কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় মানসিক অস্থিরতা থাকবে। ... বিশদ
ডানদিকে ঘাড় ঘোরালেন জম। রাগে লাল হয়ে গেছে ফর্সা মুখ। প্রদীপের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে স্বভাববিরুদ্ধ ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠলেন, ‘শয়তান ছেলে। বিড়ি ফুঁকতে গেছিলে?’
দরজার বাইরে মুখ নিচু করে প্রদীপ তখন স্ট্যাচু। রাগে কাঁপছে স্যারের শরীর। একটু পরে রাগ কমে এল। তখন গলার স্বর অন্যরকম। বেশ মোলায়েম। ধীরে ধীরে বললেন, ‘প্রদীপচন্দ্র মণ্ডল, কোনও দিন দেরিতে ঢুকবে না আমার ক্লাসে, বুঝেছ?’
প্রদীপ ঘাড় নাড়ল আর ওখানেই সেদিন একটা ম্যাজিক ঘটে গেল। তবে বুঝতে পারলাম পরের দিকে।
প্রায় ফেল করতে করতে সিক্স, তারপর সেভেনে উঠেছে প্রদীপ। অনেকে ওকে হাটখোলার প্রদীপ বলে ডাকত। ওর বাড়ি ছিল হাটখোলায়। হাটখোলা এলাকাটা শহরের অনেকের কাছেই বেশ অচেনা। আমাদের কাছেও। ধরে নিতাম হাটের ধারেকাছে হবে জায়গাটা। কিন্তু কোন হাট? জানলাম অনেকদিন পরে।
অনেকগুলো হাট বসত শহরে। বড় হাটটা হাটখোলায়, অনেকটা জায়গা জুড়ে। চিত্তরঞ্জন মার্কেট তৈরি হল আর তার কংক্রিটের চত্বরে হারিয়ে গেল সাবেক ‘হাটখোলা’। তবে অল্প জায়গা নিয়ে পুরনো হাটখোলা পাড়াটা টিকে ছিল, এখনও আছে।
সরু ইটের রাস্তা, গায়ে গায়ে বাড়ি। কোনও বাড়ির মাথায় টালি কিংবা টিন। ইদানীং দু-একটা দোতলা বাড়ি উঠেছে। যেমন ঘোষদের বাড়ি। ওই দ্বিতল বাড়ির যুবকই এখন পৌরসভা আলো করে সভাপতির চেয়ারে বসেছেন। ঘোষদের নীল রঙের বাড়ির পাশেই প্রদীপদের একতলা বাড়ি।
প্রদীপচন্দ্র মণ্ডল। জেলা স্কুলে ফাইভে ভর্তি হয়েছে। দু-এক কামরার পাঠশালা ডিঙিয়ে পেল্লাই স্কুলের বেঞ্চিতে বসে সবার বুক ধড়ফড় করছে। তখনও ক্লাস শুরু হয়নি। প্রথম দিনই কমন রুমের বিশাল দরজা পেরিয়ে আমার পাশের বেঞ্চিতে এসে বসল প্রদীপ। শুকনো মুখ, বেশ নিরীহ ধরন।
পরে জেনেছি ওর বাবার চালের ব্যবসা। হাটখোলায় দোকান। চালের ব্যবসায় নাকি ইনকাম হয় না। তাই সব বই কেনা হয় না, কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হয় প্রদীপকে। বেশির ভাগ বিষয়ে টেনেটুনে পাস নম্বরটা পেত, তবে অঙ্কে একদমই ধেড়িয়ে যেত।
আমাকে বেশ সমীহ করে দূরত্ব রেখে চলত প্রদীপ। ক্লাসে ভালো ছাত্র ছিলাম, সেকেন্ড বা থার্ড বয়। আমার বাবা আবার শহরের নামী উকিল। সে কারণেই হয়তো প্রদীপ একটু দূরত্ব রাখত আমার সঙ্গে।
ফেল নম্বরের সঙ্গে গ্রেস মার্ক যোগ করতে করতে টেনে-টুনে সিক্স। তারপর গড়াতে গড়াতে সেভেনে উঠল প্রদীপ।
প্রথমদিকে যথারীতি পড়া না-পারা। বিধুবাবু বা অশ্বিনী বাবুর ক্লাসে বেঞ্চির উপর কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। দয়াময় স্যারের ক্লাসে নিল-ডাউন। এসব শাস্তির সঙ্গে লিকলিকে কালো পায়ে কঞ্চির সপাং সপাং বাড়ি খেত রোজ। মুখ বুজে মার খেত বেচারা। হাফ প্যান্টের নীচের দিকে— হাঁটুতে, পায়ের গোছায়— কালশিটের কালো দাগ বোঝা যেত না। তাই ক্লাস টিচার হাত খুলে মারতেনও খুব।
আমাকে একদিন বলল, ‘রং কালো বলে তোরা আমার পায়ে কালশিরা দেখতে পাস না। ফর্সা রং হলে না, জেব্রার পা হয়ে যেত আমার!’
