প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
মুনকুদি। তার মানে আমার ছোড়দি। সে এতদিন আমাদের গ্রামের সন্নিকটে ‘মাঝু-ডুব্কা’র অগভীর জঙ্গলে ছেড়ী-ছাগল চরাত।
আর চরাবে না। কেননা—দিন কতক বাদেই তার শুভবিবাহ। বয়ঃক্রম সতেরো কি আঠারো।
সে শুধু ছেড়ী-ছাগলই চরাত না। পূর্বাহ্নে-মধ্যাহ্নে ছেড়ী-ছাগল চরিয়ে এসেও যাহোক-তাহোক চাট্টি নাকে-মুখে গুঁজে ফের অপরাহ্ণে আমাদের একমাত্র গাই চুরনীকেও দু-মুঠো ঘাস-পাতা খাইয়ে আনত।
আর খাওয়াবে না। এখন তাদের কী যে হবে! এসব নিয়ে বাবা-মায়ের ভাবার সর-অবসর কোথায়! তারা তো পণ, যৌতুক, দানসামগ্রী, বিবাহের খরচাপাতি ইত্যাদি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। হা টাকা হা টাকা করে বেড়াচ্ছে!
এর মধ্যেই নদী-সেপারের হরিপুরা থেকে মহাজন পূর্বতন বছরের কর্জ-আদায়ে এসে বাবার উপর যারপরনেই একপ্রস্থ হুজ্জুতি করে গিয়েছে।
এমতাবস্থায় আমারই মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ল। মুনকুদি শ্বশুরালয়ে গেলে পড়াশোনা ছেড়ে আমাকেই বুঝি গোরু-ছেড়ী-ছাগল চরাতে হবে। এতদিন দূর থেকে এই বলে কত টিটকারি দিয়েছি ওদের— ‘ছাগল বাগাল কান-কুট্রী গোরু বাগাল রাজা—’
আমাদের গ্রাম ছেড়ে আরও কতকটা পশ্চিমে গেলে, খান্দারপাড়া-দেউলবাড়-তিলকমাটিয়া ‘হুড়ি’ পেরলে তবেই পাতিনা গ্রাম। তার আবার দুটি ভাগ— উপর-পাতিনা আর নিচু-পাতিনা। নিচু-পাতিনা গ্রামেই মুনকুদির হবু শ্বশুরঘর।
বিবাহের আগে সে গ্রাম থেকে উৎকৃষ্ট পোশাকে কতই না নামীদামি লোক এল আমাদের গ্রামে, আমাদের ঘরে। যথারীতি আমাদের গ্রাম থেকেও সাজুগুজু করে লোক গেল তাদের গ্রামে। পাকা দেখা হয়ে গেল, কুটুম্বিতাও দস্তুরমতো পেকে উঠল।
আমরাও আনন্দিত হয়ে গোটা গোটা সুপারির গায়ে হলুদ মাখিয়ে নিমন্ত্রণস্বরূপ গ্রামের ঘর ঘর বিলি-বন্দোবস্ত করতে লাগলাম। কিন্তু বিবাহের দিন যতই নিকটস্থ হল, বাবা-মায়ের মুখ ততই শুষ্ক থেকে শুষ্কতর হতে লাগল।
কেন আবার—কারণ তো একটাই। ‘অর্থম নর্থং ভাবয় নিত্যম্’। আমাদের আর তেমন জমিজমা কই যে গচ্ছিত রেখে বা বিক্রয় করে অর্থের সংস্থান হবে। মোটে তো সাড়ে তিন কাঠা। তাও ডাঙা!
