প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
সঙ্গীতের পাঠ নিতে শুরু করলেন কনক। কিংবদন্তি মান্না দে’র সঙ্গীতগুরুও ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। পাশের বাড়ির মান্না গান শেখার সুবাদেই ধীরে ধীরে কনকের প্রাণের বন্ধু ‘মানা’ হয়ে উঠলেন। তবে শুধু গান নয়, নৃত্যগুরু শঙ্কু মহারাজের কাছে উচ্চাঙ্গ নৃত্যের তালিম নেওয়াও শুরু হল। মহারাজের ইচ্ছাতে তাঁরই সুযোগ্য ছাত্রী বেলা অর্ণবের শিক্ষায় উচ্চাঙ্গ নৃত্যে পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি। কৃষ্ণচন্দ্র দে’কে ‘বাবুকাকা’ বলে ডাকতেন কনক। সরস্বতী পুজোর বিসর্জনের দিন প্রত্যেকবার একটা কাণ্ড করতেন। অন্যথা হতো না। লরিতে চেপে মানার সঙ্গে বাবুকাকার শেখানো গান গাইতে গাইতে পাড়া ঘুরতেন। এভাবেই গান-নাচ শিখে যেন অভিনয়ের ওর্য়াম আপটা সেরে ফেললেন কনক। আর অভিনয়টা ছোট থেকেই অসম্ভব ভালোবাসতেন। বিশেষ করে কাউকে নকল করার সুযোগ পেলে তো আর কথাই ছিল না।
কোনও ব্যক্তিকে নকল করা শুধু নয়, নাটক বা ছবির কোনও বিশেষ অংশের নকল শোনার আবদারও করত তাঁর কাছে অনেকে। এ প্রসঙ্গে একটা মজার গল্গ আছে। কনক তখন ভাগলপুরের মোক্ষদা গার্লস স্কুলেই পড়েন। নিচু ক্লাসের ছাত্রী। সকলে মিলে ধরল ‘কর্ণার্জুন’ নাটকটি নকল করে দেখাতে হবে। তা নকল করতে গিয়ে যদি কখনও ভুলচুক হয়ে যেত, সেটা নিজস্ব কায়দাতেই সামলে নিতেন কনক। ওই নাটকের সংলাপ নকল করে বলতে গিয়ে বলে ফেললেন,— ‘শোন দুঃশাসন। পশু তুই, কুল নারীর অপমান করলি, তোর তপ্ত রক্ত করিব রে প্রাণ, সেইদিন তৃপ্ত হবে পান।’ কনকের মুখে প্রাণ আর পানের অদলবদল শুনে সকলে তো হেসে কুটোপুটি। তাঁর নিজের অবশ্য তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই।
কনকের পিসিমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ভাগলপুরের রাজা শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র ছেলে কুমার সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এই পিসি ছিলেন অভিনেতা অশোককুমারের দিদিমা। অশোককুমার ছিলেন কনকের সমবয়সি। পারিবারিক সূত্রে অশোককুমার, কিশোরকুমার কনকের আত্মীয় ছিলেন। ছোটবেলায় কনকের খেলার সঙ্গীও ছিলেন তাঁরা। সতীশচন্দ্রের দুই ছেলে শ্রীশচন্দ্র আর শৈলেশচন্দ্র সম্পর্কে অশোককুমারের মামা। ভাগলপুরের জন্য মাঝেমাঝেই তাই কনকের মন কেমন করে উঠত। নাচ-গানের এই দক্ষতার জোরেই রুপোলি পর্দায় সুযোগ পেলেন কনক। সে সময় বাড়ির মেয়ের সিনেমা করা বেশ ঝক্কির ছিল। কনকের অবশ্য সে সমস্যা ছিল না। তাঁর বাড়ি থেকে কেউ বাধা দেননি। তাঁকে সিনেমায় আনেন তাঁর পিসতুতো দাদা শ্রীশচন্দ্র। ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানির ম্যানেজার উপেন গোস্বামী তাঁর বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। তাঁরই সহযোগিতায় কনককে ফিল্মে নিয়ে এলেন শ্রীশচন্দ্র। ছবির নাম ‘পথের শেষে’। পরিচালক জ্যোতিষ মুখোপাধ্যায়। তখন অশোককুমারও তরুণ অভিনেতা। অশোককুমারের মামিই কনকের নাম রাখেন ছায়া দেবী। ‘পথের শেষে’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন ছায়া দেবী। পারিশ্রমিক পান মাত্র ৭৫০ টাকা। আর ওইটুকু সময়েই তিনি মুগ্ধ করে দিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক দেবকীকুমার বসুকে। ফলস্বরূপ দেবকী বসু পরপর দুটি ছবিতে সাইন করালেন ছায়াকে। জীবনের দ্বিতীয় ছবি ‘সোনার সংসার’ আর তাতেই একেবারে নায়িকার চরিত্রে। শুধু তাই নয় ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে অভিনয় করে খ্যাতি তো পেলেন, সেইসঙ্গে সোনার মেডেলও পেয়েছিলেন ছায়া দেবী। এই ‘সোনার সংসার’ ছবিতেই প্রথম অভিনয় জগতে পদার্পণ করেছিলেন পরবর্তীকালের আর এক খ্যাতনামা শিল্পী সত্য মুখোপাধ্যায়। ‘সোনার সংসার’ ছবির পর ছায়া দেবী অভিনয় করেন ‘বিদ্যাপতি’ ছবিতে। এটি ছিল ডাবল ভার্সন অর্থাৎ বাংলা ও হিন্দি দুটি ভাষায় তৈরি হয়েছিল। দেবকীকুমার বসুকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়ায় ছায়ার অভিনয় প্রতিভার যথার্থ বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকল। ‘সোনার সংসার’ ছবির ‘রমা’ আর ‘বিদ্যাপতি’র ‘রানি লক্ষ্মী’র চরিত্রে ছায়া দেবী সমগ্র দেশের দর্শককে মুগ্ধ করে দিলেন। একের পর এক ছবি করতে লাগলেন ছায়াদেবী। ‘রজনী’, ‘প্রভাস মিলন’, ‘রাঙা বউ’, ‘ছিন্নহার’ ‘খনা’, ‘হাল বাঙ্গলা’। এরমধ্যে ‘রাঙা বউ’ আর ‘হাল বাঙ্গলা’ ছবিতে তিনি গান গেয়েছিলেন। ‘রাঙা বউ’ ছবিতে অভিনয়ের সঙ্গে তাঁর গলার গান অন্য মাত্রায় তুলে নিয়ে গেল ছায়া দেবীকে। জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল লাফিয়ে লাফিয়ে। পারিশ্রমিকও হয়ে গেল আকাশছোঁয়া। এ সময় কিছু দিন বেতার জগতেও ছায়া দেবীকে গায়িকা হিসেবে পাওয়া গেল। বেতার কেন্দ্র থেকে খেয়াল ও ঠুমরি পরিবেশন করতেন। বেনারস ঘরানার শিল্পী ছিলেন তিনি। দামোদর মিশ্রের কাছে বহুদিন তালিম নিয়েছিলেন। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় থেকে শচীন দেব বর্মন সকলেই তাঁকে দিয়ে গান গাইয়েছেন। রেওয়াজ করা যাকে বলে একেবারে ওস্তাদি গলা। কিন্তু তাকেও তিনি কিছুমাত্র গুরুত্ব দিতেন না। আকাশবাণীর-ই একটি ঘটনা। একদিন বিকেল পাঁচটায় ছায়া দেবীর গান। সে যুগে সব লাইভ সম্প্রচার হতো। এদিকে ছায়া দেবী তখন গিয়েছেন নিউ মার্কেটে শাড়ি কিনতে। কেন? কারণ ওটাই তখন তাঁর মর্জি। তখন তাঁর ইচ্ছে করছিল তিনি বেছে বেছে শাড়ি কিনবেন। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আকাশবাণী ঘোষণা করে দিল, ‘অনিবার্য কারণবশত আজ পূর্ব নির্ধারিত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে না।’ এই ঘোষণা হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর আকাশবাণী ভবনে পৌঁছলেন ছায়া দেবী। প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর তো বেশ বিরক্ত। স্বাভাবিক। ছায়া দেবী নির্বকার। পালটা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে কী? খেয়াল গাওয়ার সময় পেরিয়ে গিয়েছে, এই তো। ঠিক আছে, ঠুমরি তো গাওয়া যাবে। তাহলে সেটাই গাই।’ এই হচ্ছেন ছায়া দেবী। চূড়ান্ত আনপ্রেডিক্টেবল।