তৎকালীন যাবতীয় নির্দয় শাস্তির পরেও ক্লাসে দেরি করে ঢোকে প্রদীপ। আর স্যাররাও জানেন, হস্টেলে গিয়ে উঁচু ক্লাসের কোনও এক বখাটে ফুটবলার ছাত্রের সঙ্গে বিড়িতে টান মারে প্রদীপ।
এই প্রদীপ হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় অঙ্কে ফেল। ওর বাবাকে ডেকে হেডমাস্টার মশায় দু’কথা শুনিয়েছেন। আমাকে কাঁচুমাচু মুখে প্রদীপ একদিন বলেছিল, ‘বাবা পড়া ছাড়িয়ে দেবে, জানিস।’
‘কী করবি তুই?’
‘কি আর করব! দোকানে বসে রামে রাম, রামে দুই করে চাল মাপব।’
ওর কথার উত্তরে কী বলেছিলাম মনে নেই। তবে সেই দিনটার কথা মনে আছে।
বিটি স্যার জগৎ মল্লিকের অঙ্ক ক্লাস। বিএড কলেজ থেকে যে স্যাররা আমাদের পড়াতে আসতেন, আমাদের ভাষায় তারা বিটি স্যার। জগৎ মল্লিক বিটি স্যার, ভালো পড়াতেন। উঁচু ক্লাসেও অঙ্ক করাতেন। তিন-চারদিনে আমাদের ক্লাসের সবার নাম মুখস্থ হয়ে গেছিল মল্লিক স্যারের। পদবী সমেত পুরো নাম ধরে ডাকতেন, যত বড় নাম হোক না কেন। যেমন পরাগ সিঞ্চন মুখোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত মজুমদার, পতিতপাবন হালদার। আবার অনেককে ডাকতেন সংক্ষিপ্ত নামে। যেমন সুব্রত রায়কে ডাকতেন এসআর, অরুণ সেনকে ডাকতেন অ্যাস।
সেদিন জ্যামিতি ক্লাসের বাইরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রদীপ। ওর দিকে নিবদ্ধ জগৎ মল্লিক স্যারের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি। খানিক পরে স্বাভাবিক হয়ে এল। স্যারের নিখুঁত কামানো গোঁফের কোণে চিলতে হাসি। ইশারায় প্রদীপকে ক্লাসে ঢুকতে বললেন। একটু থেমে একবার কেশে নিয়ে বললেন, ‘প্রদীপচন্দ্র মণ্ডল, মানে পিসিএম।’
এবার ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পিসিএম কে, তোমরা জানো?’ আমাদের নির্বাক মুখের দিকে পলক তাকিয়ে বললেন, পিসিএম মানে প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ। উনি কে ছিলেন?’
ফার্স্ট বয় সুবীর রায় বকের মতো গলা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। স্যার ওর দিকে তাকাতেই সুবীর বলল, ‘জানি না স্যার। আপনি বলুন।’
হাতের চকটা টেবিলে রেখে ক্লাসে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বিটি স্যার জগৎ মল্লিক চেয়ারে বসলেন। তারপর গমগমে গলায় বললেন, ‘পিসিএম মানে প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ। বিখ্যাত বিজ্ঞানী। ভারত সরকার ওঁর কথা শুনে চলে...।’
হঠাৎ পিছনের বেঞ্চি থেকে প্রদীপের স্বর, ‘আরেব্বাস।’ সবাই হেসে উঠল। একটু থেমে জম বললেন, ‘ফিজিক্স, অঙ্ক আর অর্থনীতিতে মহাপণ্ডিত পিসিএম। উনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট মানে আইএসআই। দেশ-বিদেশের ছেলেমেয়েরা রাশিবিজ্ঞান শিখতে আসে, রিসার্চ করে ওখানে, বুঝলে।’
আমরা বুঝদারের মতো মাথা নাড়লাম। বড় একটা শ্বাস ফেললেন মল্লিক স্যার। ওঁর মুখটা জ্বল জ্বল করে উঠল। একটু থেমে স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, ‘আমি ওই মহান বৈজ্ঞানিক প্রফেসর পিসিএমের ছাত্র।’
