মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
মার্কিন বিদেশ দপ্তরে প্রায় ৩৩ বছর কাজ করেছেন বার্নস। দুঁদে কুটনীতিবিদ বলে যথেষ্ট সুনাম রয়েছে কাজপাগল এই আমলার। মার্কিন ক্ষমতার অলিন্দে বার্নসের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন করার মতো লোক সেই অর্থে নেই। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনে ডেপুটি বিদেশ সচিবের পদে কাজ করেছেন বার্নস। গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ’র ইতিহাসে তিনিই প্রথম ডিরেক্টর, যিনি আপাদমস্তক একজন পেশাদার কূটনীতিবিদ।
সিআইএ’র ডিরেক্টর হওয়ার পর উইলিয়াম বার্নস চষে বেরিয়েছেন আঙ্কারা থেকে তেল আভিভ, নয়াদিল্লি থেকে কিয়েভ। কেউ টের পায়নি তাঁর অবস্থান। কিন্তু সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়া সফরে এসে ল্যাজেগোবরে হতে হয়েছে তাঁকে। প্রথমে তাঁর নেপাল সফর নিয়ে আপত্তি, পরে শ্রীলঙ্কা সফর শেষে সেই দেশে রাজনৈতিক শোরগোল সিআইএ প্রধানকে বিব্রত হওয়ার মতো অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। সিআইএ’র ইতিহাসে এমন ঘটনা নজিরবিহীন। প্রশ্ন উঠেছে, এর পিছনে কার মদত থাকতে পারে? এটা অস্বাভাবিক নয়, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় বার্নসকে নিয়ে বিতর্ক তৈরির পিছনে বেজিংয়ের উৎসাহ থাকতে পারে। কিন্তু এরকম অনুমান প্রমাণ করা কঠিন।
ঘটনা হল, ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে বার্নসের নেপাল সফরের কথা ছিল। সিআইএ’র দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম তাঁর কাঠমান্ডু যাওয়ার কথা। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষপ্রান্তে হঠাৎ খবর ছড়ায়, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কুমার দহল ওরফে প্রচণ্ড এই সফরে আপত্তি জানিয়েছেন। নেপালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের যুক্তি দেখিয়ে প্রচণ্ড বলেন, এই সময় সিআইএ প্রধানের সফর ‘চারদিকে’ ভুল বার্তা দেবে। সেই নির্বাচন ছিল ৯ মার্চ। নেপালে সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী পদ সবচেয়ে গুরুত্ববহ, প্রেসিডেন্ট নয়। এই রকম একটা কম গুরুত্বের নির্বাচনে সিআইএ প্রধানের প্রায় তিন সপ্তাহ আগের সফর কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, কারও কাছে তা স্পষ্ট হয়নি। প্রচণ্ডর সেই আপত্তির পর উইলিয়াম বার্নসের ১৮ ঘণ্টার ওই সফর বাতিল হয়ে যায়।
নেপালে উইলিয়াম বার্নসের যাওয়ার কথা ছিল শ্রীলঙ্কা থেকে। শ্রীলঙ্কার নাগরিকরা অবশ্য সিআইএ প্রধানের সফর সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। সেটা ফাঁস করে দেয় স্থানীয় এক কমিউনিস্ট পার্টি। ওই দলের সাধারণ সম্পাদক ডা. উইরিসিংহে প্রথম ৪ মার্চ বিষয়টি সংবাদমাধ্যমকে জানান। তিনি শ্রীলঙ্কার সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চান, ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার-৩’ বিমানে আমেরিকা থেকে যাঁরা কলম্বোয় এসেছেন, তাঁদের মধ্যে কি উইলিয়াম বার্নস ছিলেন? তিনি অভিযোগ তোলেন, বার্নস ও তাঁর সঙ্গীদের সফর সম্পর্কে তথ্যপ্রমাণ গোপন করা হচ্ছে। কারণ, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তার কোনও রেকর্ড রাখেনি। উইরিসিংহের বিবৃতি শ্রীলঙ্কায় বেশ সাড়া ফেলে দেয়। তাকে আরও উস্কে দেন এমপি উদয় গাম্মানপিলে। তিনি অনেক নতুন তথ্য জুড়ে দেন। তাঁর দাবি, বার্নসের সফরে ওয়াশিংটন কলম্বোর কাছে কয়েকটি নিরাপত্তা ইস্যু তুলেছে। শ্রীলঙ্কার সংসদে গাম্মানপিলের অবস্থান রাজাপক্ষে দলের নেতৃস্থানীয় একজন হিসেবে। আর উইরিসিংহের কমিউনিস্ট পার্টি সর্বশেষ নির্বাচনে রাজাপক্ষের জোটেই ছিল। শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে এবং নেপালে প্রচণ্ডদের ‘মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি’ উভয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে চীনের শাসকদের বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল বা আছে। ফলে উভয় দেশে উইলিয়াম বার্নসকে নিয়ে তাঁদের অবস্থানে ভূরাজনৈতিক উপাদান থাকা বিচিত্র নয়।
