কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় মানসিক অস্থিরতা থাকবে। ... বিশদ
ঘটনার পর অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হবে। তারপর চলবে তার বিচার। কবে সে বিচার শেষ হবে, কেউ জানে না। উল্টে বিচারের সময় মেয়েটিকে নানা ধরনের প্রশ্নে প্রকাশ্য কোর্টে আরও একবার অপমানিত হতে হবে। আমরা তার নমুনা দেখেছি তপন সিংহের সাহসী ছবি ‘আদালত ও একটি মেয়ে’তে। এখনও সেরকমই চলছে। এখনও কত প্রশ্ন ওঠে। মেয়েটির বয়স কত, ধর্ম কী, মেয়েটির স্বভাবচরিত্র ঠিক ছিল কিনা! বিচার চলবে, চলবে, চলবে। আর মেয়েটার উপর হুমকি আসতেই থাকবে। তাকে কখনো গাড়িতে ধাক্কা মেরে খুন করার চেষ্টা হবে। কখনো পুড়িয়ে মারারও চেষ্টা হবে। এসব দেখে বিচারপ্রক্রিয়ার উপর মানুষের বিশ্বাস ক্রমে ক্রমে টলে যাচ্ছে। এটা একটা বিপজ্জনক দিক। হায়দরাবাদের ঘটনায় অভিযুক্ত চারজনকে পুলিশ যখন এনকাউন্টারে মেরে ফেলল, তখন সারা দেশ উল্লাসে বলে উঠেছিল, ঠিক হয়েছে। এতেই বোঝা যায় সাধারণ মানুষের ভিতরে কতটা আগুন ধিক ধিক করে জ্বলছিল। এভাবে নিশ্চয়ই অপরাধীদের শাস্তি হতে পারে না। কিন্তু মানুষের সমর্থন দেখে একটাই কথা মনে হয়েছে, বিচারের বাণী এভাবে নীরবে নিভৃতে কাঁদুক, এটাও মানুষের পছন্দ নয়। পছন্দ নয় দীর্ঘমেয়াদি বিচার প্রক্রিয়াও। তাই বিচারের বাইরে এই ধরনের শাস্তিতে প্রায় সকলের উল্লসিত মানসিকতাই প্রকাশ পেয়েছে। সভ্য মন বলছে, এটা নিশ্চয়ই কাম্য নয়। কিন্তু ভিতরের রোষ বলছে, চাই এনকাউন্টার। এটাই তো গণরোষ। আইন যখন দুর্বল হয়, গণরোষ তখন প্রবল শক্তি ধারণ করে। একটা কথা বলতেই হয় যে, হায়দরাবাদ পুলিশের এই এনকাউন্টার নিশ্চয়ই অপরাধপ্রবণতা কমাবে। বিচারব্যবস্থা যে ভয় অপরাধীদের দেখাতে পারেনি, এই এনকাউন্টার কিছুটা হলেও সেই ভয় তৈরি করতে সক্ষম হবে। এখানেই এই এনকাউন্টরের সার্থকতা বলে সকলের মনে হয়েছে। অর্থাৎ আইন তাদের এত তাড়াতাড়ি শাস্তি দিতে পারত না। সারা দেশে উল্লাসের মধ্য দিয়ে কার্যত সেই মনস্তত্ত্বই প্রকাশ পেয়েছে।
কিন্তু এই এনকাউন্টার শেষ কথা হতে পারে না। এই ক্ষমতা পুলিসের হাতে চলে গেলে সমস্ত ব্যবস্থা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। কত ফেক এনকাউন্টারে পুলিস কত যে নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলেছে, তার হিসাব নেই। আমাদের রাজ্যে ১৯৭১ সালের ঘটনা আমরা ভুলে যাইনি। সেদিন কত যে নিরীহ, মেধাবী ছেলেকে পুলিস নকশাল বলে তুলে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে দিয়েছিল, তার হিসাব নেই। আমাদের দেশে আইনরক্ষক পুলিসের ভূমিকা খুবই বিতর্কিত। বহু উর্দিতে লেগে আছে অনেক কলঙ্কের দাগ। লক আপে ধর্ষিত হওয়ার ঘটনাও আমাদের দেশে কম ঘটেনি। সুতরাং আজ পুলিস পুষ্পবৃষ্টিতে অভিনন্দিত হলেও, ক্ষমতা তাকে বিপথে নিয়ে যাবেই। এই রক্ষকই যে ভক্ষক হয়ে ওঠে এটা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। তাই সব ক্ষেত্রে এনকাউন্টার শেষ কথা হতে পারে না।