খানিক চুপ থেকে প্রদীপের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার নামও পিসিএম, নামটার সম্মান রাখবে কিন্তু।’
প্রদীপ দাঁড়িয়ে উঠে ঘাড় নাড়ল। জম ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর যে কোনও দরকারে আমার কাছে আসবে।’
পরদিন থেকে প্রদীপ বদলে যেতে লাগল। বদলটা প্রথম দিকে চোখে পড়েনি। তবে একদিন কমনরুমে শুক্রবারের লম্বা টিফিন সময়ে দেখি প্রদীপের হাতে একটা বই। দূর থেকে মনোযোগ দিয়ে পড়তে দেখে আমার কপালে ভাঁজ। ওর বাবা তো পড়া ছাড়িয়ে দেবে বলেছিল! ভাবতে ভাবতে কাছে গিয়ে ওর ঘাড়ে হাত রাখলাম। বইটার নাম চোখে পড়ল, ‘ভারতের বিজ্ঞানী’।
ক’দিন পরে দেখি আরেকটা বই, ‘আমার চোখে রবীন্দ্রনাথ’। লেখকের নামটা চোখে পড়েনি।
একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘পিসিএম, কোথা থেকে পাস রে এসব বই?’ আমাদের মধ্যে ওর পিসিএম নামটাই চালু হয়ে গেছিল। আমার কথার উত্তরে ক্লাসের পিসিএম বলল, ‘বইগুলো জমের বাড়ির থেকে আনি।’
তারপর দাঁত বের করে একটু হাসল। একটা ঢোঁক গিলে বলল, ‘বাবা এখনই পড়া ছাড়াবে না বুঝলি! জমকে কথা দিয়েছে।’
‘জম তোর বাড়ি গেছিল?’ আমার চোখে মুখে বিস্ময়।
‘না, বাবার দোকানে। হাটখোলায়।’
‘তারপর?’
‘বাবাকে খুব বোঝালেন জম। ছেলেটাকে পড়া ছাড়াবেন না। এ বছরটা অন্তত পড়তে দিন।’
‘এ ছেলের কোনও ভবিষ্যৎ আছে? অঙ্কে ফেল, ইংরেজিতে টায়ে টায়ে। হেডমাস্টার কথা শোনায় আমারে।’ বাবার কান্না কান্না কথা।
জম বলল, ‘ছেলেটার পড়াশোনা আমি দেখব। আপনি একটা চান্স দিন শুধু।’
বাবা তখন হাতজোড় করে বলছে, ‘আমি তো কোনও টাকা দিতে পারব না মাস্টারমশায়।’
‘তারপর?’
জম বেশ নরম গলাটা করে বলল, ‘ঠিক আছে। আপনি কিছু ভাববেন না মন্টুবাবু।’
চোখের জল মুছে বাবা বলল, ‘ঠিক আছে স্যার, আপনার কথা রাখলাম। তবে ঋণ বাড়াব না। ফেল করলে ওর কিন্তু পড়া বন্ধ।’
এত দূর বলে আমাদের পিসিএম থামল। আমার চোখে বিস্ময়। জম স্যার নিজে গেল হাটখোলায়? একটু অবাক হয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু কয়েকমাস পরে ক্লাসের সবাইকে, এমনকী গোটা স্কুলকে অবাক করে দেবার মতো ঘটনা ঘটল। অঙ্কে আশি নম্বর পেয়ে বার্ষিক পরীক্ষায় চার নম্বর স্থানটা দখল করেছে প্রদীপ।
পরের ঘটনাগুলো গতানুগতিক। কোনও ম্যাজিক ছিল না তাতে। একাত্তরের ব্যাচে হায়ার সেকেন্ডারি। স্কুল ডিঙিয়ে কলকাতার কলেজে ইকো স্ট্যাট নিয়ে ভর্তি হল। ফুলবাগানে টিউশন পড়াত আর ভাড়া থাকত রাজাবাজারে।
বিউটি সু-স্টোর নামের এক দোকানের পেছন দিকে ঘিঞ্জি নোংরা গলি, তস্য গলি। তার শেষ মাথায় ছোট্ট চিলতে পাখাবিহীন ঘরে একটু বেঞ্চি আর টেবিল। ওর মধ্যেই ঘুম, পড়া আর আড্ডা। দমবন্ধ করা ঘরে গরমে সেদ্ধ হয়ে যেতে হয়। মনে মনে ভাবতাম, পিসিএম যে এখানে কী করে থাকে!
