প্রিয়ব্রত দত্ত: পাঁচ বছরের খুকু যখন আস্ত একটা ধারাবাহিকের নায়িকা তখন তার খুনসুটিও সেই মাপের মিষ্টি হবে তাতে সন্দেহ কী? ফ্রক পরা এলোকেশী খুকু তখন টেকনিশিয়ান স্টুডিওর সুচিত্রা সেনের নামাঙ্কিত ফ্লোরের চারতলার বারান্দায় ছুটে বেড়াচ্ছে। তাকে বাগে আনে কার সাধ্য। এহেন দুরন্ত বালিকাই যখন একের পর এক প্রশ্নের জবাবে কথার ফুলঝুরি ছোটাতে লাগল, তখন দ্রুত বদলে যাওয়া শিশু মনস্তত্ত্বের মাপকাঠিটাই বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এই ‘খুকু’কেই আপনারা ঠিক একবছর আগে দেখেছেন ‘গুড়িয়া’ চরিত্রে। ওর ভালো নাম পৃথা ঘোষ।
নর্থ পয়েন্ট স্কুলের কেজি ওয়ানের ছাত্রী পৃথাই সান বাংলায় প্রতিদিন সম্প্রচারিত ‘আয় খুকু আয়’ ধারাবাহিকের প্রধান চরিত্র। থাকে আবিরের সঙ্গে। মানে ধারাবাহিকের দুনিয়ার দাপুটে অভিনেতা রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই খুকুর ওঠাবসা। অটিস্টিক রাহুলই একদিন খুকুর বিধবা মা রানির মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিল। সে এক হুলুস্থূল কাণ্ড। সেই গল্প আপনারা জানেন। ঘটনাচক্রে খুকু রানির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ধারাবাহিকটির নাটকীয়তা এখানেই যে, আর এক শৈশব থমকে যাওয়া ‘অসুস্থ’ মানুষের সান্নিধ্যেই বড় হচ্ছে শিশু খুকু। খুকুর জন্মদিনে রানি নিজের বাড়িতে তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে উদ্দেশ্য করে এক এলাহি উৎসবের আয়োজন করেছে। তার আগে নিখোঁজ মেয়ের শুভকামনায় রানি এসেছে মন্দিরে পুজো দিতে। সেই মন্দিরে আবির-খুকুও এসেছে ভোগ পাওয়ার আশায়। মন্দির চাতালে দেখাও হয় মা-মেয়ের। স্বাভাবিকভাবে কেউ কাউকে তখন চিনতে পারে না।
এমনই একটি নাটকীয় মুহূর্তের শ্যুটিং-এর জন্য মেকআপ নিয়ে প্রস্তুত তিন মুখ্য চরিত্র। তখনও শটের কিছুটা দেরি আছে। সেই ফাঁকে চলছে খুকুর ক্লান্তিহীন দস্যিপনা। এটাই সে নাকি করে থাকে সর্বক্ষণ। বাড়িতে এবং শ্যুটিং ফ্লোরেও। যখন তখন ঘুম পায় না? ‘না... ঘুমোতে কেউ ভালোবাসে নাকি?’ পাল্টা প্রশ্ন বালিকার। তার ভালোবাসার জিনিস হল চিকেন আর মটন সহযোগে তন্দুরি রুটি। স্পেশাল ডিশ মেটে কারি। ঘুমোতে ভালোবাসে না বলেই সারা রাত শ্যুটিং করতে তার কোনও অসুবিধে নেই। ‘স্কুলে বলা আছে, সপ্তাহে তিনদিন আমি ক্লাস করব’ গর্বের সঙ্গে জানায় বাগুইআটির ছোট্ট বাসিন্দা। শ্যুটিং থেকে বাড়ি ফিরে টিভিতে কার্টুন চ্যানেল তো আছেই। তাহলে পড়াশোনাটা কখন হয়? ‘কেন সকালে। শ্যুটিংয়ে আসার আগে সেরে নিই,’ চটজলদি জবাব পৃথার। কিন্তু যখন সকাল সকাল ‘কলটাইম’ থাকে, তখন? ফিক করে হেসে ফেলে কন্যা। ‘তখন কী করে হবে, তখন যে কত কাজ,’ হাত নাড়িয়ে বলে ব্যস্ত অভিনেত্রী।
