কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় মানসিক অস্থিরতা থাকবে। ... বিশদ
বারাণসীতে জটলা কোর্ট চত্বরে। আইনজীবী এবং সাধারণ মহিলারা আছেন সেখানে। মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন একে অপরকে।
চুঁচুড়ায় পুলিসকর্মীদের হাতে রাখী পরাচ্ছেন যুবতীরা।
মুম্বইতে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছেন মহিলারা। একজন সামনে দাঁড়িয়ে নাগাড়ে ড্রাম বাজিয়ে যাচ্ছেন। চলছে স্লোগান... এতদিনে পুলিস একটা কাজের কাজ করল।
এই সব ছবি শুক্রবারের। সকাল ৮টা নাগাদ শোনা গিয়েছিল খবরটা। আর দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল আগুনের মতো। হায়দরাবাদের ২৫ বছরের পশু চিকিৎসককে গণধর্ষণে যারা অভিযুক্ত ছিল, সেই চারজনকে এনকাউন্টারে নিকেশ করেছে তেলেঙ্গানার পুলিস। ব্রিজের উপর তখন সার বেঁধে মানুষ দাঁড়িয়ে। নীচ দিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে পুলিস যাচ্ছে, আর তাদের উপর হচ্ছে পুষ্পবৃষ্টি। গোটা দেশ একবাক্যে সমর্থন করেছে এই এনকাউন্টারকে। মতটা স্পষ্ট, এমনই হওয়া উচিত ছিল। নৃশংসতা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। নির্ভয়া কাণ্ডের বিবরণ শুনে শিউরে উঠেছিল ভারত। প্রতিবাদে নেমে পড়েছিল রাস্তায়। নাঃ, কোনও রাজনৈতিক দলের আয়োজন ছিল না। সবটাই ছিল স্বতঃপ্রণোদিত। নির্ভয়াকে হয়তো বাঁচানো যায়নি। তাঁর লড়াই শেষ হয়ে গিয়েছিল হাসপাতালের বিছানায়। কিন্তু সেই প্রতিবাদের ঝড় ধর্ষণের মতো অপরাধ সংক্রান্ত আইনে বদল আনতে বাধ্য করেছিল। নাবালক যদি এই নৃশংসতা দেখাতে পারে, তাহলে তার বিচারও জুভেনাইল আদালতে হতে পারে না। সংশোধিত আইনে এমন ঘটনায় নাবালককেও আজ সাবালক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, সেটাও কি যথেষ্ট?
না, যথেষ্ট নয়। তাই আজ ফের হায়দরাবাদের মতো ঘটনায় দেশ কেঁপে ওঠে। এরপর মালদহে উদ্ধার হয় যুবতীর দগ্ধ দেহ। উন্নাওয়ে জামিনে ছাড়া পাওয়া অভিযুক্ত প্রকাশ্যে গায়ে আগুন দেয় ধর্ষিতাকে। ত্রিপুরাতেও ধর্ষণের পর জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। মুজফ্ফরনগরে ধর্ষণের মামলা তুলে নিতে অস্বীকার করায় অভিযোগকারিণীর মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ে দুষ্কৃতীরা। একের পর এক এমন ঘটনা কী প্রমাণ করে? উত্তর একটাই, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আজ হয়তো আমরা নারী স্বাধীনতা, সমান অধিকারের স্লোগানে আকাশ-বাতাস কাঁপাই, কিন্তু শিকড়টাই যে পচে গিয়েছে!
