কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় মানসিক অস্থিরতা থাকবে। ... বিশদ
ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র, বিষয় ছিল রসায়ন। তিনি নিজের সম্পর্কে বলতেন, ‘আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। আচারে-ব্যবহারে, ভ্রমণে-পর্যটনে, খাদ্যে-পানীয়ে কালাপাহাড় বলিয়া পরিচিত মহলে আমার অখ্যাতি আছে; তবু আজ অস্বীকার করিতে পারি না, অলৌকিক শ্রেণীর দুইটি ঘটনার আমি সাক্ষী হইয়া আছি। দুইটি ঘটনাই আমার মনের উপর এমন গভীর রেখাপাত করিয়াছে যে, আমার ধর্মবিশ্বাস পর্যন্ত তদ্দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইয়াছে।’
সজনীকান্ত দাস। বঙ্গসাহিত্যে তিনি আজীবন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো বিচরণ করেছিলেন। তাঁর শাণিত ব্যঙ্গের কষাঘাতে বারেবারে নাজেহাল হয়েছেন বঙ্গের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে নজরুল ইসলামের পাশাপাশি কল্লোলগোষ্ঠীর বিখ্যাত লেখক বিভিন্ন সময়ে ‘শনিবারের চিঠি’-র ব্যঙ্গ-লেখনীতে বিদ্ধ হয়েছেন।
কাজি নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সৃষ্টি হল আলোড়ন। আর তারপরেই শনিবারের চিঠির জন্য কলম ধরলেন স্বয়ং সজনীকান্ত দাস। ভবকুমার প্রধান ছদ্মনামে খুব সম্ভবত তিনিই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারডি লিখলেন ‘ব্যাঙ’ শিরোনামে। তাঁর লেখা প্যারডি কবিতাটি ছিল এইরকম— ‘
‘আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং
ভৈরব রভসে বর্ষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাং।
আমি ব্যাঙ
আমি পথ হতে পথে দিয়ে চলি লাফ;
শ্রাবণ নিশায় পরশে আমার সাহসিকা
অভিসারিকা
ডেকে ওঠে ‘বাপ বাপ।’’
প্রথমদিকে কাজি নজরুল ইসলাম শনিবারের চিঠির এই ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপকে উপেক্ষা করার চেষ্টাই করতেন। তবে একসময় তাঁর ধৈর্যের বাধ ভেঙে গিয়েছিল। তিনিও পাল্টা কলম ধরেছিলেন উত্তর দেওয়ার জন্য।
সজনীকান্ত দাসের বয়স তখন মাত্র বারো। তাঁরা তখন থাকেন মালদহ-ইংরেজবাজারের কাছে কালীতলা পল্লিতে। সেইবছরেই তাঁর পিতা হরেন্দ্রলাল দাস বদলি হয়েছেন পাবনায়। তখন তিনি সাব-ডেপুটি কালেক্টর। মেজ পুত্র আজুর প্রবল অসুস্থতার খবর পেয়ে তিনি ছুটি নিয়ে পাবনা থেকে ফিরে এলেন মালদহে। বাড়ির মেজ ছেলেকে নিয়ে শুরু হল যমে-মানুষে টানাটানি। শহরের বড় বড় চিকিৎসকরাও শত চেষ্টা করেও রোগীকে সুস্থ করতে পারছেন না। বাড়ির সবাই মিলে চব্বিশ ঘণ্টা পালা করে রোগীর পাশে থেকে সেবা-শুশ্রুষা করছেন। তা সত্ত্বেও দিনকে দিন রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।
সেদিন প্রথম রাতে পুত্রের পাশে বসেছিলেন তাঁর মা তুঙ্গলতা দেবী। রাত দুটো-আড়াইটে নাগাদ স্ত্রীকে ঘুমতে পাঠিয়ে পিতা হরেন্দ্রলাল পুত্রের পাশে এসে বসলেন। ভোর রাতের দিকে তিনি বালক সজনীকান্তকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, বাবা, তুই একটু দাদার পাশে গিয়ে বোস। আমি একটু ছাদ থেকে পায়চারি করে আসি। পিতার আদেশে সজনীকান্ত ঘুমচোখে মেজদার শয্যাপাশে এসে বসলেন।
বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘তন্দ্রাচ্ছন্ন সজনীকান্ত পাখার বাতাস করছেন তাঁর অসুস্থ মেজদাকে আর ছাদে বাবার ভারী পায়ের শব্দ শুনছেন। অসুস্থ মেজদাও তন্দ্রাচ্ছন্ন।’
আর তারপরে কী ঘটল!
আমরা শুনব স্বয়ং সজনীকান্ত দাসের মুখ থেকে— ‘হঠাৎ বাবার পায়ের শব্দ থামিয়া গেল। প্রতিবেশী বন্ধু যতীনকাকা প্রাতভ্রমণে বাহির হইয়া মেজদার সংবাদ লইতে আসিয়াছেন। বাবার দৃঢ়কণ্ঠ কানে আসিল, আজই শেষ হয়ে যাবে। আমি চকিত হইয়া উঠিলাম। ঘুম জড়ানো চোখ দুইটি জলে ভরিয়া গেল! সে কি?- সে কি?— বলিতে বলিতে যতীনকাকা বৈঠকখানা ঘরে প্রবেশ করিলেন। বাবাও ছাদ হইতে নামিয়া আসিলেন। আমি আড়ালে থাকিয়া উৎকর্ণ হইয়া তাঁহাদের কথোপকথন শুনিলাম।’
হরেন্দ্রলাল তাঁর প্রতিবেশী যতীনবাবুকে কী বলেছিলেন সেই ভোরে। তিনি পুত্রের পাশে বসে কী দেখেছিলেন?
বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘হরেন্দ্রলাল একা মুমূর্ষু পুত্রের শিয়রে বসে। রাতের শেষ প্রহর। হঠাৎ একটা অস্বাভাবিক লাল আলো এসে সমস্ত ঘর ভরে গেল। চমকে উঠলেন হরেন্দ্রলাল। বিস্ময়ে হতবাক্। একি! কোথাও আগুন লাগলো নাকি?
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ঘরের চারিদিকে চাইলেন। কারণ অনুসন্ধান করতে চাইলেন। না, কোথাও কিছু নেই। কিন্তু এত তীব্র লাল আলো এলো কোথা থেকে? সেই আলোর মধ্যে তিনি হঠাৎ দেখলেন তাঁর মুমূর্ষু পুত্র বিছানার ওপর সোজা হয়ে বসে কাকে যেন উদ্দেশ করে বলেছে, এই যে আমি যাচ্ছি।’
হরেন্দ্রলাল আরও বললেন, এই দৃশ্য দেখে আমি চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় দেখি আমার অসুস্থ ছেলে আবার বিছানার ওপর শুয়ে পড়েছে। বুঝতে পারলুম মৃত্যু আসন্ন। কারণ এই দৃশ্য আমি পূর্বেও দেখেছি আমার দাদার মৃত্যুশয্যার পাশে বসে। সেদিন আমার দাদা তাঁর মৃতা স্ত্রীর উদ্দেশে বলেছিলেন, এই যে আমি যাচ্ছি। কিন্তু আজকে! আজুকে কে নিতে এসেছিলেন সেটাই আমি বুঝে উঠতে পারছি না!
সজনীকান্ত লিখছেন, ‘মধ্যাহ্ন অতিক্রান্ত না হইতেই সত্যই সব শেষ হইল। আমাদের ক্ষুদ্র সুখী সংসারে সেই প্রথম মৃত্যু প্রবেশ করিল। আমার জন্মের পূর্বে আমার এক দিদি নিতান্ত শিশু অবস্থায় বিদায় লইয়াছিলেন, সে বিরহ-বেদনা আমাকে স্পর্শ করে নাই। মেজদার মৃত্যুতে বিপর্যয় ঘটিয়া গেল। বাবা খুবই বিচলিত হইলেন। মা কিন্তু ধীর স্থির ছিলেন। মৃত্যুর পরদিন দ্বিপ্রহরের ঠিক পূর্বে বাবা ও ভাইবোন সকলে আমরা মায়ের শয়নঘর অর্থাৎ বড়ঘরের মেঝেতে চৌকিতে বসিয়া মেজদার প্রসঙ্গ আলাপ করিতেছিলাম। মা দুধ গরম করিতে সামনেই রান্নাঘরে ঢুকিয়াছিলেন। হঠাৎ বাবা গুরুগম্ভীর কণ্ঠে মেজদার নাম ধরিয়া ডাকিতেই আমরা সকলে বিস্ময়বিমূঢ় হইয়া দেখিলাম, মেঝের ঠিক মাঝখানে রক্ষিত একটা খালি চেয়ারে একটা লাল আলোয়ান গায়ে জীর্ণশীর্ণ মেজদাদা আসিয়া বসিয়াছেন। বাবা চিৎকার করিয়া মাকে ডাকিলেন, ওগো, কে এসেছে দেখে যাও!
মা গরম দুধের বাটি আঁচলে ধরিয়া প্রায় ছুটিতে ছুটিতে শোওয়ার ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত আসিয়া মেজদাকে দেখিয়াই ‘বাবা আমার’ বলিয়া মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন। দুধের বাটি ছিটকাইয়া ঝন্ঝন্ শব্দ করিতে করিতে মেঝেতে গড়াইতে লাগিল। আমার দৃষ্টি সেইদিকে আকৃষ্ট হইল। পরক্ষণেই ফিরিয়া দেখি, মেজদা অন্তর্ধান হইয়াছেন। মায়ের মূর্ছার সেই সূত্রপাত। তাহার পর ঘন ঘন মূর্ছা হইতে লাগিল। মা কোথাও স্তব্ধ হইয়া বসিলেই বুঝিতে পারিতাম, বিপদ আসিতেছে—
মৃত মেজদাকে আমরা সকলেই দেখিয়াছিলাম। বাবা মেজদার নাম ধরিয়া ডাকাতেই আমরা হিপ্নোটাইজড হইয়াছিলাম, ঘটনাটি কখনই সেইভাবে উড়াইয়া দিতে পারি নাই।’
ছবি: পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সৌজন্যে
(সমাপ্ত)
অলংকরণ: চন্দন পাল