ নম্বর ফ্লোরে অজয় করের ‘শুন বরনারী’ ছবির শ্যুটিং করছেন উত্তমকুমার। সেই ছবিতে উত্তম-সুপ্রিয়ার সঙ্গে ছিলেন ছবি বিশ্বাস। সেই একই সময় অন্য একটি ফ্লোরে ভানুর প্রযোজনায় নির্মল মিত্রের ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবির শ্যুটিং চলছে। শ্যুটিংয়ের ফাঁকে ভানু একবার কী কারণে ফ্লোরের বাইরে বেরিয়েছেন। লক্ষ করলেন, উত্তমকুমার অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। একবার ১ নম্বর ফ্লোরের পিছন দিক থেকে অফিস পর্যন্ত (এখন যেখানে মেট্রো রেলের কারশেড, তখন টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও অতটা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল) যাচ্ছেন, আবার ফিরছেন। পাঁচ, ছ’বার এরকম হওয়ার পর ভানু গিয়ে ধরলেন উত্তমকে।
—‘কী রে, কী হয়েছে উত্তম? কী অত ভাবছিস? বাড়িতে কোনও গণ্ডগোল?’ উত্তমকুমার কোনও উত্তর না দিয়ে হাঁটতেই থাকলেন। ভানু আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী রে গৌতমের কিছু হয়েছে? কী হয়েছে বল না।’ মহানায়ক তখন বললেন, ‘আরে দূর, ওসব কিছু না। ছবিদার সঙ্গে লম্বা শট আছে। বুড়ো কোথা থেকে কী প্যাঁচ মারবে, তাই ভালোভাবে ডায়লগটা ঝালিয়ে রাখছি।’
দ্বিতীয় ঘটনাটিও মজার। ‘স্ত্রী’ ছবির শ্যুটিংয়ে উত্তমকুমারের একটা গুরুত্বপূর্ণ মেলোড্রামাটিক সিন ছিল। রিহার্সাল থেকে ফাইনাল টেক হওয়া পর্যন্ত উত্তমকুমারের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। মহানায়ক সেটা লক্ষ করলেও কিছু বলেননি। শটটা ফাইনালি টেক হয়ে যাওয়ার পর তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কী ভানুদা, অমন হাঁ করে আছিস কেন?’ ভানু প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে আবার ‘হাঁ’ করে উত্তমকুমারের দিকেই তাকিয়ে রইলেন। এবার ব্যাপারটা ধরতে পারলেন মহানায়ক। হেসে বললেন, ‘আসলে কী জানিস, ভালো অভিনয় এরকমই হয়। তাতে ছবিদার প্রভাব এসে পড়বেই।’ ভানু বললেন, ‘তাই বল।’
ছবি বিশ্বাসকে যেমন শ্রদ্ধা করতেন উত্তমকুমার, তেমনই বাংলা ছবির ম্যাটিনি আইডলকেও পুত্রবৎ স্নেহ করতেন তিনি। বহু ছবিতে দু’জন একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। শ্যুটিংয়ের সময় কোনও শট পছন্দ না হলে ছবি বিশ্বাস যতবার রিটেক করতে বলতেন তাতে বিরক্ত হতেন না মহানায়ক। তিনি একবাক্যে ছবি বিশ্বাসের পরামর্শ মেনে নিতেন। মহানায়কের পিতৃবিয়োগের পর তাঁর গুরুদশায় প্রতিদিন সকালে উত্তমকুমারের বাড়ি যেতেন ছবি বিশ্বাস। উত্তমবাবুর বাবা যে ইজিচেয়ারে বসতেন, সেটিতেই ছবিবাবুকে বসতে অনুরোধ করতেন উত্তম।
‘ছবিদা যখন অভিনয় করতেন উত্তমদা, আমি মানে আমরা সকলেই হাঁ করে ওঁর অভিনয় দেখতাম’, বলছিলেন ছবি বিশ্বাসের আর এক গুণমুগ্ধ অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। মহানায়কের মতোই বিশ্বজিতের সঙ্গেও বাবা-ছেলের সম্পর্ক ছিল ছবি বিশ্বাসের। টালিগঞ্জের বাঁশদ্রোণী এলাকায় খুব কাছাকাছি বাড়ি ছিল দু’জনের। তাঁর কথা বলতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত শোনাল অশীতিপর অভিনেতার কণ্ঠ। বিশ্বজিৎ বলছিলেন, ‘ছবি বিশ্বাস হলেন মডার্ন অ্যাক্টিংয়ের পথপ্রদর্শক। স্টাইলিশ অভিনেতা হিসেবে ওঁর পরিচিতি ছিল। জমিদার, রাজা, ব্যারিস্টার, মাস্টার বা কেরানি কোনও চরিত্রেই উনি কখনও ব্যর্থ হননি। কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাবুলিওয়ালা, লৌহকপাট, জলসাঘর, হেডমাস্টার কত নাম করব। অজস্র ছবি আছে। মঞ্চ ও সিনেমা দু’জায়গাতেই সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন। মিনার্ভা থিয়েটারে ঝিন্দের বন্দি নাটকে ছবিদার ডাবল রোলে অসাধারণ অভিনয় আমি দেখেছি। উত্তমদা, সৌমিত্র অনেক পরে ঝিন্দের বন্দি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। তার আগে ওটা নাটক হয়েছিল। আজও ভেবে পাই না মঞ্চে কীভাবে উনি ডাবল রোল করেছিলেন। আমাদের প্রজন্মের সব অভিনেতার কাছেই উনি ছিলেন একটা ইনস্টিটিউশন।’
ছবি বিশ্বাসের কাছ থেকে অভিনয়ের খুঁটিনাটি শিখেছেন বলে একবাক্যে স্বীকার করে নিলেন বিশ্বজিৎ। বলছিলেন, ‘টাইমিং সেন্স শেখাতেন উনি। সংলাপ বলার মাঝে পজ কী করে নিতে হয়, টার্ন কী করে নিতে হয়, ক্যামেরা অন্যদিকে থাকলে কী করে টার্ন নেবে, কোন অ্যাঙ্গেলে তাকালে পর্দায় দেখতে ভালো লাগবে এসব ছবিদা নিজে হাতে ধরে শিখিয়েছেন আমাদের। ওই হাইট, ওইরকম বনেদি চাল আর কোনও অভিনেতার মধ্যে দেখিনি। স্টুডিওতে ঢুকলেই যেন মনে হতো কোনও চরিত্র ঢুকছেন।’
পাড়ায় কাছাকাছি থাকার সুবাদেই দু’জনের মধ্যে একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পরে কর্মসূত্রে বিশ্বজিৎ মুম্বই চলে যাওয়ার পরেও সেই সম্পর্ক অটুট ছিল। ‘তখন আমি নিয়মিত আমেরিকান সিগারেট মালবোরো খেতাম। বম্বে থেকে যখন আমি কলকাতায় শ্যুটিংয়ে যেতাম ছবিদা কোনও অ্যাসিস্ট্যান্টকে বলে পাঠাতেন, বিশ্বজিৎ আমেরিকান সিগারেট খায়, ওঁর কাছ থেকে নিয়ে আয় তো একটা। নিজে এসে কখনও চাইতেন না। ছেলের মতো ভালোবাসতেন তো। অন্যকে দিয়ে চেয়ে পাঠাতেন। আমি বা উত্তমদা কেউ ওঁর সামনে কখনও সিগারেট খেতাম না। এতটাই শ্রদ্ধা করতাম আমরা।’
‘শুন বরনারী’ ছবিতে মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে ছবি বিশ্বাস