বাবা-মা যেমন-তেমন। আমরা ছোটরাও রীতিমতো বিবাদগ্রস্ত হয়ে এদিক-সেদিক অহেতুক দৌড়ে বেড়ালাম। তখন আমার কতই বা বয়ঃক্রম! বড়জোর একাদশ কি দ্বাদশ বর্ষ মাত্র।
আমাদের গ্রামের হরিবাসর বা হরিমন্দিরে আমার চেয়ে দু-ক্লাস উঁচুর ‘পোড়ো’ শ্রীমন্মথ বেরা একদিন এটা-সেটা জিজ্ঞাসাবাদের পরে বলল—
—দাঁড়া, দাঁড়া। আজ কী বার নলিন? মঙ্গলবার তো। ‘মঙ্গলের ঊষা বুধে পা। যথা ইচ্ছা তথা যা।’ তুই এক কাজ কর—কাল ভোর ভোর—
বলেই আমাকে খুব কাছে ডেকে ফিসফিস করে যা বলার বলল, সুলুক-সন্ধান দিল। শোনামাত্রই আমি যুগপৎ পুলকিত ও শিহরিত হলাম।
আরে তাই তো! দিনক্ষণ-গ্রহনক্ষত্র-কালবেলাদি যদি ঠিকঠাক, একেবারে খাপে খাপ, হুবহু মিলে যায় তবে তুক-কে-তাক! অব্যর্থ ফললাভ।
‘মাহেন্দ্র যোগেতে হয় সর্বত্রেতে জয়।
অমৃত যোগেতে সর্বকার্য সিদ্ধি হয়।।’
উত্তরে বহমান সুবর্ণরেখা নদীধারে আমাদের সামান্য কিছু ‘পাল জমি’ আছে। নদীর পলি জমে জমে তৈরি, তাই বলা হয় ‘পাল জমি’।
তবে ওই নামেই। কেন না ফি বছর বন্যায় ধাস ধাস শব্দে ‘কাতা’ ভেঙে জমিকে গ্রাস করতে করতে ক্রমেই এগিয়ে আসছিল নদী।
একদা যা ছিল আড়ে-বহরে প্রায় এক বিঘার উপর। এখন তা কাঠাকালীতে বড়জোর দাঁড়িয়েছে ওই কাঠা তিনেক কি সাড়ে তিন কাঠায়।
উক্ত জমির অব্যবহৃত উপরেই সীতানালা খালমোহানা বা ‘খাল-মু’। সেখানেই নদীবুকে ‘মশানির দহ’।
কে না জানত! তদুপরি ‘পোড়ো’ মন্মথই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল যে—যৌতুক বা দানসামগ্রীর দরুন যে কটি কাঁসা আর পেতলের বাসনের প্রয়োজন, আগের দিন সন্ধ্যা হব হব সময়ে প্রদীপ জ্বেলে ততগুলিই পান-সুপারি দিয়ে ‘মশানির দহ’য়ের পাড়ে মানত করে এলে পরের দিন প্রত্যুষেই হাতে গরম-থালাবাসন—‘প্রত্যুষসি প্রাপ্তে’—
হস্তাক্ষর লেখার জন্য আমার একটি মোটা জাবেদা-খাতা ছিল। তাতে ‘কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল, কোন দেশেতে চলতে গেলে দলতে হয় রে দূর্বা কোমল’ হস্তাক্ষর লিখে কতদিন যে ‘গুড’, ‘ভেরিগুড’ পেয়েছি!
রাত্রি জেগে সেই খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ছিঁড়ে কাঁইচি দিয়ে কেটে একশত পাঁচশত টাকা সাইজের বেশ কয়েকটা সাদা কাগজের বান্ডিল বানিয়ে ‘মঙ্গলের ঊষা বুধে পা’ দেখে যথাস্থানে কুচলাগাছের কোটরে ‘গড়-জোহার’ করে রেখে এলাম। বলেও এলাম—
—মুনকুদির বিয়ে। টাকার অভাবে বাপটা বড়ই আতান্তরে পড়েছে। হে কুচলাভূত! তুমি যদি সাদা কাগজের বান্ডিলগুলোকে একশো-পাঁচশো টাকার নোট বানিয়ে দাও তো ভারী উবগার হয়!
