মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে এরকম নাটকীয়ভাবে সুভাষচন্দ্র বসু পা রাখেন সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে। এর ঠিক পাঁচ মাস আগে কী ঘটেছিল? জার্মান সাবমেরিনের নাম ছিল ইউ ওয়ান এইট্টি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন মধ্যগগনে। জার্মানি থেকে যে কাঙ্ক্ষিত এবং নিশ্চিত সহায়তা সেভাবে পাওয়া যাবে না, সেটা ক্রমেই বুঝতে পারছিলেন সুভাষচন্দ্র। ফলে যোগসূত্র গড়ে তুললেন জাপানের সঙ্গে। অবশ্য জার্মান সেনার তাঁবেদার বা অনুগত হয়ে নয়। স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে লড়াই করবে ভারতীয় সেনা—এই ছিল তাঁর স্বপ্ন। অর্থাৎ অক্ষশক্তির অন্যতম সঙ্গী হবেন তিনি। ব্রিটিশদের ভারত থেকে উৎখাত করতে। অতএব দ্বিতীয় চিন্তা। একটি অলৌকিক অভিযানের সওয়ার হলেন ৮ ফেব্রুয়ারি। ইউ ওয়ান এইট্টি সাবমেরিনটি নাইন ডি টাইপ মডেলের। একটি ই-মোটর আছে, যা দ্রুতগামী করবে সাবমেরিনকে। হাতে সময় বেশি নেই। সুভাষচন্দ্রকে দ্রুত পৌঁছতে হবে। কোথায়? কার সঙ্গে? সব পরিকল্পনা তৈরি করা আছে। সেইমতো সংযোগও থাকবে। সময়মতো সেই মেসেজ পাঠানো হবে। সাবমেরিনে চারজন অফিসার। ৫১ জন নাবিক। সঙ্গে কয়েকজনকে নিতে চেয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। কিন্তু তাঁকে বলা হল, সেটা হবে না। নেওয়া যাবে মাত্র একজনকে। অতএব আবিদ হাসান। সামরিক জ্ঞান রয়েছে তাঁর।
একদিন পর অর্থাৎ ৯ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করল সাবমেরিন। আটলান্টিকের জলে-আকাশে মিত্রশক্তির টহলদারি চলছে। মিত্রশক্তির অন্যতম প্রধান ইউনিটের কাজ ছিল সাবমেরিন, শিপ অথবা স্পিডবোট থেকে পাঠানো যে কোনও রেডিও মেসেজকে ডিকোড করা।
রোনাল্ডা লিউইন এরকমই এক ইনটেলিজেন্স অফিসার। যিনি জাপান, জার্মানীর গোপন মেসেজ ডিকোডিং এর বিশেষজ্ঞ। তিনি যা বুঝতে পারছেন না, তা হল, সাবমেরিনের সওয়ারিরা কোনও গোপনীয়তা রাখছেন না কেন? মাঝেমধ্যেই এই সাবমেরিন থেকে মেসেজ যাচ্ছে জার্মানী ও জাপানে। সাবমেরিনে আসছে ভারতের অন্দরে ঠিক কী ঘটছে রাজনৈতিক ঘটনা তার আপডেট। কিন্তু সেই সব মেসেজ খুব সহজেই স্বাভাবিক নিয়মে ডিকোড করে ফেলা যাচ্ছে। আমেরিকান মেসেজ ডিকোড ইউনিট সেইসব মেসেজ পাঠাচ্ছে ব্রিটেনের কাছে। আর এসব যে জানে না জার্মানী অথবা জাপান, সেটা তো হতে পারে না। তাহলে এই রহস্যটা কী?