দু-একবারের বেশি যাইনি। কিন্তু যোগাযোগ ছিল ওর সঙ্গে। শিয়ালদা স্টেশনে দেখা হতো। মালদার ছেলেরা ‘দূরে থাকা আমরা ক’জন’ বলে একটা সংস্থা তৈরি করেছিল। শিয়ালদা স্টেশনের দোতলার ক্যান্টিনে ওদের আড্ডা বসত। প্রতি শনিবার নিয়মিত আসত পিসিএম, মানে মালদার প্রদীপ।
একদিন বলল, ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে চান্স পেয়েছি। মাস্টার্স করব।’
আড্ডার মধ্যমণি এজি, মানে কালীতলার অরূপ ঘোষ চোখ বড় বড় করে বলল, ‘দারুণ করেছিস। আচ্ছা, তোর সাবজেক্ট বুঝিয়ে বলতো একটু।’
সাহিত্যের তরুণ অধ্যাপক অরূপদার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে নিয়ে প্রদীপ বলল, ‘দাদা, যে কোনও সম্ভাবনাকে দুটো বাইনারি নম্বরে ফেলা যায়, জিরো আর ওয়ান। এই নিয়েই রাশিবিজ্ঞানের কারবার। চাষবাস বল, কম্পিউটার বল, হাট-ঘাট-ময়দান, বন্যা-বিপর্যয়— সর্বত্র এর প্রয়োগ।’
‘বুঝে গেলাম প্রদীপ, তুই হলি পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশের ছৌত্র, মানে ওঁর ছাত্রের ছাত্র।’ অরূপদা মুখে হাসি ছড়িয়ে আবার বললেন, ‘পুত্রের পুত্রকে বলে পৌত্র, তেমন ছাত্রের ছাত্র হচ্ছে ছৌত্র, বুঝলি! চল তোকে আজ ডবল ডিমের পোচ খাওয়াই।’
লজ্জা পেয়ে মুখের রং খয়েরি হয়ে গেল প্রদীপের। একটু থেমে বলল, ‘কদিন পর বরানগরের হস্টেলে চলে যাব। বেশ বড় ঘর ওখানে। খাবারও দারুণ। তোমরা আসবে কিন্তু।’
আমি গেছিলাম আইএসআই। ঘুরে ঘুরে ওদের ক্যাম্পাস দেখাল প্রদীপ। আমগাছ ঘেরা এক জায়গায় এসে একটু দাঁড়াল। একটা বাড়ির দিকে আঙুল তুলে ধীরে ধীরে বলল, ‘এখানেই থাকতেন পিসিএম, মানে প্রফেসর প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ। জানিস, স্কুলে থাকতে একদিন একা একা চলে এসেছিলাম ওঁকে দেখব বলে।’
‘কেন?’
এক নিঃশ্বাসে প্রদীপ বলল, ‘পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিককে দেখতে আসব না? তার উপর উনি জগৎ স্যারের টিচার! দেখতে ইচ্ছে হবে না?’
‘তুই মালদা থেকে একা একা চলে এলি?’
‘বাবা বর্ধমানে পাঠিয়েছিল গোবিন্দভোগ আতপ চাল কিনতে। আমি চান্স নিলাম। এক ফাঁকে বর্ধমান-কলকাতা ইলেকট্রিক ট্রেন ধরে সোজা শিয়ালদা। তারপর লোককে জিজ্ঞেস করে বরানগর। প্রফেসর পিএসএমকে একবার দেখব না!’
‘তারপর?’
‘দেখা হল না, বুঝলি! অনেক বড় বড় লোকও ফিরে গেলেন। উনি খুব অসুস্থ ছিলেন।’
বড় একটা শ্বাস ফেলল প্রদীপ। একটু থেমে বলল, ‘একটাই দুঃখ, জানিস। পিসিএম মানুষটাকে জীবনে একবার দেখতে পেলাম না। ভারতে রাশিবিজ্ঞানের জনক উনি, আবার আমার স্যারের স্যার।’
প্রদীপের দুঃখ, কেন জানি আমাকেও স্পর্শ করল। অনেকক্ষণ কথা বলতে পারিনি সেদিন। একটু থেমে বললাম, ‘জগৎ স্যারের খবর কী রে?’
‘ভালোই আছেন। বারাসাত হাইস্কুলের টিচার এখন। ক’দিন আগে ওঁর মেয়ে লরেটোতে ভর্তি হল। চান্স পাচ্ছিল না, জানিস!’
‘কেন?’