হয়তো কাকতালীয়...। মাস দুয়েক আগে একটি হিন্দি ছবির ট্রেলার মুক্তি পেয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, রাজস্থানের কোটায় এক দুষ্কৃতী মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে এবং তারপর তার গায়ে আগুন দিয়ে দেয়। আশ্চর্যজনকভাবে তারপরই এ ধরনের ঘটনা আরও বেড়ে গেল। ধর্ষণের পর খুনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। সরকারের পক্ষ থেকে পাওয়া শেষ রিপোর্ট ২০১৭ সালের। ওই বছর দেশের ৩২ হাজার ৫০০টি ধর্ষণের ঘটনার অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। যাদের মধ্যে ৩০ শতাংশই নাবালিকা। ওই বছরের শেষ পর্যন্ত দেশের আদালতে মোট ১ লক্ষ ২৮ হাজার ধর্ষণের মামলা পড়ে রয়েছে, যার ফয়সালা হয়নি।
এই সব ঘটনাই খাতায়-কলমে নথিভুক্ত। অভিযোগ হয়নি, এমন বহু ঘটনা গ্রামে-গঞ্জের বাতাসে হারিয়ে যায়। আধপেটা খাওয়া পরিবারগুলোর বাড়ি থেকে মেয়েরা উধাও হয়ে যায়। কেউ ফিরে আসে। কেউ আসে না। পুলিস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগ নিতে চায় না। সেই সংখ্যাটা সরকারি হিসেব কখনও আসে না...। এক্ষেত্রে পুলিসকে আমরা ঠুঁটো, অপদার্থ, রাজনৈতিক দলের তাঁবেদার বলে গাল দিয়ে থাকি। কিন্তু পুলিস চাইলে পারে না, এমন কোনও কাজ নেই। সাইবারাবাদের ঘটনাই তার প্রমাণ। একদিকে উত্তরপ্রদেশে উন্নাওয়ের অভিযুক্ত ধর্ষিতার গায়ে আগুন দিচ্ছে, নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে পুলিস নির্বিকার। আবার অন্যদিকে তেলেঙ্গানায় এনকাউন্টারে খতম করে দেওয়া হচ্ছে বর্বরতার ধারক ও বাহক চার অমানুষকে। অর্থাৎ, পুলিস কাজ করছে। এখানেও আবার পাল্টা সমালোচনা, মানবিকতার হত্যা...। উভয় সঙ্কট পুলিসের। তারা কাজ না করলেও বিপদ, করলেও। মানুষ অবশ্য এই শ্রেণীর সরকারি কর্মীকে কখনওই সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে পারে না। কথায় আছে না, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিস ছুঁলে...। অনেক ক্ষেত্রেই শোনা যায়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ। কাউকে মাদক মামলায়, কাউকে ধর্ষণের। বর্তমানের এক সাংবাদিক বহু বছর আগে এমনই এক ‘দুর্ঘটনা’র সম্মুখীন হয়েছিলেন। উত্তর ২৪ পরগনার একটি থানায় ঢুকে দেখেছিলেন, গোরু পাচারকারীদের ধরে তাদের থেকে টাকা আদায় চলছে। টাকা দিলে মুক্তি, না হলে জেল। হঠাৎ সেই অফিসারের খেয়াল হয়, অন্য একটি লোক সেখানে দাঁড়িয়ে। তাঁর প্রথম কাজ হয়, বর্তমানের সেই সাংবাদিকদে লক আপে পোরা। তারপর সরাসরি হুমকি, দেব নাকি ধর্ষণের মামলায় ফাঁসিয়ে? কালকেই কোর্টে তুলব। এই ঘটনা প্রকাশ্যে এসে যাওয়ায় তখন রাজ্যজুড়ে তোলপাড় হয়েছিল। বিষয়টি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। সে অন্য প্রসঙ্গ। এই ঘটনা উত্থাপনের কারণ একটা বিষয়ই স্পষ্ট করে দেওয়া, পুলিস চাইলে সব করতে পারে। তাই আজ সাইবারাবাদের এনকাউন্টারের পর মানবাধিকার সংগঠনগুলি মাথা তুলেছে... ওরা তো অভিযুক্ত! দোষী সাব্যস্ত নয়। তাহলে এই এনকাউন্টারের মানেটা কী? রাত তিনটের সময় ঘটনার পুনর্নির্মাণ মোটেই আইনসঙ্গত নয়। ওই সময়টাতেই কেন নিয়ে যাওয়া হল? ভিডিওগ্রাফি কোথায়? ওই অভিযুক্তরা যে পুলিসের অস্ত্র ছিনিয়ে হামলা করে, তার প্রমাণ কী? ওরা এগিয়ে এসে পুলিসের অস্ত্র কেড়ে নিল, আইন রক্ষকরা তখন কী করছিলেন? এমন বহু প্রশ্ন কিন্তু সমালোচকরা তুলতে শুরু করেছেন। এর অপর একটা কারণ হল, সন্দেহের নেপথ্যে অতীতের আরও কিছু এনকাউন্টার রয়েছে। যা হায়দরাবাদ পুলিস করেছিল। একই যুক্তি, একই প্লট। কাজেই প্রশ্ন উঠবেই।