কিন্তু গণরোষ ফিরে ফিরে আসবেই। কারও শক্তি নেই তাকে থামানোর। যুগে যুগে প্রমাণ হয়েছে মানুষের শক্তিই সবথেকে বড়। এই গণরোষ দেখেছিল নাগপুর। ২০০৪ সালে ধর্ষিতা মেয়েরা একত্রিত হয়ে কোর্টেই মেরে ফেলেছিলেন আক্কু যাদবকে। দিনের পর দিন কস্তুরবা বস্তির মেয়েরা আক্কুর শিকার হয়ে উঠছিলেন। প্রভাবশালী হওয়ায় আইন তাকে ছুঁতেও পারছিল না। এর মধ্যেই সমাজকর্মী ঊষা নারায়ণের নেতৃত্বে বস্তির মেয়েরা ফুঁসে ওঠেন। সেদিন কোর্টে হাজির করা হয় আক্কুকে। কোর্ট চত্বরে উপস্থিত মেয়েদের দেখে সে বলে ওঠে। ‘আজই জামিন পাব, বেরিয়ে এসে তোদের দেখে নেব।’ সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ২০০ মেয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। কারও হাতে চাকু, কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে লঙ্কাগুঁড়ো। বিধাতার শাস্তি গণরোষ হয়ে নেমে আসে। সেখানেই খতম হয় আক্কু যাদব। পরিস্থিতি আবার সেইদিকেই এগচ্ছে।
একটা কথা আমার গত কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছে, যে দেশে সীতাদের ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারা হয়, সে দেশেই আবার ঘটা করে রামমন্দির নির্মাণ করা হয়। এতেই বোঝা যায় এই রামমন্দির নির্মাণ আসলে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা ছাড়া আর কিছু নয়। অযোধ্যা থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরে উন্নাওয়ে দুটি মেয়ে লাঞ্ছনার শিকার। তাদের একজনকে অভিযুক্তরা গাড়ি দিয়ে পিষে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল আর একজনকে অভিযুক্তরা পুড়িয়ে মেরে দিয়েছে। একটি ঘটনায় স্বয়ং বিজেপি বিধায়ক অভিযুক্ত। এ কোন বর্বরতার দিকে হাঁটছি আমরা! সেটাও কি আর এক রামরাজ্য? আর কতজন মেয়ে ধর্ষিতা হলে আমরা সেই রামরাজ্য পাব?
যোগীর রাজ্যে দেখেছি গোরক্ষকরা খুব তৎপর। কেউ গোমাংস নিয়ে গেলেই বেদম গণপিটুনি দিয়ে তাদের ‘অপরাধের’ শাস্তি দেওয়া হয়। অনেক সময় তাদের প্রাণবায়ুও বেরিয়ে যায়। তাই উত্তরপ্রদেশের এমন অন্ধকার সময়ে আমরা শরণাপন্ন হতে পারি, সেই সব গোরক্ষকদের। বলতে পারি, হে গোরক্ষকগণ, তোমাদের রাজ্যের মেয়েরা কী দোষ করল? এমন প্রয়োজনীয় সময়ে গোমাংস ধরার চেয়ে ধর্ষণকারীদের ধরা অনেক মহৎ ও পুণ্যের কাজ। তোমরাই বিচার করে দেখ, একটা গোরুর থেকে মানুষের প্রাণের দাম কিংবা একজন নারীর শ্লীলতার দাম কম না বেশি?
