ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে হঠাৎ করে আসা তীব্র কার্ডিয়াক অ্যাটাকে কয়েক মিনিটের মধ্যে নেই হয়ে গিয়েছিল বাবা। সেটা মেনে নিতে বেশ কিছুদিন খুব অসুবিধা হয়েছিল সমীরণের। সবচাইতে যেটা খারাপ লেগেছিল তা হল বাবার শরীরটা জানান দিচ্ছিল। সমীরণের প্রশ্নের উত্তরে বাবা জানিয়েছিল— তার শরীর একদমই ভালো নেই। শুনেই সে গোপালদাদুকে ফোন করে। ডাক্তার গোপাল রায় ছিলেন বিধান রায়ের প্রিয় ছাত্র। বাবাকে তিনি ছোটবেলা থেকে চিকিৎসা করেছেন। বাবার শরীরের ঘাঁত-ঘোঁত সবই তার নখদর্পণে।
গোপালদাদু সময় দিয়েছিলেন। বিকালে বাবা মা’কে সঙ্গে নিয়ে গোপালমামার কাছে নিজেকে দেখাতে গিয়েছিল। তাকে ওপর ওপর পরীক্ষা করে গোপালদাদু গোটা দুয়েক টনিক লিখে বাবার পিঠ চাপড়ে ছেড়ে দেয়। যাও, তুমি ঠিকই আছ। তোমার কিছুই হয়নি। চিন্তা কোরো না।
আদ্যন্ত লাজুক মানুষটা নিজের শরীর নিয়ে সাতকাহন করে কোনওদিনই কাউকে কিছু বলেননি। সেদিন তবুও তার মুখে কিন্তু কিন্তু ভাব ফুটে উঠেছিল। অথচ গোপালমামাকে কিছুই বলতে পারেনি বাবা। মা-ও আলাদা করে কিছু বলেনি। শুধু ভেবেছিল— গোপালমামা ছাড়াও আর একজন ডাক্তারকে দিয়ে বাবাকে দেখাবে। মানুষটা কোনও দিন নিজের শরীর খারাপের কথা বলে না। সে কি না দু’দিন হল মাঝে মধ্যেই সেটা বলছে: লক্ষণ সুবিধার নয়।
পরের দিন সন্ধ্যার সময় মাত্র মিনিট চারেকের মধ্যে ওরকম জলজ্যান্ত ডাকাবুকো মানুষটা হঠাৎ করে নেই হয়ে গেল। শুনে তার গোপালমামা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কপালে করাঘাত করে মাঝে মাঝেই বলতেন— রবিটা আমার কাছে এল। বলল— মামা, শরীরটা খারাপ লাগছে। আর আমি একটুও বুঝতে পারলাম না! ওকে আরও ভালো করে কেন দেখলাম না!
খুব বেশি দিন এই আক্ষেপ করতে হয়নি ডাক্তার গোপাল রায়কে। মাস তিনেকের ব্যবধানে তিনিও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সাধনোচিত ধামে চলে যান। তাঁর বয়স হয়েছিল আশির ঘরের মাঝামাঝি। ভাগ্নের শোকে তিনি কাতর হয়েছিলেন। বাবা তাঁকে খুব কাতরভাবে অনুরোধ করছে।
বলছে— আমাকে তোর অফিসটা দেখাবি? আমার খুব ইচ্ছে। সমীরণ শুনে অবাক হয়ে গেল। মাত্র দু’বছর হল সে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। এতদিন বাবা কেন এল না? খুব সহজ হতো তার সব ক’টা অফিস বাবাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো। এখন বাবাকে এই অবস্থায় নিয়ে যেতে গেলে কেউ যদি তাকে অপমান করে, কিংবা বাবাকেই কিছু বলে বসে! সে কীভাবে সেটাকে সামলাবে!