আটলান্টিকের যাত্রাপথে একবারই শুধু একটা ঘটনা ঘটল। একটি ব্রিটিশ কার্গো জাহাজকে ডুবিয়ে দিল এই সাবমেরিন। জাহাজের নাম কর্বিস। ১৮ এপ্রিল।
সাবমেরিনে বসে কী করছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি তাঁর লেখা দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল বইয়ের নতুন সংস্করণটির পরিমার্জনে ব্যস্ত ছিলেন। আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যান সম্পূর্ণ ছবির মতো লিখে রাখছিলেন যে জাপান সরকার ও মিলিটারির সঙ্গে মুখোমুটি কথা হওয়ার পর যে ব্লু প্রিন্ট তাঁদের সামনে রাখবেন। অর্থাৎ ঠিক কীভাবে তিনি অগ্রসর হতে চান ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। ২৪ এপ্রিল প্রথম সংযোগ স্থাপন করা হল। জাপানী সারবমেরিন আই টুয়েন্টি নাইনের লোকেশন মাদাগাস্কারের পূর্বপ্রান্তে। ভারত মহাসাগরে। এবার জাপানের ইম্পিরিয়াল নেভির সঙ্গে অবশেষে যোগসূত্র স্থাপন।
সময়টা কি খুব অনুকুল? মনে হচ্ছে না। চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। কারণ সুভাষচন্দ্র যখন ইওরোপে গিয়েছিলেন, সেই সময় জার্মানী লাগাতার আক্রমণ করছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে। জাপান ছিল না যুদ্ধে। আবার ১৯৪২ সালে জাপান যখন আক্রমণাত্মক হয়েছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সেই সময় যদি জাপানের সঙ্গে সখ্য তৈরি করা যেত তাহলে জাপান যাতে ব্রিটিশ ভারতকে আক্রমণ করে সেই চেষ্টা করা যেত। কিন্তু এক বছরে অনেক কিছু বদলে গেল। এখন যখন সুভাষচন্দ্র যাচ্ছেন এক মহাঅভিযানের স্বপ্ন নিয়ে, সেই সময় জাপান টের পাচ্ছে আমেরিকানদের শক্তি। আর জার্মানী স্ট্যালিনগ্রাদে বিপুল ধাক্কা খেয়েছে। সুতরাং, শক্তির ভারসাম্য সামান্য যেন পালটে যাচ্ছে। মিত্রশক্তিকে অনেক সংহত দেখাচ্ছে এখন। আর এটাই সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ সুভাষচন্দ্রের কাছে। তবে তিনি চ্যালেঞ্জ নিতেই ভালবাসেন।
৬ মে। সাবান আইল্যান্ডের জাপান ন্যাভাল এয়ারবেসে এসে নামলেন সুভাষচন্দ্র। ক্যাপ্টেন ইয়ামামোতো স্বাগত জানালেন। যিনি ছিলেন বার্লিনে জাপানের মিলিটারি অ্যাটাশে। একসঙ্গে টোকিও এলেন। প্লেনে। সুভাষচন্দ্র দেরি করতে চান না। সরাসরি জানালেন, জাপান মিলিটারি ইউনিটের সঙ্গে দেখা করা কখন সম্ভব? ইয়ামামোতো আশ্বস্ত করলেন। তার আগে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংটা দরকার। প্রধানমন্ত্রী তোজোর উপরই সবকিছু নির্ভর করছে। তাঁকেই বোঝাতে হবে প্ল্যান। তিনি কি রাজি হবেন? টেনশন রয়েই যাচ্ছে!
১০ জুন। প্রধানমন্ত্রী তোজোকে ঠিক যেন মিলিটারি অফিসার মনে হয় না। একটু কম কথা বলেন। গম্ভীর। তবে সুভাষচন্দ্রকে যথেষ্ট সাদব অভ্যর্থনা করলেন। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সুভাষচন্দ্রের স্পষ্ট দ্বিধাহীন প্ল্যান শুনে জানিয়ে দিলেন সবথেকে কাঙ্ক্ষিত বার্তা। আমরা ভারতের স্বাধীনতার জন্য সবরমকভাবে আপনাকে সহায়তা করব। তোজোকে সুভাষচন্দ্র বললেন, বার্মার দিক থেকে ভারতে প্রবেশের প্ল্যান করা দরকার আমাদের। তোজো ভাবছেন। ক্ষণিক। কারণ ফেব্রুয়ারি থেকে বার্মায় মিত্রশক্তির সেনা দলে দলে ঢুকছে। তাদের লক্ষ্য আরাকান থেকে জাপানকে পিছু হটিয়ে দেওয়া।আবার প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে মিত্রশক্তির একটি অপারেশন শুরু হয়েছে। কার্টহুইল। যাকে বলা হচ্ছে কাউন্টার অফেনসিভ! তবে ১৬ জুন একটি পৃথক বৈঠকে সব দ্বিধা সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী তোজো জানিয়ে দিলেন, আমরা নিশ্চিতভাবে ভারতের স্বাধীনতা পাওয়ার পথে হেল্প করব।
একটা প্রেস কনফারেন্স করলেন সুভাষচন্দ্র বসু। বললেন, ‘‘বর্তমানে বিশ্বের দুটি নীতির মধ্যে যুদ্ধ চলছে। একটি নীতি চাইএছ যেমন চলছে তেমনই চলুক। আর একটি নীতি সেই পুরনো ব্যবস্থা ছিন্নভিন্ন করে নতুন এক সমীকরণ দিতে চায়। আমি দ্বিতীয় পন্থায় বিশ্বাসী। অর্থাৎ সুভাষচন্দ্র বলতে চাইলেন, মিত্রশক্তির জয় হলে, ভারতে ব্রিটিশ থেকেই যাবে। কোনও বদল ঘটবে না। তাই সেই পথের সমর্থক হব কেন? তিনি বললেন, যদি অক্ষশক্তি জয়ী হয়, তাহলে ভারত তাঁর হারানো স্বাধীনতা আবার ফিরে পাবে। আর আমাদের স্বাধীনতা পেতে হবে একমাত্র নিজেদের রক্ত ঝরিয়ে…।’’ এই শপথের আড়ালে ছিল একটি আশ্চর্য পরিকল্পনা। নির্বাসিত স্বাধীন ভারতীয় সরকার গঠন। স্বাধীন ভারতীয় সেনাবাহিনী নির্মাণ। হবে কি সেটা সম্ভব?
