কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় মানসিক অস্থিরতা থাকবে। ... বিশদ
আজ যখন কেন্দ্রীয় সরকার নানাভাবে বিলগ্নিকরণ, প্রাইভেটাইজেশন ইত্যাদি গালভরা নামের মধ্য দিয়ে সব বেচে ফাঁকা তহবিল ভরাট করার চেষ্টা করছে, তখন আমার ছেলেবেলার বন্ধু ওই ঘন্টেশ্বরের কথা মনে পড়ে গেল। ওদের ছিল নামেই তালপুকুর ঘটি ডোবে না। এই সরকারের এখন রাজকোষ শূন্য। তাই প্রয়োজনের তাগিদে অনেক কিছুই এক এক করে বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এই প্রাইভেটাইজেশন নিয়ে হাটে বাজারে নানা গালগল্পও ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গিয়েছে। হাটে-বাজারে, বাসে-ট্রেনে কান পাতলেই মানুষের নানা কথোপকথন আজ আমাদের কানে আসে। একজনকে সেদিন বাজারে বলতে শুনলাম। তিনি চায়ের দোকানে বসে অপর একজনকে বলছিলেন, ‘এখন দেশে বেচু যুগ চলছে। কত কিছু বেচে দিচ্ছে। একদিন তিল তিল করে এগুলি গড়ে উঠেছিল।’ অপরজন বললেন, ‘বলছে নাকি প্রাইভেটাইজেশন।’ আর একজন বললেন, ‘ওটা আসলে হবে প্রায়বেচাইজেশন’। আর একজন বললেন ‘উহুঁ, প্রায়বেচাইনেশন। মানে প্রায় সবকিছু বেচে যখন নেশন চালাতে হয়, তখনই তাকে বলে প্রায়বেচাইনেশন।’
ব্যাপারটা নিয়ে যতই হাসি মস্করা করি না কেন, এটা বলতে কিন্তু দ্বিধা হওয়ার কথা নয় যে আমাদের দেশের আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট তলানিতে পৌঁছে গিয়েছে। সেটা যেমন দেশের মানুষ বুঝতে পারছেন, তেমনই সরকারপক্ষও বুঝতে পারছে। কিন্তু তারা তা স্বীকার করছে না। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে অবশ্য সরকারকে অনেক সত্যই গোপন করতে হয়। তার একটা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকে। এখন সরকার ছেঁড়া কাপড়ে রেশমি ফুল বোনার চেষ্টা করে দেশের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে সব ঠিক আছে। সব যে ঠিক নেই এখন এটা শিশুও বোঝে। বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্তের কুফল ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। যতদিন যাবে, ততই দৈন্যদশা প্রকট হয়ে উঠবে।
‘আচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন দেখালেই ভোট বাক্স কিন্তু ভরে ওঠে না। ১৯১৬ সালের ৮ নভেম্বর নোটবাতিল করে যে বিষবৃক্ষের ফল পোঁতা হয়েছিল, তার বিষময় ফল ফলতে শুরু করেছে। একক ব্যক্তিত্বের
ভুল আজ কাঁটা হয়ে ফুটছে। সেদিনও তিনি স্বীকার করেননি কাজটা ভুল হয়েছিল, আজও তিনি
স্বীকার করেন না, অর্থনীতিটা আসলে গোল্লায়
গিয়েছে। আচ্ছে দিনের স্বপ্ন ঘিরে কালো ধোঁয়া।
এই তো সরকারি রিপোর্টই বলছে, চলতি বছরে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে জিডিপি বৃদ্ধির হার নেমে গিয়েছে ৪.৫ শতাংশে। আমরা যেন সেই স্বাধীনতার সময়কার অর্থনীতির দিকে হাঁটছি। ১৯৯১ সালে মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে অনেকটা সাবালক হয়েছিল আমাদের দেশের অর্থনীতি। তখন জিডিপি ছয় শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। কিন্তু বিজেপি সরকারের আমলে নানা পরীক্ষা এবং তুকতাক সেই সূচককে নিম্নগামী করা তুলেছে। দেশটাই এখন আমার সেই বন্ধু ঘন্টেশ্বরের পরিবারের মতো।
এর থেকে বেরতেই হবে। দশে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ। সবাইকে নিয়ে ভাবতে হবে। দেশের ভালো বা মন্দের ভাবনাটা কারও একার হতে পারে না। আর এনিয়ে ব্যক্তিগত ইগো বজায় রাখার চেষ্টা সার্বিক ধ্বংসের দিকেই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, এই সঙ্কট কাটাতে গেলে সরকারের উচিত সবাইকে নিয়ে একটা বৈঠক ডাকা। সকলে মিলে নতুন আলোর সন্ধান করা।
এই ভাঙনটা যে আসবেই সেটা কিন্তু আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। সরকারের অর্থনীতি সংক্রান্ত মত মানতে না পেরে একের পর এক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা সরকারের সংস্রব ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। আজ আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে কেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে সরে গিয়েছিলেন। কোনও চাপের মুখে কি তাঁরা সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন? নাকি সরকারের কোন নীতির প্রতি তাঁরা অনাস্থা প্রকাশ করেছিলেন? নাকি তাঁরা অর্থনীতিটা ঠিক বুঝতেন না?