তার মনে পড়ছিল জ্ঞান হওয়া থেকে বাবার সব অফিসে সে গিয়েছে। কোথাও কোথাও গিয়ে থেকেওছে। বাবার প্রতিষ্ঠা আর তার দাপট দেখেছে। বাবার সুনাম, তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, তাঁর সততার কথা বারবার বাবার সহকর্মীদের কাছে শুনেছে। বাবারও নিশ্চয়ই ইচ্ছে হয়েছে তার অফিসে যাওয়ার। অথচ বাবা কোনও দিন কখনও মুখ ফুটে সেকথা বলেনি।
বাবা কি কখনও তার কাছে কিছু চেয়েছে? সমীরণ অনেক ভেবেও সেরকম কিছু বের করতে পারল না। কেবল বাবা একবার তার গ্র্যাজুয়েশনের পর বলেছিল— এখন থেকে দুটো বছর যদি তুমি নিজের দিকে তাকাও আর খুব পরিশ্রম করো তাহলে বাকি জীবন তুমি খুব আনন্দে আর আরামে কাটাবে। লোককে উপদেশ দেবে। আর এই দুটো বছর যদি তুমি আনন্দ আর আরামে কাটাও তাহলে লোকে তোমাকে সারাজীবন উপদেশ দেবে আর তুমি কষ্ট করবে। চয়েজ ইস ইয়োরস।
বাবা সমীরণকে কোথাও একা ছাড়ত না। বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে বলত তোমার মা’র কাছ থেকে অনুমতি নাও। মা রাজি হলে আমার আপত্তি নেই। মা’র কাছে গিয়ে অনুমতি চাইলে মা বলত— বাবা যদি রাজি থাকে তাহলে আমার আপত্তি নেই। একবার বাবার কাছে, একবার মা’র কাছে দরবার করতে করতে সমীরণ বুঝতে পারত আসলে তারা তাকে অনুমতি দেবে না।
বাবাকে সে একবার বলেছিল— তুমি সব সময় আমার সঙ্গে এইভাবে ব্যবহার কোরো না। তুমি যে বাবা আর আমি যে তোমার ছেলে এটা একটা ডিভাইন অ্যাক্সিডেন্ট। তুমি আমার ছেলেও হতে পারতে— বাবা না হয়ে। তখন যদি আমি বাবা হয়ে তোমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করতাম তোমার কেমন লাগত?
বাবা এটা শোনার পর চুপ হয়ে গিয়েছিল। মা সবটা শুনছিল। তখন কিছু বলেনি, কিন্তু পরে বলেছিল। বলেছিল— তুই এটা তোর বাবাকে বলতে পারলি? বাবাকে?
—তো? ভুল বলেছি কিছু?
—বুঝবি বুঝবি। আরও বড় হ। নিজে যখন বাবা হবি তখন বুঝবি।
—কী বুঝব!
—বুঝবি বাবাকে এসব কথা বলা যায় না।
—খুব যায়। বাবা-মাকেই সব কিছু বলা যায়। তোমাদের সময় অন্যরকম ছিল। এখন আমাদের সময়। আমি মনে করি বলা যায়।
মাকে খুব হতাশ লেগেছিল। মাত্র কয়েকদিন আগে ঠাকুমা বাবার ওপর রাগ করে তাকে যে কথাটা বলেছিল তাতে বাবা-মা দু’জনের ওপরেই সমীরণের ক্রোধ হয়েছিল।
কথাটা ঠাকুমার বলা উচিত হয়নি। বুড়ি সমীরণকে বলেছিল তার জন্মেরও আগের কথা। মায়ের পেটে তখন সে এসে পড়েছে। মা তখন সাড়ে তিন মাসের পোয়াতি। সে সময় বাবা বিশু ডাক্তারকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। যাতে সে পৃথিবীর আলো না দেখে। অ্যাবরশান জিনিসটা তখনও সর্বতোভাবে বেআইনি। লুকিয়ে-চুরিয়ে হতো।
বিশু ডাক্তার কাজ শুরু করেছিল চুপিসারে। সজাগ ছিল ঠাকুমা। বুড়ি নাকি আগের রাতে স্বপ্ন দেখেছিল। সহস্রফণা নাগের স্বপ্ন। যে আসছে সে বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। তাকে আসতে দাও। তার যেন কোনও বিঘ্ন না ঘটে!
বিশু ডাক্তারকে চিৎকার করে বাড়ি থেকে ভাগিয়ে দিয়েছিল ঠাকুমা। তার বংশের বড়ছেলের সন্তান আসছে। হতে পারে বউমার বয়স অল্প। হতে পারে অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব। তাই বলে ঘরের মধ্যে আগামী প্রজন্মকে গর্ভের মধ্যে খুন! এটা হেমবালা কখনওই মেনে নেবেন না!
