প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
আমার বাড়ির খুব কাছে, ডোভার লেনে একটা বাড়িতে ভারত স্কাউটস অ্যান্ড
গাইডস-এর ট্রেনিং হতো। বাড়িটা ছিল সাউথ পয়েন্ট স্কুলের একটা অংশ। মানে সাউথ পয়েন্টের কতগুলো ক্লাস এই বাড়িতেই হতো। পুরনো বাড়ি, সামনে একফালি জমি— যেটা মাঠের মতন। সেখানেই স্কুল শেষের পর বসত স্কাউটের সেশন।
আমি অল্প বয়স থেকেই স্কাউটের সঙ্গে যুক্ত। দেখতাম, সন্ধের পর একজন ভদ্রলোক ধুতি আর হালকা নস্যি রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে কাঁধে ঝোলা নিয়ে আসতেন, ক্লাসরুমের বাইরে দালানে বসে থাকতেন কিছুক্ষণ। তারপর আশপাশের বস্তির কয়েকটি ছেলেমেয়ে এলে ভিতরে ক্লাসরুমে নিয়ে গিয়ে পড়াতেন। কখনও বাংলা, কখনও ইংরেজি আবার কখনও ভূগোল বা ইতিহাসও। পড়ানো হয়ে গেলে নিজের কাঁধের ঝোলা থেকে বের করতেন পাউরুটি, ডিম সেদ্ধ আর কলা। ভাগ করে দিতেন সকলের মধ্যে। এই দেখাটা ছিল দূর থেকেই, কিন্তু একদিন কাছে আসারও সুযোগ গেল ঘটে।
একদিন পিতৃদেব তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘দর্শক’ আমার হাতে দিলেন এবং ওই ভদ্রলোকের বিবরণ দিয়ে বললেন ওঁকে পত্রিকাটি দিয়ে আসতে। পত্রিকা দিতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ হল। কৌতূহল আগে থেকেই ছিল, তাই জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘আপনি রোজ ওই ছেলেমেয়েদের নিজে থেকে খাওয়ান কেন?’ বললেন, ‘তা না হলে যে এরা পড়া শিখতে আসবে না বাপু।’ উনি মনে করতেন, বেসিক শিক্ষাটা সকলের জন্য জরুরি। নিজের সাধ্যমতো কারওর উপর নির্ভরশীল না হয়েই চেষ্টা করতেন। মাঝেমধ্যেই উনি খামে ভরে আমাকে কিছু একটা দিয়ে বলতেন— ‘তোমার বাবাকে দিয়ে দিও।’ বুঝতাম পত্রিকার জন্য লেখা। পত্রিকা, কখনও বই, কখনও লেখা আদান-প্রদানের মাধ্যম হয়ে ওঁর বেশ কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। জেঠু বলে ডাকতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ওঁর নাম কী কখনও জানার কথা মনে হয়নি। তখন আমি ক্লাস সিক্স কী সেভেনে পড়ি।
তারপর পড়াশোনার চাপ ইত্যাদি নানান কারণে একসময় ক্ষীণ হয়ে এল স্কাউটে যাতায়াত, সেই ভদ্রলোকও জীবন থেকে গেলেন হারিয়ে। বেশ কিছু বছর পর, তখন আমি বারো ক্লাসের ছাত্র। সালটা ১৯৭৯ হবে। খবরের কাগজের প্রথম পাতা খুলেই দু’জনের মৃত্যু সংবাদ, একই গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে। একজন বনফুল, অনেকের মতন আমারও প্রাণের লেখক। আর অন্যজন সেই ভদ্রলোক, যাঁর সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল পত্রবাহকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে। অবাক হয়ে পিতৃদেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘উনি যে এত বিখ্যাত লোক তা তো তখন বলনি!’ হ্যাঁ, আমি জানতাম না, যাঁকে জেঠু বলছি, প্রায় রোজই যাঁর সঙ্গে গল্প করছি মানে বেশিটাই ওঁর কাছ থেকে শুনছি, তিনি আর কেউ নন— কমলকুমার মজুমদার।
পরে যখন কমলকুমার সম্পর্কে জেনেছি, তার লেখা পড়েছি আমার বারবার মনে হয়েছে, এমনও হয়, এমন একজন ব্যক্তিত্বের এত কাছাকাছি এলাম, অথচ তিনি যে কে সেটা বুঝলাম তাঁর মৃত্যুর পর। সামান্যই ঘটনা, কিন্তু জীবনের পথের এই ঘটনাগুলোই তো প্রভাবিত করে অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে দেয় অনাগত চলার পথকেও।