রঘুরাম রাজনের কথাই ধরা যাক। অসাধারণ কেরিয়ার তাঁর। অর্থনীতিতে তিনি কোনওদিন নোবেল পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মনমোহন সিংয়ের মতো বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদ তাঁকে সরকারের অর্থনীতির রূপায়ণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মোদিযুগে তাঁকে চলে যেতে হল। অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যমও এক বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদ। তিনি তাঁর কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে পদত্যাগ করে চলে গেলেন। কী ঘটেছিল তাঁর সঙ্গে? চলে যেতে হল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত প্যাটেলকেও। আর একজন হলেন বিরল আচার্য। ছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর। তিনিও তাঁর মেয়াদ শেষের আগে পদত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। এসবের উত্তর মেলেনি। কিন্তু কারণটা বোধহয় বুঝতে অসুবিধা হয় না। বিশেষ করে আজ যখন অর্থনীতির এই অবস্থা! আসলে সকলেই বুঝেছিলেন ভেঙে পড়াটা সময়ের অপেক্ষামাত্র। কিন্তু তার জন্য তিনি যেন নিজে দায়ী না হয়ে যান।
ভাবতে হবে কেন গাড়ি বিক্রির সংখ্যা হঠাৎ কমে গেল! সরকার পক্ষের লোকজন সঠিক ব্যাখ্যা না দিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে একের পর এক বিভ্রান্ত করার প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলেন। কেউ বললেন, ওলা-উবেরের জন্য গাড়ি বিক্রি কমেছে। কেউ দেশের অর্থনীতির হাল ভালো বোঝাতে গিয়ে সিনেমার টিকিট বিক্রি তো ভালোই হচ্ছে বললেন। এতে কি মানুষের কাছে নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে না!
কবি জীবনানন্দের সেই কবিতাটা অনেকেই জানেন। সেটা এক শাশ্বত সত্যের দিকনির্দেশ করে। ‘যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা।’
শরীরে ঘা যদি সত্যিই হয়, সেটা সারাতে হয়, প্রসাধনে ঘা ঢেকে রাখলে কয়েকদিন তাকে লুকানো যায়। কিন্তু অচিরেই তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তখন শত ওষুধেও কোনও কাজ হয় না। সরকার এই তত্ত্বটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে, ততই দেশের, দশের এবং তাদের পার্টিরও মঙ্গল হবে।
নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ যেভাবে বিভিন্ন রাজ্যে কম শক্তি নিয়েও একের পর এক কৌশল রচনা করে ক্ষমতা দখল করছেন, তার কিয়দংশও যদি অর্থনীতির পিছনে ব্যয় করতেন, তবে আজকের এই ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা হতো না। অবশ্য মহারাষ্ট্র দেখিয়ে দিল, এসব কৌশলে আর কাজ হবে না। সেখানে সরকার গড়তে গিয়ে মুখ পুড়েছে বিজেপির। ঠিক তারপরেই দেখা গেল রাজ্যের তিন কেন্দ্রে উপনির্বাচনে সাফ হয়ে গেল বিজেপি। লোকসভা ভোটের ফল দেখে অকারণ স্বপ্ন দেখার শুরু হয়েছিল।