হায়দরাবাদের ঘটনা আমাদের দেশের মানুষের ভিতরে একটা আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। এই ক্রোধটা স্বাভাবিক। কিন্তু দিকে দিকে ধর্ষণের উল্লম্ফন দেখে যে সুশীল সমাজ, ছাত্রসমাজ কিংবা সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন, তাঁদেরই কারও কারও লালসার কলুষিত স্পর্শে বিব্রত হন বাসের মহিলা যাত্রী, হাটে বাজারে বা মলে কোনও মেয়ে। কিংবা কোনও স্কুলের শিক্ষকের বা পুলকারের চালকের ‘ব্যাড টাচ’ লেগে যায় বালিকার অঙ্গে। ফেসবুকে কেউ আপলোড করে দেয় বান্ধবীর অশ্লীল ছবি! তাদের শাস্তি দেবে কে? মানসিকতা না বদলালে মেয়েরা নিত্যদিন সমাজে অপমানিত, লাঞ্ছিত হতেই থাকবে। একটা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মেয়েরা বেশি লাঞ্ছিত হয় তাদের পরিচিত জনের কাছ থেকেই। কে দেবে তাদের শাস্তি? কিংবা শ্লীলতাহানির অভিযোগে অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ধর্মীয় গুরু, পুলিস কর্তা, শিল্পপতি, আইনজীবী এই ধরনের মানুষদের এনকাউন্টারে ওড়াবেন কোন পুলিসকর্তা?
এর মধ্যে আবার দেখি ফোঁস করে ওঠেন মানবাধিকারবাদীরা। এইসব নৃশংস পশুদের ফাঁসি দেওয়ার কথা বললে তাঁরা মানবাধিকারের কথা বলেন। কার জন্য মানবাধিকার! ওই পশুদের জন্য? মানুষের দেহ ধারণ করলেই কী মনুষ্য পদবাচ্য হয়? মানবাধিকার অবশ্যই মানুষের জন্য থাকুক। মানুষের দেহধারী পশুদের জন্য সেই মানবাধিকার প্রয়োগ করে যদি তাদের সোহাগ করা হয়, তবে সেই রাতের অন্ধকারে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মেয়েটা, দাউ দাউ আগুনে জ্বলতে থাকা মেয়েটা কি আমাদের গোটা সমাজটার মুখেই ঘৃণায় থুথু ছিটিয়ে দেবে না? বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, যেমন কুকুর তেমন মুগুর। অপরাধীকে যথোপযুক্ত শাস্তি দিতেই হবে। এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
১৯৯৮ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী এ পি জে আব্দুল কালাম একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তখনও তিনি রাষ্ট্রপতি হননি। সেই বক্তৃতার শেষে একটি নয়-দশ বছরের মেয়ে তাঁর কাছে অটোগ্রাফ নিতে এলে তিনি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি কী স্বপ্ন দেখো?’ মেয়েটি হাসিমুখে বলেছিল, ‘আমি উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখি।’ উত্তরটা শুনে চমৎকৃত হয়েছিলেন কালাম সাহেব। সেই মেয়েটির স্বপ্ন আর এক রকমের স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল কালাম সাহেবের চোখে। তিনিও স্বপ্ন দেখলেন, টোয়েন্টি টোয়েন্টি। অর্থাৎ তখন তিনি স্বপ্ন দেখলেন আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ভারত কীভাবে উন্নত দেশ হয়ে উঠতে পারে। লিখেছিলেন, ‘ইন্ডিয়া ২০২০: আ ভিশন ফর দ্য নিউ মিলেনিয়াম’। আর কয়েকদিন পরেই আমরা পৌঁছে যাব ২০২০ সালে। আজ কালাম বেঁচে থাকলে দেখতেন কীভাবে তাঁর স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত। শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, অর্থনীতিতে, ক্ষুধায়, নারীদের লাঞ্ছনায় দেশ আজ পিছন দিকে হাঁটছে। আর রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে চলছে ক্ষমতার পিঠে ভাগাভাগি। শত ধিক বললেও হবে না কোনও কাজ। কেননা ক্ষমতাই একমাত্র সত্য তাহার উপরে নাই। সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!