মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
আকাশে-বাতাসে আনন্দ নিয়ে বাংলার জীবন প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয় দোল উৎসব। এই উৎসব রঙের উৎসব, প্রেমের উৎসব, ভালোবাসার উৎসব। আবির, গুলালে প্রিয়জনকে রাঙিয়ে দেওয়ার এই উৎসবের উৎস নিহিত আছে সমাজ মনের অনেক গভীরে। এই উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে পুরাণ কাহিনী এবং সামাজিক সম্মেলনের নানা দিক। ফাল্গুনের পূর্ণিমায় দোল উৎসব পালিত হয়। দোলের আগের দিন পাড়ায় পাড়ায় জ্বলে ওঠে ধুনি। শীতের শুকনো পরিত্যক্ত পাতা দিয়ে আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়। তার মধ্যে নিক্ষেপ করা হয় ছোট একটি আটার তৈরী পুতুল, যাকে মেড়া বা নেড়া বলা হয়ে থাকে। প্রচলিত লোকবিশ্বাস, এ হল নেড়া পোড়ানো। নেড়া পোড়ার পরের দিন দোল। দোল বাঙালির নিজস্ব উৎসব। দোলের পরের দিন ভারতের অবাঙালি অঞ্চলে হোলি উদযাপিত হয়। এই হোলির সঙ্গে কিন্তু নেড়া পোড়ার যোগসূত্র নিবিড়। হোলি শব্দটি এসেছে হোলিকা থেকে। ভাগবত পুরাণ অনুসারে অসুর রাজ হিরণ্যকশিপুর বোনের নাম ছিল হোলিকা। অসুররাজ হিরণ্যকশিপু তপস্যার বলে বেশ কয়েকটি দুর্লভ বর লাভ করেন। এই বর লাভের পর তাঁর মনে হয় তিনিই ঈশ্বর! তাঁর রাজ্যে অন্য কোনও দেবদেবী আরাধনার প্রয়োজন নেই। তিনি প্রজাদের উপর নিষেধ আরোপ করেন, কেউ ভুলেও ব্রহ্মা-বিষ্ণুর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারবে না। কিন্তু তাঁর পুত্র প্রহ্লাদই বিষ্ণুভক্ত হয়ে ওঠেন। নিজের ঘরেই দেব আরাধনা দেখে হিরণ্যকশিপু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তাঁর শত নিষেধ সত্ত্বেও প্রহ্লাদ তাঁর বিষ্ণুভক্তি ত্যাগ না করলে তিনি নিজের পুত্রকে বধ করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা তপস্যা করে প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছ থেকে, কারও মতে অগ্নিদেবের কাছ থেকে এক বিশেষ বস্ত্র লাভ করেন, যা ছিল পুরোপুরি অগ্নিনিরোধক। অর্থাৎ, সেই বস্ত্র পরিধান করলে ভয়াবহ আগুনও অঙ্গ স্পর্শ করতে সক্ষম হতো না। হিরণ্যকশিপু একটি অগ্নিকুণ্ড প্রস্তুত করে তার মধ্যে সেই বস্ত্র পরিধায়ী হোলিকাকে প্রবেশ করান। কোলে বসিয়ে দেন প্রহ্লাদকে, যাতে প্রজাকুল তাঁর প্রতি কোনও বিদ্বেষ পোষণ না করে। কিন্তু হোলিকা ভুলে যান যে ব্রহ্মা তাঁকে এই বস্ত্র দানের সময় বলেছিলেন, কারও ক্ষতি সাধন করলে বস্ত্রটি বিপরীত কাজ করবে। তাই তিনি সেই বস্ত্রে প্রহ্লাদকে আচ্ছাদিত করে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করলেন বটে, কিন্তু বিষ্ণুর ইচ্ছায় তা তাঁকে রক্ষা করল না। রক্ষা করল শুধু প্রহ্লাদকে। আর অগ্নিতে প্রাণত্যাগ করলেন হোলিকা। এই হোলিকা দহন উপলক্ষ্যে হোলি উৎসবের সৃষ্টি। শত বাধা সত্ত্বেও অবশেষে ভক্তিই জয়লাভ করে— এই সিদ্ধান্তকে মান্যতা দেওয়ার জন্যই আনন্দ উৎসবের আয়োজন।