স্বপ্ন সফল করতে গিয়ে শুরু হয়েছিল তৃণমূল ভাঙানোর খেলা। কিন্তু অচিরেই ধাক্কা খেল সেই প্রক্রিয়া। একটা কথা বুঝতে হবে, অমিত শাহ যত বলবেন, এখানে এনআরসি হবেই, বিজেপির ভোট ততই কমবে। একদিন কম খেলে মানুষ ফুঁসে উঠবে না। কিন্তু তাকে মাটি থেকে উৎখাত করলে সে বিদ্রোহ করবেই। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম সিপিএমকে সে কারণেই উচিত শিক্ষা দিয়েছে। বিজেপিকেও সেই শিক্ষা পেতে হবে। এই তিন কেন্দ্রের উপনির্বাচন তার নমুনা মাত্র।
আরও প্রমাণ আছে। অসমে বিজেপি সরকারের এখন এনআরসি রিপোর্ট নিয়ে ভিক্ষে চাই না মা কুকুর সামলা অবস্থা। সরকারই কেন্দ্রের কাছে আর্জি জানিয়ে বলেছে, এই রিপোর্ট অবিলম্বে প্রত্যাহার করা দরকার। অসমের বিজেপি পার্টি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে চিঠি দিয়ে বলেছে, অবিলম্বে এই রিপোর্ট প্রত্যাহার না করলে আগামী নির্বাচনে বিজেপি সেখানে সাফ হয়ে যাবে। সে রাজ্যের হিন্দু এবং মুসলিম দুই পক্ষই তীব্র রাগে ফুঁসছে। গতকাল রবিবার তড়িঘড়ি এনিয়ে অমিত শাহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে, নৈঋতে জমছে সিঁদুরে মেঘ। অসম থেকে শিক্ষা নিয়ে এরাজ্যের মানুষও বুঝেছে, এনআরসি হলে শুধু মুসলিমদের গায়েই আঁচ পড়বে, তা কিন্তু নয়। নগরে আগুন লাগলে দেবালয় কখনও আগুনের হাত থেকে রক্ষা পাবে না।
আর এসব থেকে চোখ ঘোরাতে দেশভক্তির কথা শোনানো হচ্ছে। কিন্তু কেন হঠাৎ দেশভক্তির কথা! এটা তো কোনও স্বাধীনতার লড়াই নয়। এটা বিদেশি শক্তির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার লড়াইও নয়। এখন লড়াই ক্ষুধার বিরুদ্ধে। এখন লড়াই নিজের অস্তিত্বহীনতার বিরুদ্ধে। এখন লড়াই দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এখন লড়াই দুর্বল অর্থনীতির বিরুদ্ধে। ধর্মের দোহাই দিয়ে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রচারের বিরুদ্ধে। এখন লড়াই করতে হবে শিক্ষার স্বার্থে, স্বাস্থ্যের স্বার্থে, আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থে, একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থে। এইটুকুই তো মানুষ চায়। তার চাহিদা তো বেশি নেই। ক্ষুন্নিবৃত্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান।
এটুকু হলেই মানুষ ধন্য ধন্য করবে। এসব থেকে মুখ ঘোরাতে যদি দেশভক্তির মলম লাগাতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা চলছে। দেশভক্তিটা আবেগের। সেটা আপনা আপনিই জন্মায়। দেশভক্তিকে শৃঙ্খলের মতো ব্যবহার করলে তখন আর দেশভক্তি থাকে না। বরং উল্টে মানষের মনেই প্রশ্ন জাগে। তাঁদের কেউ হয়তো বলবেন, ‘স্যার আপনি যে আচ্ছে দিন আনবেন বলেছিলেন তার কী হল? আজ আমাদের এমন বুরা হাল কেন?’ তখনই হয়তো আর এক পক্ষ যাত্রার বিবেকের মতো গেয়ে উঠবে, ‘আচ্ছে দিন আনবে তুমি এমন শক্তিমান, তুমি কি এমন শক্তিমান?’