মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
সত্যিই আমাদের বাড়িতে এলেন সেই হিতৈষী সমাজবন্ধু। ভাগ্যিস, তখন বাবা ছিলেন না বাড়িতে। মা, ঠাকুমা ছাড়াও ছিলেন ছোটকাকু।
হিতৈষী বললেন, আপনাদের ছেলে এই কাণ্ড করে। একই সঙ্গে তা বেআইনি এবং বিপজ্জনক। ফুটবল খেলুক, বারবেল করুক, খামোখা ট্রামের পিছনে ছোটা কেন?
কাকু বললেন, ‘কান ধর, আর কখনও এরকম করবি না। নো ট্রাম।’
আমার ছোটকাকু আরও বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে এনে বাড়িতে তাস খেলতেন। তাস বিলি করার পর এক একজন কী সব হাঁকতো। ওয়ান হার্ট, টু ক্লাব এইসব আর কী। এইসব হাঁকাহাঁকির মধ্যে কাকু বা কাকুর বন্ধুরা মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে উঠত, নো ট্রাম। জানি তো, নো ট্রাম। আর তো চলতি ট্রামে উঠিনি। তা হলে কেন আবার নো ট্রাম? আমাকে শোনাবার জন্য? নাকি নিজেরাও বার বার শপথ করছেন! ট্রামে চড়া কী এতই খারাপ? বড় হয়ে বুঝেছি, ওঁরা ট্রাম বললেও আসলে তা ট্রায়াম্ফ। ব্রিজ খেলার একটা জার্গন। হয়তো তাঁরাও জানতেন না। তখন কয়েকদিন নো ট্রাম পর্ব চললেও ট্রামই ট্রায়াম্ফ করল। মানে বিজয়। শাড়ির সেরা তাঁতের শাড়ি, গাড়ির সেরা ট্রাম গাড়ি—দু’টোই বাঙালির একান্ত।
ট্রামের দু’টি কামরা। সামনে ফার্স্ট ক্লাস, পিছনের অংশ সেকেন্ড ক্লাস। সবুজ রেক্সিনে মোড়া গদি আঁটা চেয়ার শোভিত ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট ছিল গোলাপি রঙের। সেকেন্ড ক্লাসে কাঠের পাতি লাগানো বেঞ্চি, টিকিটের রং হলুদ। ১৯৬৫ সাল নাগাদ ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট ছিল ৮ পয়সা, সেকেন্ড ক্লাস ৬ পয়সা। এর আগে দীর্ঘদিন সেকেন্ড ক্লাসে পাঁচ এবং ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া ছিল ছ’পয়সা। ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে ট্রাম কোম্পানির ভয় কাজ করত। ১৯৫৩ সালে ১৩টি ট্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার কথা মনে পড়ত হয়তো।
আমার যখন ক্লাস এইট হচ্ছে, বাবা বাগবাজার অঞ্চলের স্কুল থেকে সরিয়ে ভর্তি করে দেন হেয়ার স্কুলে। স্কুলে যেতাম পাঁচ নম্বর ট্রামে চড়ে। প্রথম ক’টা দিন ড্রাইভারের কারিকুরি দেখার জন্য ফার্স্ট ক্লাসের এক্কেবারে সামনের সিটে গিয়ে বসতাম। ট্রামের স্টিয়ারিং থাকে না। একটা সরু টেবিলের মত একটা জিনিসের উপর একটা হাতলের মত কী যেন থাকে। সেটা আবার পেতলের। ভারী আশ্চর্য লাগত। ট্রাম ছিল ব্রিটিশ কোম্পানির, ওদের আদব কায়দাই আলাদা। ড্রাইভার-কন্ডাক্টরদের পোশাক আলাদা আলাদা। কন্ডাক্টরদের বুকের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটা চামড়ার বেল্টের উপর ফিট করা একটা যন্ত্র। টিকিট ঢুকিয়ে ফটাক করে ফুটো করে দিত। অনেকেই ট্রামের টিকিট জমাতাম। পাঁচটা ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট ছিল দশটা সেকেন্ড ক্লাসের সমান। সিগারেট প্যাকেটের তাস দিয়ে ‘চিপ্পু’ খেলার জরিমানা দিতাম। ‘চিপ্পু’ খেলার সংবিধান অনুযায়ী, চারমিনার আর পাসিং শো সিগারেটের প্যাকেট ছিল সবচেয়ে সস্তা। ক্যাপস্টান, উইলস, গোল্ড ফ্লেক ছিল দামি। কাঁচি, ক্যামেল ছিল মাঝামাঝি। সিগারেট প্যাকেটের অভাব হলে ট্রামের টিকিটেও ক্ষতিপূরণ হতো। বিনিময় মূল্য আবার অঞ্চল বিশেষে পাল্টে যেত। ট্রামের টিকিট মিলত কলকাতায়। ফলে মফঃস্বলের চিপ্পুতে ট্রাম টিকিট গ্রাহ্য হতো না।
ট্রামে মাঝে মাঝে চেকার আসত। মাথায় টুপি। দেখেই সম্ভ্রম জাগত। বাসের ড্রাইভার কন্ডাক্টররা কিন্তু ট্রামের মতো সমীহ আদায় করতে পারত না। ট্রামের মাহাত্ম্য আলাদা।
সেই সময়ে বাস-ট্রামের টিকিট রিস্টওয়াচের তলায় গুঁজে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। আমাদের এক আত্মীয় ছিলেন, একটু বড়লোক বড়লোক ভাব। রিস্টওয়াচের তলায় গোঁজা থাকত গোলাপি টিকিট। ভাবখানা হল— দেখছ, আমি ফার্স্ট ক্লাসেই চড়ি।
বাবা ফার্স্ট ক্লাসে চড়তেন না। দু-এক পয়সার তফাৎ, তবুও। সেকেন্ড ক্লাসে চড়েও তো একই জায়গা যাওয়া যায়। তবে কেন পয়সা বেশি দেব? গদি-চেয়ার আর ফ্যানের হাওয়ার জন্য?