পুলিস অবশ্য এসবে গা করছে না। করবেও না। কারণ, গোটা দেশ আজ তাদের পাশে। জয়া বচ্চন সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এ ধরনের অপরাধীদের রাস্তায় পিটিয়ে, মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া উচিত। সেই বক্তব্যেই হয়তো সিলমোহর দিল তেলেঙ্গানার পুলিস।
আমরাও কি সম্পূর্ণ দায়মুক্ত হতে পারি? কোন মেয়ে কী জামাকাপড় পরে রাস্তায় বেরবে, কেন বেশি রাতে বাড়ি ফিরবে, এসবের উপর খবরদারি না করে বাড়ির পুত্রসন্তানের শিক্ষায় বেশি জোর দেওয়াটা বেশি দরকারি। এই সমাজকে বাসযোগ্য করে তোলার একটাই শিক্ষা, নারীসমাজকে সম্মান। সুরক্ষাটা সর্বতোভাবে সামাজিক। এবং এই সমাজের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়েই রয়েছে। জীবন, সম্মান... এই সবই সাংবিধানিক অধিকার। সমাজে ‘না’ শব্দটির অর্থ সর্বতোভাবেই ‘না’। এর বিরুদ্ধে কোনও জোর চলে না। চলতে পারে না। সমাজকে সচেতন করতে পারি আমরাই।
ওই চার দুষ্কৃতী কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকার করেছিল, ধর্ষণ ও খুন তারাই করেছে। এরপর তৈরি হতো চার্জশিট, তারপর বিচার। চার্জশিট তৈরি হতেই মাসের পর মাস চলে যায়। তার মধ্যে কখনও কখনও চলে আসে প্রভাবশালী তত্ত্ব। টাকার প্রলোভন। কেস হাল্কা করার চেষ্টা। এরপর নিম্ন আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট। মৃত্যুদণ্ডের আদেশ জারি হলেও বছরের পর বছর জেলে বসিয়ে করদাতাদের টাকায় ভরণ-পোষণ চলে ওই বজ্জাতদের। শেষ অস্ত্র রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা। কামদুনির মামলা এখনও হাইকোর্টে পড়ে রয়েছে। সরকারি এই দীর্ঘসূত্রতা ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। মনে হয়, এদের গুলি করে মেরে ফেললেই ভালো হতো। আর সেটাই হয়েছে। আইন হাতে তুলে নেওয়া ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে মোটেও কাম্য নয়। পুলিসেরও না। কিন্তু সমাজটাকে পশুর খোঁয়াড়ে পরিণত করাটাও তো মেনে নেওয়া যায় না! আজ তেলেঙ্গানা..., কাল যদি উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গে এই ‘সাজা’ কার্যকর হয়, তাহলে অন্তত দুষ্কৃতীদের মনে ভয়টা ঢুকবে। বিকৃত মনগুলো একবার হলেও ভাববে, পরিণতিটা কী হতে পারে। এনকাউন্টার সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু আমাদের আইনও তো এই ধরনের মামলায় নাবালকত্বের পর্যায়ে রয়ে গিয়েছে! চার্জশিট হয় না। মামলার ফয়সালা হয় না। হতাশা জন্ম দেয় বিরক্তির, রাগের। কিন্তু আমরা সমাজবদ্ধ জীব। হতাশায় কাঁদতে পারি। কিন্তু তারপরও উল্টোদিকের লোকটাকে বলি, কোর্টে দেখে নেব। কারণ, আমরা এখনও আইনে ভরসা রাখি। বিশ্বাস করি, আইনই পারে মানুষকে ন্যায়বিচার দিতে। দীর্ঘসূত্রতার গেরো কাটিয়ে আইন যদি আরও কঠোর হয়, এই ধরনের দুষ্কৃতীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়, তবেই মানুষের আস্থা বজায় থাকবে। গণতন্ত্রে সেটাই কাম্য। না হলে যেভাবে হোক, ন্যায়বিচার দাবি করবে জনগণ। মোরাদাবাদের ছাত্রীদের হাতের প্ল্যাকার্ড কিন্তু নিঃশব্দে সেই কথাই বলছে। বিচার চাই। যে কোনও পথে।