মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
এই জীবনের টানেই ছুটে আসি ভারতে। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্মতিথি উপলক্ষ্যে। এনিয়ে পর পর চারবার। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস থেকেই শুরু হয় প্রহর গোনা। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থানের আধ্যাত্মিক টান এমনই, মস্কোর সেন্ট্রাল পার্কের বাড়িতে থাকতে বসে থাকতে পারি না। অস্থির অস্থির লাগে। প্রতি বছর মার্চ মাসের এই গৌর পূর্ণিমা বা দোল পূর্ণিমার সময় চলে আসি মায়াপুরে। এই সময়টা কোনও এক অদৃশ্য জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় সম্পূর্ণ বদলে যায় খুব চেনা মায়াপুর। ফাগুনের মিঠে বাতাসে পাতা ঝরার শব্দের ছন্দে বদলে যায় ইস্কন সহ গোটা এলাকার সামগ্রিক চিত্র। আবির্ভাব উৎসবে আনন্দের ছোঁয়া লাগে রঙিন আবিরের। আনন্দের ছোঁয়া লাগে কৃষ্ণভক্তদের জীবনেও। কেউ হাঁটছেন, কেউ দৌড়চ্ছেন, কেউ নাচছেন, কেউ বা আবার গাইছেন। সকলেই আনন্দে আত্মহারা। দু’হাত তুলে সকলেই আহ্বান জানাচ্ছেন মহাপ্রভুকে। নাচে-গানে-প্রার্থনা-সংকীর্তনে আধ্যাত্মিক তুফান উঠছে। সেই হাওয়া ছড়িয়ে পড়ছে দেশ-দেশান্তরে।
এই মাটিতেই ভারতীয় ভক্তদের সঙ্গে কৃষ্ণসংকীর্তনে মেতে উঠতে দেখি রাশিয়া, ইউক্রেন, সার্বিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা থেকে আসা ভক্তদের। দ্বিধা-সংকোচের বেড়াজাল তুড়িতে উড়ে যায়। ভক্তিপ্রেমের আনন্দে গা ভাসিয়ে দেন নিয়াজ, আর্জুনা সাকা, দেবশিখর গোবিন্দ দাসের মতো কতশত মানুষ। সার্বিয়ার আকিনচান বলরাম দাসের কথাও বলতে হবে। ওঁর আসল নাম আলেকজান্দ্রিয়া। ৩০ বছর ধরে নানান দেশে ঘুরছেন ইস্কনের কাজে। এর মধ্যে মায়াপুর ইস্কনেই রয়েছেন প্রায় ১৩ বছর। বৃন্দাবনের হোলি উৎসব ও মায়াপুরের গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাবের উৎসব—দুই-ই দেখেছেন। তিনিও কতবার কথায় কথায় বলেন, ‘নবদ্বীপ আর বৃন্দাবনের কোনও পার্থক্য নেই। নবদ্বীপে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মদিনে আর বৃন্দাবনে সবাই হোলি উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠেন।’ এমনকী আমেরিকায় থাকার সময়েও অনেক মন্দিরে হোলি খেলার সাক্ষী ছিলেন তিনি। সেখানেও রং খেলার পাশাপাশি চলত হরিনাম সংকীর্তন। কিন্তু মায়াপুরের মতো আবেগ আর কোথাও দেখেননি কেউ।
কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর হয়ে আমারই দেশ থেকে এখানে এসেছেন নিয়াজ। প্রথমবার। আমাদের দোল-যাপন নিয়ে তাঁর আগ্রহ প্রচণ্ড। বলা ভালো, আমাদের দোল দেখতেই তাঁর ভারতে আসা। রাশিয়ায় থাকাকালীন বছরের এই সময়ে শহরের বাইরে কোনও নদী বা জলাশয়ের ধারে জড়ো হতেন নিয়াজরা। মেতে উঠতেন রঙের খেলায়। অবশ্য সেখানে যাঁরা আসতেন, তাঁরা সবাই যে রং খেলতেন—এমনটা নয়। আনন্দের অংশীদার হতেও জড়ো হতেন অনেকে। শ্রীকৃষ্ণের লীলার ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে উঠত শ্বেতশুভ্র তুষারভূমিও। এখানে ইস্কনে অবশ্য রং খেলা হয় না। কিন্তু গৌরাঙ্গপ্রভুর জন্মদিনে আমরা সংকীর্তন, নাচ, গানের মাধ্যমে খুব আনন্দ করি। ধরাধামে মহাপ্রভুর আবির্ভাবের আনন্দ। সেই আনন্দের রং নিয়াজের মনকেও রাঙিয়ে দেবে—আমি নিশ্চিত। ইস্কন প্রাঙ্গণের বাইরে অবশ্য অনেক জায়গায় রং খেলা হয়। অনেকেই সেখানে যান। মেতে ওঠেন রঙের উৎসবে। ব্যক্তিগতভাবে রঙের খেলা আমার খুব একটা পছন্দের নয়। তাই কিছুটা দূরে দূরেই থাকি। কিন্তু দেখতে ভালো লাগে ভীষণ। আসলে, আনন্দকে কাণ্ডারী করেই তো আমাদের মহাপ্রভুর চিন্তাধারাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। রং খেলা তো মাধ্যম মাত্র। আগে যখন ভারতে আসিনি, তখন অন্য ভক্তদের রাশিয়ার মাটিতেই মেতে উঠতাম গৌরাঙ্গ সাধনায়। সেই ২০০৬ সাল থেকে। তবে মহাপ্রভুর আবির্ভাব উৎসব যে এত রঙিন হয়ে উঠতে পারে, তা জেনেছি বৃন্দাবন ও মায়াপুরে এসেই। দোল পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় আবিরে রাঙানো অদৃশ্য সুতোয় একসুরে বাধা পড়ে গোটা বিশ্ব।
ছবি : সমর বিশ্বাস