এই কাহিনিটি আবার ভিন্ন ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে। স্বয়ং বিষ্ণু যখন কৃষ্ণরূপে অবতরণ করেন, তখন বৃন্দাবনে তার লীলাকে কেন্দ্র করে দোল উৎসবের সৃষ্টি। আবার অন্য মতে, রাজা কংস শিশু কৃষ্ণকে বধ করতে পুতনা নামে এক রাক্ষসীকে প্রেরণ করেন। পুতনা তাঁর বিষাক্ত স্তন্যদুগ্ধ শিশু গোপালের মুখের কাছে নিয়ে যান। এবং সেই আশ্চর্য বালক সেই দুধ পান করতে থাকেন। শুধু তাই নয়, পুতনার রক্তও পান করেন কৃষ্ণ। ফলে পুতনার রাক্ষসী রূপ প্রকাশিত হয় এবং আগুন জ্বলে ওঠে। সেই আগুনে প্রজ্জ্বলিত বহ্নি পুতনা রাক্ষসী। আর বিষ পান করে কৃষ্ণের গাত্রবর্ণ হয়ে ওঠে কালো। এ নিয়ে এক সময় তাঁর মনেও সংশয় দেখা দেয়। তিনি কৃষ্ণবর্ণ, উজ্জ্বল বর্ণের রাধা ও অন্যান্য গোপীগণ তাঁকে পছন্দ করবে তো? মলিন মুখে একথা ভাবতে বসেন কৃষ্ণ। তাঁকে চিন্তিত দেখে মা যশোদা বলেন, এতে চিন্তা করার কিছু নেই। রাধার ও অন্যান্য গোপীদের মুখে রং মাখিয়ে দিলে তাঁরা আর কৃষ্ণের গাত্রবর্ণ নিয়ে আপত্তি করবে না। মা যশোদার ঠাট্টাচ্ছলে বলা কথাগুলো মনে ধরে কৃষ্ণের। তিনি আবির আর গুলালে রঞ্জিত করেন রাধা ও গোপিনীদের। তাঁর এই রং মাখাবার খেলাই রঙের উৎসব দোল।
কেবল বৈষ্ণব নয়, শাক্ত ও শৈব ভাবনায় এই দোল উৎসবের মাহাত্ম্য আছে। এর পিছনেও পৌরাণিক কাহিনির উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষকন্যা সতীর দেহত্যাগের পর স্ত্রীর শোকে ধ্যানমগ্ন হলেন শিব। সেই ধ্যান ভঙ্গের চেষ্টা কম হল না। কিন্তু একে একে সকলে ব্যর্থ হলেন। এদিকে তাড়কাসুরের অত্যাচারে দেবকুল অতিষ্ট হয়ে ঊঠেছেন। তাকে বধ করতে পারবে একমাত্র শিবপুত্রই। তাহলে উপায়? শিবকে বিবাহে রাজি করাতে পারেন একমাত্র আদ্যাশক্তি। দেবতাদের অনুরোধে দেবী হিমালয় কন্যা পার্বতী হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন। কিন্তু পার্বতীকে দেখে মোটেই চিনতে পারেন না শিব। তখন দেবতারা কামদেবতার শরণ নিলেন। ঠিক হল, বসন্ত পঞ্চমীর শুভ তিথিতে পার্বতী শিব সম্মুখে সমাগতা হবেন এবং ঠিক সেই সময়েই কামদেব তাঁর পুষ্পধনুর শর নিক্ষেপ করবেন দেবাদিদেবের দিকে। পরিকল্পনা যতই নিখুঁত হোক, কামদেব সেই কাজে সফল হলেন না। উপরন্তু কামদেবের উপস্থিতি টের পেয়ে তাঁকে তিরতির করে কম্পমান তৃতীয় নয়নের বহ্নিতে একেবারে ভষ্মে পরিণত করলেন শিব। কামদেব পত্নী রতি তো কেঁদে কেঁদে উন্মাদ প্রায় হলেন। এদিকে শিবকে তুষ্ট করতে পার্বতী শুরু করলেন কঠোর তপস্যা। দিনের পর দিন অতিবাহিত হল। অবশেষে একদিন পার্বতীর তপস্যায় তুষ্ট হলেন শিব। একসময় শিব ও পার্বতীর বিবাহ সম্পন্ন হল। তখন কাম-পত্নী রতির অনুরোধে কামদেবকে প্রাণদান করলেন দেবাদিদেব। কিন্তু দেহ দিলেন না। সেই থেকে কামদেব অদৃশ্য থেকে নিজের কাজ করে চলেন। বসন্ত পঞ্চমীর দিন কামদেব ভষ্মে পরিণত হয়েছিলেন আর পূর্ণিমার দিন তিনি প্রাণ ফিরে পান। কামদেবের নবজন্মকে