‘ভর্তির পরীক্ষায় একদম ধেড়িয়ে গেছিল। তারপর জমকে না জানিয়ে এমপি-কে ধরলাম। প্রিন্সিপালকে নেতার চিঠি দেখাতেই ভর্তি।’
এরপর অনেকগুলো বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল! দীর্ঘ দিন দেখিনি প্রদীপকে। মাঝেমধ্যে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে। ও এখন আইএসআই-এর ব্যস্ত অধ্যাপক। অপারেশন্যাল রিসার্চ নামের এক কঠিন বিষয় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ায় আর গবেষণায় ডুবে থাকে। মাঝেমধ্যে বক্তৃতা দিতে বিদেশে পাড়ি দেয়।
আমি কলকাতার বাসিন্দা। ছাত্র পড়ানোর মেয়াদ শেষ করে নিউটাউনে ফ্ল্যাট কিনেছি। সস্ত্রীক ওখানেই থাকি। নিশ্চিন্ত অবসর জীবন। অনেকগুলো খবরের কাগজ কিনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। ক’দিন আগে রবিবারের কোনও এক ক্রোড়পত্রে অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশের খুব বড় একটা ছবি চোখে পড়ল। এই বছর তাঁর একশো পঁচিশতম জন্ম-জয়ন্তী উৎসব।
ছবি সহ খবরটা পড়তেই প্রদীপের কথা মনে পড়ল। আর কী আশ্চর্য, অদ্ভুত সমাপতন! সেই মুহূর্তে ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে প্রদীপ।
ফোনটা ধরেই বললাম, ‘কাগজে তোর নাম দেখলাম। একশো পঁচিশতম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটির চেয়ারম্যান তুই।’
প্রদীপ কিছু বলল না। একটু থেমে বেশ ভারী গলায় বলল, ‘জানিস একটা খারাপ খবর আছে।’
‘কী খারাপ খবর?’ আমি একটু চমকে উঠে বললাম।
‘জম মারা গেছেন। ম্যাসিভ স্ট্রোক। ওঁর মেয়ে বাবলি ব্যাঙ্গালোর থেকে ফোন করেছে একটু আগে।’
আমি নিশ্চিত হতে জানতে চাইলাম, ‘কে? কে মারা গেছে?’
‘আরে, জগৎ মল্লিক স্যার। আমরা বলতাম জম। মনে নেই?’
‘মনে আছে। আরে উনিই তো তোকে পিসিএম বানিয়েছেন। প্রফেসর পিসিএম, আমাদের গর্ব।’
‘খুব কষ্ট হচ্ছে জানিস। দ্বিতীয় বার পিতৃবিয়োগ।’
‘হবারই কথা।’ আমি বললাম।
প্রদীপের ধরা গলা, ‘উনি না থাকলে কী হতো বলতো?’
‘কী হতো?’
বড় একটা শ্বাস ছেড়ে ধরা গলায় প্রদীপ বলল, ‘তোদের এই পিসিএম হাটখোলার সরু দোকানে বসে চাল মাপত। রামে রাম...। এই হল দুই, দুয়ে দুই।’
প্রদীপের কথার উত্তর দেব কী! চোখের সামনে ভেসে উঠল মালদার হাটখোলা। দোকানে হাঁটু মুড়ে দাঁড়িপাল্লা হাতে মন্টু কাকা, প্রদীপের বাবা। কোমর বেঁকিয়ে চাল মাপছেন, রামে রাম, রামে দুই।
প্রদীপও মাপে। শুধু চাল কেন, দুনিয়ার হাটখোলায় ডাল, শস্য, সব্জি অনেক কিছু মাপে। রাশিবিজ্ঞান প্রয়োগ করে দেশের কৃষি পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির নয়া ডাইনামিক লিনিয়ার মডেল আবিষ্কার করেছে ও।
খানিক অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম। প্রদীপের কথায় বর্তমানে ফিরে এলাম। ফোনের ওপারে ওর গলা, ‘জগৎ স্যারের বাড়ি যাচ্ছি। বালি, হাটখোলা। তোর ওখান দিয়েই যাব। আমার সঙ্গে যাবি তো?’
আমি সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতি জানিয়ে বললাম, ‘নিশ্চয়ই।’
‘তৈরি হয়ে নে’, বলে প্রদীপ ফোন কেটে দিল। আমি জামা-প্যান্ট পরে চুল আঁচড়াচ্ছি। স্ত্রীর প্রশ্ন, ‘কোথায় চললে?’
‘একজন মানুষকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে আসি।’
‘কে উনি?’
‘বিলুপ্ত প্রজাতির এক মানুষ গড়ার কারিগর।’ ধীরে ধীরে আমি বললাম, ‘যাই... শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে আসি।’