এরপরই এসেছে এই জুলাই মাস। ১৯৪৩। সিঙ্গাপুর। ১৯৪২ সালে গঠিত আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভেঙে দেওয়া ইউনিটের মনোবল হারিয়ে যাওয়া এবং এখনও মনোবল ধরে রাখা দুরকমেরই কয়েক হাজার সেনা হাজির সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে। এসেছেন প্রবাসী ভারতীয়রা অসংখ্য। তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবি ও স্বপ্ন ছিল একটাই। সুভাষচন্দ্র বসু আসুন। তিনি দায়িত্ব নিন। তিনিই পারবেন। অবশেষে কি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত? ওই তো তিনি এসেছেন। অনিন্দ্যকান্তি এক অবয়ব।
ঠিক দুদিন পর সিঙ্গাপুরে ক্যাথে থিয়েটারে সভা করবেন সুভাষচন্দ্র। অতএব জনস্রোত শুরু হল। ভিড়ে ঠাসা সেই সভায় এক স্থির, প্রাজ্ঞ, অসামান্য মেধাবী মানুষ প্রথমে ইঠে দাঁড়ালেন। তাঁর বয়স ৫৭ বছর। পোডিয়ামের সামনে কথা বলার সময় প্রথমে যেন তাঁর কন্ঠ সামান্য কেঁপে গেল। তিনি বাস্তববোধসম্পন্ন। স্থিতধী। অভিজ্ঞ। অথচ তাঁর মধ্যে আজ যেন এক মহাআবেগের সঞ্চার হচ্ছে। কিন্তু সামলে নিলেন। বললেন, ‘‘ বন্ধু ও সহকর্মীরা, আমি আজ আপনাদের সামনে নিয়ে এসেছি বর্তমানকে। নতুনকে। ইনি হলেন সুভাষচন্দ্র বসু। শ্রেষ্ঠ, মহান, অসমসাহসী এবং ভারতের সর্বাধিক প্রগতিশী, যুবক। আমি আজ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের ইস্ট এশিয়ার সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিচ্ছি। আজ, এখন থেকে, সুভাষচন্দ্র বসু আপনাদের নতুন সভাপতি। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনাদের নেতা। আর আমি নিশ্চিত যে আপনারা এবার যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হবেন এবং অগ্রসর হবেন বিজয়ের দিকে’’। করতালির বিস্ফোরণ ঘটল।
সেই ৫৭ বছরের মানুষটির নাম রাসবিহারী বসু। মালয় ও বার্মায় জাপানের কাছে ১৯৪২ সালে পরাস্ত হওয়া ব্রিটিশ ভারতীয় আর্মির সেনাবাহিনীকে নিয়ে যিনি প্রথম গঠন করার পরিকল্পনা নেন একটি ভারতীয় বাহিনী। কিন্তু একঝাঁক ঘটনাপরম্পরায় যে বাহিনী আর অটুট রাখা সম্ভব হয়নি। আবার একজন মানুষে ঘিরে সেই রাসবিহারী বসু এবং সেই বাহিনী স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। তাঁর নাম সুভাষচন্দ্র বসু। যে বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কমতে কমতে ১০ হাজারের নীচে সে দাঁড়িয়েছিল এক সময়, সেই বাহিনীকে সুভাষচন্দ্র গড়ে তুললেন অন্তত ৫০ হাজার সেনার এক প্রশিক্ষত ফোর্স হিসাবে। আর নির্মাণ করলেন এক বিস্ময়কর নজির। কী সেটা?
সিঙ্গাপুরের এক তরুণী ডাক্তার লক্ষ্মী স্বামীনাথনকে ১২ জুলাই সুভাষচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন,আমি শুধু নারীদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করব। যারা পুরুষ সেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করবে যুদ্ধের ময়দানে। তুমি এরকম একটি ইউনিটে যোগ দিতে প্রস্তুত? সেই মেয়েটি দ্বিধাহীনভাবে বললেন, হ্যাঁ। সুভাষচন্দ্র বললেন, তুমি কি মনে করো অন্তত একশো এরকম নারী যোদ্ধা তুমি নিয়োগ করতে পারবে? লক্ষ্মী স্বামীনাথন বললেন, একশো? আমি তো ভাবছি আমাদের ৫ হাজার এরকম নারীযোদ্ধা সংগ্রহ করতে হবে! সুভাষচন্দ্র বসু হাসলেন। বুঝলেন তিনি পেয়ে গিয়েছেন ঝাঁসি বাহিনীর প্রধানকে! অবশেষে তৈরি হল আজাদ হিন্দ ফৌজ!
সুভাষচন্দ্র বললেন, দিল্লি চলো!