স্মরণ করে এই পূর্ণিমা বসন্ত পূর্ণিমা নামে চিহ্নিত হল। সেই থেকে শাক্ত ও শৈব ভাবনাতে বিশেষ স্থান অধিকার করল এই উৎসব। পুরাণ কাহিনীর মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও দু’টি বিষয় কিন্তু সব কাহিনির মধ্যেই দেখা যায়। প্রথমে অগ্নিতে ভষ্ম হওয়া, তারপর সেই ভষ্মের টিকা মাথায় নিয়ে রঙের উৎসবে মেতে ওঠা। অগ্নি প্রজ্জ্বলন আর ফাগ—এ দু’টির মধ্যে সম্পর্ক কী কিছু আছে? নিজের ক্ষুদ্রতাকে নিঃশেষ করলেই, ভষ্মে পরিণত করলেই আসে প্রকৃত উৎসব ও আনন্দের ক্ষণ। হয়তো এই আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে এই উৎসবের খুঁটিনাটি।
বাংলায় দোল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসব। কারণ, অধিকাংশ পরিবারে এই পূর্ণিমা পারিবারিক উৎসব রূপে পালিত হয়ে থাকে। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের জন্মভূমি ও বৈষ্ণব ভাবনার প্রচারভূমি এই বাংলা। তাই যে পরিবার বৈষ্ণবভাবাপন্ন বা যে পরিবারে শ্রীকৃষ্ণ গোপাল বা কৃষ্ণরূপে গৃহদেবতার আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন, সেই পরিবারে দোল কেবল রং খেলা নয়। সেখানে দোলের দিন বিশেষ পূজা হয়। সেই পূজায় নিবেদিত হয় আবির। আর সেই আবির গুরুজনদের পায়ে দিয়ে প্রণাম করার পরই উৎসবের সূচনা। তবে এই আবিরের প্রয়োগ কবে থেকে শুরু হয়েছে, সে বিষয়ে পুরাণ নানা মত প্রদান করে। ফুলের পাপড়ি গুঁড়ো করে তৈরি আবির অনেক সময় বিজয় উপলক্ষ্যেও ব্যবহৃত হতো। পুরাণকার বলেছেন, অত্যাচারী কংসকে বধ করলে মথুরা নগরে বিজয় উৎসবের সূচনা হয়। মথুরাবাসী সকলে মিলে আবিরে রাঙিয়ে দেয় কৃষ্ণ ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরামকে। রক্তবর্ণের লাল আবিরের কথাও এই সময় উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু এত কিছুর পরও দোল হল প্রেমের দিবস। পুরাণের কামদেব এই দিনে নবজাগরিত হয়েছিলেন। নব বসন্ত এসেছিল দেবকুলে। প্রতি বছরই তাই এই তিথিতে নবভাবে জাগরিত হয় প্রেম, আনন্দ। তাই এই তিথিতে পালিত হয় বসন্ত উৎসব। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নব বসন্তকে স্মরণ করে লিখেছেন, ‘মধুর বসন্ত এসেছে , মধুর মিলন ঘটাতে।’ আসলে এই তিথি হোল দেবতা ও মানবের একত্রে উদ্বেলিত হওয়ার ক্ষণ। এই মিলন অতিজাগতিক বিষয়ের সঙ্গে একেবারে জাগতিক ক্ষেত্রের মিলন।
মনে প্রশ্ন আসে , এই রঙের উৎসবের নাম দোল হল কেন? প্রকৃতিতে কে দোলা দেয়? এই দোলন আসলে মানুষের জীবনের স্বরূপ। সে একবার নীচে নামে আবার তুঙ্গে ওঠে। এই ঢেউয়ের মতো গতিতে জীবন এগিয়ে চলে। সেই জীবনের রূপক হিসেবে এই উৎসবকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে আমরা তত্ত্বের দিকে যাব না। দোলের আনন্দই সাধারণের কাছে প্রথম ও প্রধান বিষয়। আবিরে কুমকুমে রাঙা দোল আমাদের জীবনে সামাজিক সম্মেলনের কাজ করে। জীবন ও জগৎ হয়ে ওঠে সুন্দর, প্রাণময়।