ঠিক এই বিষয় নিয়েই আশঙ্কিত সেটে পৃথার সব থেকে প্রিয় মানুষ অভিজ্ঞ অভিনেতা ‘রাহুল আঙ্কেল’। ‘সত্যি কথাটা হচ্ছে, এই মাধ্যমে দীর্ঘদিন কাজ করেও আমি বলছি, আমার খুব অত্যাশ্চর্য লাগে বাচ্চারা যখন অভিনয় করতে আসে। আমরা আমাদের স্কুল শেষের পরে ক্লান্ত থাকতাম। এই বাচ্চারা স্কুল সেরে অভিনয় করতে আসছে। কেউ কেউ আবার ফাংশন করতে গ্রামে গ্রামেও যাচ্ছে। বড় বিচিত্র লাগে আমার এবং বড় ভয়ও হয়। আসলে টেলিভিশনে সাফল্য অনেকটা পপকর্নের মতো। যত দিন হিট থাকে ততদিন দর্শক ভিড় করে থাকেন।
যেদিন জনপ্রিয়তা থাকে না সেদিন দর্শক ঘুরেও তাকান না। সেটা নিয়ে ডিল করতে আমার আজও অস্বস্তি হয়। আমি ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’-এর সাফল্য দেখেছি, জনপ্রিতার গ্রাফটা বাড়া-কমা, এতদিন বাদে এসেও আমি সামলাতে পারি না। ওদের কতটা কষ্ট হবে, সেটাই আমায় ভাবায়। এক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের সচেতন হতে হবে। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে আমি চাই সহজ (রাহুলের পুত্র) আগে লেখাপড়াটা ভালো করে শিখুক। তারপর সব।’
এই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল ‘রানি’ সন্দীপ্তা সেনের কণ্ঠেও। ‘আমি মনে করি সব সময় একটা ব্যাকআপ প্ল্যান রেখেই তবে অভিনয় জগতে আসা উচিত। যাতে আমার যখন কাজ থাকবে না, তখন আমি যেন বিপদে না পড়ি।’ অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করা রীতিমতো পেশাদার মনোবিদ সন্দীপ্তার মতে, ‘লেখাপড়াটা মাস্ট। শিশু অভিনেতা যারা এই ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনয় করতে আসছে, তাদের বাবা মায়েদেরই সেই ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। তা না হলে এই বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যৎ খুব বড়সড় প্রশ্নের মুখে পড়বে।’
রাহুল-সন্দীপ্তার ছোটপর্দার রসায়ন সর্বজনবিদিত। ‘তুমি আসবে বলে’র পর সন্দীপ্তা-রাহুল জুটির জনপ্রিয়তাও ‘আয় খুকু আয়’ ধারাবাহিকের অন্যতম ইউএসপি। অটিস্টিক আবিরকে ফুটিয়ে তুলতে রাহুল যেমন ‘আই অ্যাম স্যাম’-এর শন পেন থেকে শুরু ‘মাই নেম ইজ খান’-এর শাহরুখ খানকে অনুসরণ করছেন, সন্দীপ্তাও তেমন নিজের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতাকেই পাথেয় করেছেন রানি চরিত্রটিকে প্রাণবন্ত করতে। রানি সেই পরিবারের পুত্রবধূ, যেখানে এখনও কন্যাসন্তান জন্মানোটাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। মনোবিদ সন্দীপ্তাও কেস স্টাডি করতে গিয়ে এমন অনেক পরিবারের সংস্পর্শে এসেছেন। সেইসঙ্গে রয়েছে টেলিভিশন দুনিয়ায় তাঁর স্ট্রাগলের ইতিবৃত্তও। তাই রানির মতোই স্পষ্ট কথা বলতে বাঁধে না সন্দীপ্তার।