রক্তারক্তি কাণ্ড শুরু হয়েছিল গর্ভপাতের চেষ্টায়। ঠাকুমার উদ্যোগে উল্টোপথে হাঁটা শুরু হল। গর্ভ বাঁচানোর চেষ্টা। আশ্চর্য! সবটার পিছনে ছিল একটা স্বপ্ন। সহস্র নাগের স্বপ্ন। ফণা তুলে সহস্রনাগ আসছে। ঠাকুমা আগের রাতেই এই স্বপ্নটা কী করে দেখল! কেন দেখল! সত্যিই কি বুড়ি এই স্বপ্নটা দেখেছিল? নাকি নিজে থেকে বানিয়ে বলেছিল?
নিজের ছেলের ওপর বুড়ির যতটা রাগ হয়ে থাকুক সমীরণকে এই গল্পটা করা তার একদমই উচিত হয়নি! শোনার পর বাবার ওপর অপরিসীম রাগ হয়েছিল সমীরণের। প্রতিটি ব্যবহারের নতুন মানে আবিষ্কৃত হচ্ছিল তার মনে। সে অবাঞ্ছিত ছিল। বাবা তাকে চায়নি। মা’র শরীর অপুষ্ট ছিল, সন্তানধারণের উপযুক্ত বয়স হয়নি— সব কিছুই সে তখন ভুলে গিয়েছিল। শুধু রাগ— বাবার ওপর, মায়ের ওপর শুধু রাগ। সেই রাগ এমন ছিল যা ভুলিয়ে দিয়েছিল বাবা তাকে সবরকম খেলা শিখিয়েছে, বাবা তাকে অ আ ক খ, এক দুই তিন চার, এবিসিডি সব শিখিয়েছে। রোজ রাতে বাবা তাকে নিয়ে পড়তে বসেছে। ট্রানজিস্টার বাজিয়ে খবর শুনিয়েছে, গান শুনিয়েছে। মা তাকে অত আদর, অত প্রশ্রয় দিয়েছে। বাবা দু’হাতে দুটো ব্যাগ ভর্তি করে বাজারের সেরা জিনিসগুলো কিনে এনেছে। মা যত্ন করে মন দিয়ে রেঁধেছে। তার শরীর-মন পুষ্ট হয়েছে। মা আর বাবা পালা করে সঞ্চয়িতা আর গীতবিতান থেকে কবিতা আর গান শুনিয়েছে। তার কোনও অভাব রাখেনি কোনও বিষয়ে।
এরকম দেবতার মতো বাবা-মা সম্পর্কে সে কি না অনেকটা সময় শুধু ক্রোধই রেখেছে! ঠাকুমা তাকে যেসব কথা বলেছে, পরে সে ভেবে দেখেছে— তা ঠাকুমার বলা একদমই উচিত হয়নি।
সাংঘাতিক রাগ হয়েছিল ঠাকুমার, বাবার ওপর। কারণ অবশ্যই ছিল। কিন্তু তাই বলে...।
বাবা শুধু ক্যারাম বোর্ড, ফুটবল আর ক্রিকেট ব্যাটই কিনে দেয়নি, তার সঙ্গে খেলেওছে। কলকাতার ইডেনে যখন ফুটবল খেলা হতো তখন বাবা তাকে মাঠে খেলা দেখাতে নিয়ে গেছে। ফুটবলের সময় ফুটবল, ক্রিকেটের সময় ক্রিকেট সব খেলারই টিকিট জোগাড় করত বাবা। মা’র নিষেধ উপেক্ষা করে বাবা তাকে মাঠে নিয়ে যেত। এইরকম একটা বাবা— যে কি না সে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিতভাবে বন্ধু হয়ে উঠেছিল— তার ওপর রাগ করার কোনও মানেই হয় না। আর সে তো তখন জন্মায়নি। বাবা-মা তো ইচ্ছে করলে ঠাকুমার কথা না শুনে অন্য কোথাও গিয়ে তাকে এই পৃথিবীতে না আনার ব্যাপারটা করতে পারত। কিন্তু তারা তো সেটা করেনি। উল্টে, সে যাতে নিরাপদে এই পৃথিবীর আলো দেখে সেই চেষ্টাই তার পর থেকে করে গেছে। কিন্তু তখন সমীরণের এই বুদ্ধিটা আসেনি।
স্বপ্ন কিন্তু বোঝা যাচ্ছে সমীরণ স্বপ্নই দেখছে, এই অবস্থায় বাবা এসেছে তার অফিসে। বাবাকে কীরকম ছোটখাট, কৃশ দেখাচ্ছে। গালে তিন চারদিনের না-কামানো সাদা দাড়ি।
এই সময় প্রণয় এসে বলল, স্যার ইনি কে? আপনার কেউ হন?