‘ঠঁ ঠঁ ছঁ ক্রীঁ হ্রীঁ ক্লু বশ বশ আজ্ঞাং কুরু কুরু ঠঁ ঠঁ ফট্ স্বাহা’ মন্মথর শিখিয়ে দেওয়া মন্ত্রটাও আউড়ালাম খুব মন দিয়ে। সন্ধ্যা হব হব সময়ে প্রদীপ জ্বেলে মশানির দহে পরিমাণ মতো পানসুপারিও রেখে এলাম।
আজ বাদ কাল ‘লগ্ন’। গাত্রহরিদ্রা। ঝাড়া হাত-পা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আজও মুনকুদি তার ছেড়ী-ছাগলগুলোকে পূর্বাহ্নেই মাঝু-ডুবকার অগভীর জঙ্গলে চরিয়ে নিয়ে এসেছে। যথাবিহিত চুরনী গোরুটাকেও অপরাহ্ণে ঘাস-পাতা খাওয়াতে দড়ি ধরে নিয়ে গিয়েছে পুরাতন ডাহিতে।
ফিরলে তাকে বড় মুখ করে জানালাম—
—আর কোনও চিন্তা নেই।
সে কী বুঝল, কে জানে! তাকে কিছু ভাঙলামও না। কীসের চিন্তা—সে কিন্তু জানতেও চাইল না। অবশ্য মন-মরা একটা হাসি হাসল মুনকুদি।
ততোধিক মন-মরা বাবা-মায়ের কাছে হাসি হাসি মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। বাবা না, মা-ই বলল—
—দেক তো খোকা! হরিপুরার মহাজনবাবু আসছে কি না!
আমি নদীধারে অনেকক্ষণ, এমনকী মশানির দহতক ঘুরে এসে জানালাম—
—কই না তো! যাহোক আর কোনও চিন্তা নেই।
এ কথায় বাবা-মা দু’জনেই আমার মুখের দিকে ভ্যাল ভ্যাল করে চেয়ে আছে। আমি তাদের আশ্বস্ত করে বললাম—
—দেখোই না আজকের রাতটুকু! মোটে একটা তো রাত!
—ধু-উর! বলে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেন উঠে গেল বাবা। ঘণ্টা কতক বাদে ফিরে এসে ধুলা পায়েই ঘোষণা করল—
—ছেড়ী-ছাগল-চুরনীটাকে বেচে দিলাম।
শোনামাত্রই ডুকরে কেঁদে উঠল মুনকুদি। তারপর খানিকটা দম নিয়ে মাথার উপর হাত ঘুরিয়ে সমূহ সর্বনাশের ইঙ্গিত দিয়ে বাবা এবার বলল—
—নদীধারের সাড়ে তিন কাঠা জমিটাও—
—বেচে দিলে! কপাল চাপড়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল মা। আমি উগ্রচণ্ডের মতো চেঁচাচ্ছি—
—একটা রাত সবুর করলে না বাবা! মোটে একটা তো রাত!
পরের দিন সকাল সকাল নতুন গামছায় বাধাছাঁদা হয়ে ‘লগন’ এসে গেল। তাতে পাঁচপুয়া আতপ চাল, হলুদ গাবানো গোটা তিনেক হলুদ সুঁটি, আস্ত একটা রূপার টাকা, হলুদ সুতায় মোড়া এক বান্ডিল দূর্বাঘাস।
লগন এল। চলেও গেল। আমি তখনও কুচলাতলায়, মশানির দহ ধারে বসে! কাগজের তাড়া যেমনকার তেমন। একশত, পাঁতশতর নোট হয়নি।
গুচ্ছের পান-সুপারিও পড়ে। দান-সামগ্রীর বাসন-কোশন জল থেকে উঠে আসেনি। পণেও যৎকিঞ্চিৎ ঘাটতি ছিল। মূল্যস্বরূপ পালকি এসেও ফিরে গেল।
ভাঙা গোরুর গাড়িতে ছেঁড়া পাটিয়ায় বসে রোদন করতে করতে শ্বশুরবাড়ি গেল মুনকুদি। রাতটাও ছিল হি-হি ঠান্ডা আর কারিকুরি পাখিদের রাত।