কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় মানসিক অস্থিরতা থাকবে। ... বিশদ
অতি সম্প্রতি অসমে এনআরসি কার্যকর করার সঙ্গেই গোটা প্রক্রিয়ার শুরু। আর তারপর রোজ নিয়ম করে দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ঘোষণা, সারা দেশেই এনআরসি হবে। অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ানো হবে ২০২৪-এর আগেই। এই একটা হুঙ্কারই সর্বত্র এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আবার ভিটেমাটি হারানোর আতঙ্ক আর ভীতি চেপে বসেছে বাংলার মানুষের মনে। না, ভুল বললাম, গোটা দেশে। বাজারে পেঁয়াজ দেড়শো টাকা ছাড়াচ্ছে। সব্জির বাজার আগুন। ভয়ঙ্কর মন্দা আর সেইসঙ্গে বিক্রি ও চাহিদার অভাবের ত্র্যহস্পর্শে শিল্পে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। চাকরি নেই, উল্টে কাজ হারিয়ে নতুন করে বেকার বাড়ছে। ছোট ব্যবসায়ীদের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে, এর থেকে এখনই পরিত্রাণের কোনও উপায় নেই। জিডিপি কমতে কমতে ৪.৫-এ এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যাঙ্কগুলো ডুবছে। অথচ, সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই সরকারের। তারা এখন মেতে রয়েছেন শরণার্থী আর বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে। মুসলিম-অমুসলিম বিভাজন ঘটানোর ভয়ঙ্কর খেলায়। এই সাম্প্রদায়িক আগুন নিয়ে খেলার শেষ কোথায় কে জানে! গেরুয়া শিবির বলছে, বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতেই এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ করাতে কেন্দ্র বদ্ধপরিকর। আর বিরোধীদের সমালোচনা, আরএসএসের পুরনো এজেন্ডা হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতেই এতটা মরিয়া মোদি সরকার।
দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে ইতিমধ্যেই কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি ঘটিয়েছেন মোদি ভাই-অমিত ভাই জুটি। বেআইনি হয়ে গিয়েছে তাৎক্ষণিক তিন তালাকও। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণেও দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও সুপ্রিম কোর্টের আইনি সম্মতি মিলেছে। এবার অনুপ্রবেশকারী মুসলিম হটাও অভিযান। সবমিলিয়ে দেশজুড়ে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার আয়োজন জোর কদমে। শেষ যেটা বাকি ছিল, আগামীকাল, সোমবারই সেই চূড়ান্ত অগ্নিপরীক্ষায় নামছে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের সরকার। সোমবারই লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পেশ হওয়ার কথা। বলা বাহুল্য, এই বিলের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। যদি দ্রুত সরকার এই বিলটিকে রাজ্যসভা ও লোকসভায়, অর্থাৎ সংসদের দুই কক্ষেই পাশ করাতে সক্ষম হয় তাহলে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই আমূল বদলে যাবে। তখনও দেশের প্রতিটি মানুষ সমান, প্রত্যেক ধর্মের একই স্থান, আমাদের সংবিধানের এই দর্শন আর উপলব্ধির কোনও তাৎপর্য থাকবে কি?