প্রণয় কর্মীদের মধ্যে ওস্তাদ গোছের। কিন্তু সমীরণকে সে খুব মান্য করে। সমীরণ তাকে একটুও পছন্দ করে না। এখন সমীরণের মনে হল প্রণয়ের সাহায্য নিতে হবে। বাবাকে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছে। এতটা বাবা ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবে না। সে নিজেই দু’বছর আগে অবসর নিয়েছে।
যখন আমি চাকরিতে ছিলাম তখন তুমি কেন এলে না বাবা? সমীরণ আস্তে অস্ফুটে বাবাকে বলছিল। তখন তো সব কিছুই সহজ ছিল।
হঠাৎ পাশ থেকে চিরকাকুকে দেখা গেল। সমীরণের মনে পড়ল এই চিরকাকু তার জন্মের আগের ঘটনাটার কথা জানে। বছর দুয়েক আগে মা মারা যাওয়ার আগের সপ্তাহে সমীরণ মা’র কাছে এই ঘটনার সত্যতা জানতে চেয়েছিল। বহু বছর ধরে মা’কে জিজ্ঞাসা করা উচিত কি না, করলে কীভাবে সেটা করা যেতে পারে ভাবতে ভাবতে বছরগুলো কেমন হুস হুস করে চলে গেল। যারা এটা সম্পর্কে বলতে পারত তার মধ্যে ছিল ঠাকুমা, ঠাকুরদা, বাবা, মা আর বিশু ডাক্তার। মা ছাড়া আর সবাই মরে গেছে। তাই সমীরণ মরিয়া হয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল— মা, তোমরা কি আমাকে অ্যাবর্ট করার চেষ্টা করেছিলে?
শুনে মা’র চোখের মণি দুটো ছোট আর রহস্যময় হয়ে গেল। আক্রান্ত হয়ে মানুষের চোখ এরকম হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মা বলল— তোকে কে বলল?
তার মানে ঘটনাটা সত্যি ঘটেছিল। ঠাকুমা তাহলে ঠিকই বলেছিল।
ঠাকুমা। বলল সমীরণ। মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল সে। আর মা সন্তানের মুখের দিকে। তার আশ্চর্য দৃষ্টি। ভাবতেই পারছে না জীবনের প্রান্তে এরকম একটা প্রশ্ন তার ছেলের কাছে শুনতে হবে।
হ্যাঁ। ছোট্ট একটা শব্দ বের হল মা’র মুখ দিয়ে। সেই মুহূর্তে সমীরণের মা’র জন্য খুব অহংকার হল। মা’কে তার আদর করতে ইচ্ছা করছিল। সন্তানের কাছে মা কোনও মিথ্যা বলতে চায়নি। সমীরণ জানত মা’র শরীর সে সময় খুব খারাপ হয়েছিল। মা’কে বাঁচাতেই বাবা এই গর্ভপাতের চেষ্টাটা করতে গিয়েছিল। কিন্তু এসব কিছুই মা বলল না। কোনও অজুহাত দিল না। শুধু বলল— চিরবাবু তোর বাবাকে বারণ করেছিল। সে বলেছিল— যে আসছে তাকে আসতে দাও। তোমার পুত্র আসছে। তোমার কোনও ক্ষতি সে করবে না। সমীরণের মনে পড়ল চিরকাকুর সামনে বাবা কীরকম অস্বস্তিতে থাকত। একবার চিরকাকু তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল— আর একটু হলেই হয়ে গিয়েছিল আর কি!
বাবা সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল— চির। কণ্ঠস্বরে ধমক এবং শাসন দুটোই ছিল। চুপ করে গিয়েছিল চিরকাকু।
প্রণয় বলল, স্যার, মেসোমশাই তো এতটা ঘুরতে পারবেন না। আপনি ওকে কাঁধে তুলে নিন।
যত্ন করে বাবাকে নিজের কাঁধে তুলতে তুলতে সমীরণ বুঝতে পারছিল, বাবার ওজন প্রায় নেই। কেন তুমি আগে এলে না বাবা? বলতে বলতে সে বুঝতে পারল তার চোখ দিয়ে উষ্ণ গরম জল পড়ছে। বাবার জন্য তার এত কষ্ট জমেছিল! ভেবে সে আশ্চর্য হয়ে গেল। আর তখনই তার ঘুমটা ভেঙে গেল।
তার চোখ দিয়ে এখনও জল পড়ছে।