স্কুলে যাবার সময় তো ট্রামের ডিপো থেকে উঠতাম। বসেই যেতাম। সেকেন্ড ক্লাসে। কিন্তু ফেরার সময় অন্য কায়দা ছিল। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে থাকত দুটো দরজা। কন্ডাক্টর একজন। ট্রামে ওঠার সময় দেখে নিতে হতো কন্ডাক্টার সাহেব কোথায় অবস্থান করছেন। যদি পিছনের দিকে থাকেন, তখন সামনের দিকে ওঠা বিধেয়, সামনে থাকলে পিছনে। কোনও কোনও কন্ডাক্টর এসব দেখে দ্রুত চলে আসার উপক্রম করলেই চলন্ত ট্রাম থেকে নেমে যাওয়া। এইভাবে কিছু পথ অতিক্রম করতে পারলেই কাজ হাসিল। মানে, দশ পয়সা বাঁচল। সেই পয়সায় এক প্লেট ঘুগনি বা একটা বড় সিঙ্গাড়া। কিছুদিন পর নতুন ডিজাইনের ট্রাম এল। একটাই বড় দরজা। এই ট্রামের সঙ্গে দুই দরজাওলা ট্রামও চলত। এক দরজার ট্রাম ছিল ভীষণ অপছন্দের। অপেক্ষা করতাম দু’দরজাওলা ট্রামের জন্য। ধীরে ধীরে সেই ট্রাম উঠে গেল।
হাওড়ায় দু’কামরার ট্রাম ছিল না। একটি কামরা, দু’পাশে দরজা। উত্তরমুখী ট্রামে ড্রাইভার উত্তরদিকে দাঁড়িয়ে চালাতেন। সেই ট্রাম দক্ষিণমুখী হলে ড্রাইভার সাহেবের অবস্থান বদলে যেত। কলকাতায় দিনের প্রথম ট্রাম চলত খুব ভোরে। যাঁদের বাড়ি ট্রাম লাইনের পাশে, তাঁদের ঘুম ভাঙত ট্রামের শব্দে। তারও আগে ছিল জলের ট্রাম। এক কামরার ট্রামটি আদতে একটি জলের ট্যাঙ্ক। সামনে জলের প্রস্রবণ। লাইন ভেজাবার জন্য ছিল এই ট্রাম।
প্রথম দিকে ঘোড়ায় টানতো। ঘোড়ার জল খাওয়ার জন্য বড় বড় লোহার পাত্র কিছুদিন আগেও দেখেছি চিৎপুর, খিদিরপুরে। পরে কিছুদিন চলে বাস্পীয় ইঞ্জিনের ট্রাম। ১৯০২ থেকে কয়েকটি রুটে চালু হল ইলেকট্রিক ট্রাম। ট্রাম বাঙালির অতি প্রিয় বাহন ছিল। যে রাস্তায় ট্রামের ব্যবস্থা আছে, সেখানে কেউ বাসে উঠতেই চাইতেন না।
আকাশবাণীতে কাজে ঢুকেছি, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ততদিনে অবসর নিয়েছেন। মাঝে মাঝে আসতেন। ওঁকে ধর্মতলা ট্রাম ডিপো পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন কেউ কেউ। উনি ট্রাম ছাড়া অন্য কিছুতে চড়তে চাইতেন না। ওঁর কাছে শুনেছি, গাস্টিন প্লেসের অফিসে আবার বসার সিট ছিল না। অনেকেই ডালহৌসির ট্রামডিপোতে অতিরিক্ত ট্রামে বসতেন।
ক্লাস টেন। ট্রামে একটি মেয়েকে দেখতাম, লাল স্কার্ট। ঠনঠনিয়ার কাছে কোনও স্কুলে পড়ত। শ্যামবাজার থেকে উঠত। ওকে দেখেই আমার প্রথম কবিতা লেখা। ট্রামেই—
‘ও মেয়ে, তুই আর একটু বোস ট্রামে
এখন তো সব, হেথায় হোথায় নামে
আর দু’এক স্টপ পরেই আমার পালা
ততক্ষণ তুই রূপের আগুন জ্বালা।’