বলা বাহুল্য এনআরসিকে ভোটের বাক্সে আরও বেশি করে ফলপ্রসূ ও কার্যকর করতে তড়িঘড়ি এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনছে বিজেপি। এনআরসির জন্য যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের এবং সেইসঙ্গে শিখ, পার্সি, বৌদ্ধ, জৈন সম্প্রদায়ের মানুষকে কোনও ঝামেলা পোহাতে না হয় সেই জন্য। ইতিমধ্যেই অসমে যে ১৯ লক্ষ লোকের নাম চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা থেকে বাদ গিয়েছে, তার মধ্যে ১২ লক্ষই হিন্দু! এতে অসমে বেশ কিছুটা ব্যাকফুটে ক্ষমতাসীন বিজেপি। এই একটা তথ্যই বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির কোর ভোট ব্যাঙ্কটাকে বিপদে ফেলছে। আর সেই জন্যই মোদি-অমিত শাহের যুগলবন্দিতে চলা সরকার এবার ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের এই ধুরন্ধর চালটি চালতে চলেছেন।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল কার্যকর হলে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে যেসব হিন্দু, শিখ, জৈন, পার্সি, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁদেরই শুধু নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। বাকিদের নয়। এর থেকেই বোঝা যায় উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। বিজেপি আরএসএসের প্রধান লক্ষ্যই হল, নির্দিষ্ট তিনটি প্রতিবেশী দেশে নির্যাতনের শিকার ও আশ্রয়প্রার্থী অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দিয়ে ভারতের মূল স্রোতে শামিল করা। শোনা যাচ্ছে, সংখ্যালঘু অনুপ্রবেশকারী মুসলিমদের জন্য অন্য বন্দোবস্ত। সেখানে লাখ টাকার প্রশ্ন, অনুপ্রবেশকারী সংখ্যালঘু মুসলিমদের অতঃপর ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে, না কি ভারত থেকে পত্রপাঠ বের করে দেওয়া হবে? আরও একটি সংগত প্রশ্ন উঠছে, ভারতের সংবিধান এবং প্রাচীন ঐতিহ্য আদর্শ মানলে ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে কাউকে নাগরিকত্ব দেওয়া যুক্তিযুক্ত কি? বিরোধীরা এই যুক্তিতে সরব হয়েছেন যে, এতে সংবিধানের আত্মার অবমাননা করা হচ্ছে। সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এদেশে সবাই সমান। মানুষে মানুষে এমন বিভেদ করার কোনও সুযোগ এখানে নেই। ধর্ম এদেশে নাগরিকত্ব লাভের কোনও মাপকাঠি বা শর্ত হতে পারে না। অথচ স্বাধীনতালাভের আগে দেশভাগের সময় থেকে যে বিষ আমরা বয়ে চলেছি সেই দ্বিজাতি তত্ত্বের লক্ষ্যপূরণে এবার মরিয়া হয়ে নেমেছে শাসক বিজেপি ও তার প্রাণভোমরা আরএসএস। ভারতকে ধীরে ধীরে ১০০ কোটি হিন্দুর দেশে পরিণত করাই এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের লক্ষ্য।
তবে, উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির সরকার বিপন্ন হতে পারে এই আশঙ্কায় অরুণাচল, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড যেখানে ইনারলাইন পারমিট বহাল আছে সেখানে এই বিল কার্যকর করা যাবে না বলে সংশোধনীতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ, নাগরিকত্ব নিয়ে বিতর্কের জেরে উত্তর-পূর্বে নিজের ভিত্তি দুর্বল করতে চায় না বিজেপি। অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরার মতো রাজ্যে যেসব এলাকা ষষ্ঠ তফসিলের আওতাভুক্ত সেখানেও এই বিল কার্যকর হবে না। অর্থাৎ মূলত হিন্দিবলয় এবং পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে চূড়ান্ত কোণঠাসা করে ভোটবাক্সে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করাই অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদি জুটির প্রধান লক্ষ্য। তা করতে গিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ, এবং স্বাধীনতার সময়েও সংবিধান প্রণেতারা যেটা হতে দেননি, সেই হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য থেকে কোনওভাবেই বিচ্যুত হতে চায় না গেরুয়া শিবির। দেশভাগের উপর্যুপরি ক্ষত আমাদের বাংলার শরীরে এখনও দগদগে হয়েই রয়েছে। এই অবস্থায় এনআরসি যাতে বাংলায় বুকে নতুন করে কোনও ক্ষত সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে প্রতিটি মানুষকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই কারণেই দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য আপামর জনসাধারণকে তৈরি হতে বলেছেন। সেই দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনই স্থির করবে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে না কি অটুট থাকবে। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে সারা দেশে এনআরসি এবং অযোধ্যায় রামমন্দির গড়া সম্পূর্ণ হলে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার পথে আর একটাই মাত্র বাধা অবশিষ্ট থাকবে—অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। অর্থাৎ, এক্ষেত্রেও শেষ রক্ষাকবচটিও হারাতে পারে মুসলিম সমাজ। আরএসএসের স্বপ্নের সেই হিন্দুরাষ্ট্র গড়ারই পদধ্বনিই কি শোনা যাচ্ছে মোদি-শাহ জুটির কণ্ঠে? আর সেই ভয়ঙ্কর চেষ্টার সামনে আবারও মানুষের ঢাল হয়ে দাঁড়াবার সঙ্কল্পে অবিচল বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তিনিই পারেন বাংলার মানুষের আর একবার অনৈতিকভাবে উদ্বাস্তু হওয়া ঠেকাতে।