তবে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট বা সরকারের কেউই সিআইএ নিয়ে বিতর্কে মুখ খুলছেন না। যদিও এমপি গাম্মানপিলের সূত্রে স্থানীয় পত্রপত্রিকাগুলি জানিয়েছে, বার্নসের সঙ্গে প্রযুক্তিভিত্তিক যন্ত্রপাতি ভর্তি আরও দু’টি পরিবহণ বিমান এসেছিল। প্রযুক্তিগত লড়াইকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন সিআইএ প্রধান। সিআইএ’র দায়িত্ব নেওয়ার পর বার্নস এজেন্সিতে একটি নতুন পদও যোগ করেছেন। যার নাম চিফ টেকনোলজি অফিসার বা সিটিও। সিআইএ-র সেই প্রযুক্তি বিভাগের মাথায় বসিয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত নন্দ মুলচন্দানিকে। ৫২ বছরের মুলচন্দানি বেসরকারি ক্ষেত্রে বহু স্টার্ট আপ সংস্থার সিইও হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন। তারপরে আমেরিকার প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রযুক্তি বিভাগের দেখাশোনার দায়িত্বেও ছিলেন। সিআইএ প্রধান শ্রীলঙ্কায় যৌথ উদ্যোগে গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণের একটা সেন্টার গড়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে শ্রীলঙ্কা সফরে মুলচন্দানি ছিলেন কি না তা জানা যায়নি। এছাড়া ওয়াশিংটন শ্রীলঙ্কায় ‘বায়োমেট্রিক ইমিগ্রেশন কন্ট্রোল সিস্টেম’ গড়তে চাইছে। এরকম উদ্যোগ নেওয়ার অর্থ, শ্রীলঙ্কায় চীন ও ভারতের শিল্পপতিদের তথ্যের গোপনীয়তা আর থাকবে না। এর বাইরে আমেরিকা ‘সোফা’ চুক্তিও (স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট) করতে চায়। এসব প্রস্তাব এমন সময় এসেছে, যখন শ্রীলঙ্কার শাসকদের জন্য আইএমএফের ঋণ পাওয়া অতি জরুরি। ২.৯ বিলিয়ন ডলারের একটা ঋণের অঙ্ক নিয়ে আলোচনাও চলছে।
নেপালের অর্থনৈতিক অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো টানাপোড়েনে না থাকলেও আমেরিকা তার ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের কৌশলগত কর্মসূচিতে এই দেশটিকেও চায়। ফলে নেপালে ইতিমধ্যে ৫০ কোটি ডলারের একটা অনুদান দিয়েছে আমেরিকা। ওই অনুদান নেওয়ার স্পষ্ট বিরোধিতা করেছিল বেজিং। ২০২২-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি চীন সরকারের ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস ওই অনুদানকে ‘জবরদস্তিমূলক কূটনীতি’ হিসেবে মন্তব্য করে।
ঠিক একই সময় নেপালের কমিউনিস্টরাও অনুদান গ্রহণের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখায়। প্রতিবাদী
ওই বিরোধী শক্তিই এখন কাঠমান্ডুর ক্ষমতায়। সেই শক্তি সিআইএ প্রধানের নেপাল সফর বাতিল করতে উঠে পড়ে লেগেছিল।
নেপালের মতো অবস্থান অবশ্য শ্রীলঙ্কার নেতৃত্ব নেননি। উইলিয়াম বার্নসের সফর নিয়ে তাঁরা চুপচাপ থাকলেও ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ অফিসারদের আরও একটা দল ১৬ ফেব্রুয়ারি কলম্বো সফর করে গিয়েছে। এই দলের প্রধান ছিলেন জেদিদিয়া পি রয়্যাল। জেদিদিয়া আগে ন্যাটোতেও কাজ করেছেন। জেদিদিয়ার এই সফরের পর থেকে শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক গুজব ছড়িয়েছে, ত্রিঙ্কোমালিতে আমেরিকা কিছু সেনা রাখার জায়গা চায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ত্রিঙ্কোমালি ছিল ব্রিটিশ নেভির ঘাঁটি। তারও আগে ডাচদের হাত থেকে প্রথম এই জায়গাটি দখল করেই ব্রিটিশরা শ্রীলঙ্কায় ঢুকেছিল। সেই ত্রিঙ্কোমালিতে আমেরিকার নজর যে চীন-ভারতের উদ্বেগ বাড়াবে, সেটাই স্বাভাবিক।
একসময় সোভিয়েত রাশিয়ার সমস্ত পদক্ষেপের উপর নজরদারি চালানো ছিল আমেরিকার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মস্কোই ছিল সেই সময়ে ওয়াশিংটন ডিসির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ সেই সময়ে এজেন্ট তৈরি করেছিল সোভিয়েতের নানা প্রান্তে। মস্কোর অজান্তে রুশ সরকারি অফিসারদের মধ্যেই অনেকে মার্কিন এজেন্ট হয়ে উঠেছিলেন। একইভাবে আমেরিকার উপরেও নজরদারি চালাত রুশ গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি। আমেরিকা এবং রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থা পরস্পরের উপর গোপন নজরদারি এখনও চালায়। কিন্তু ওয়াশিংটনের কাছে এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ চীনের উপর নজরদারি। বিশেষজ্ঞরা অনেকে মনে করছেন, সম্প্রতি রাশিয়া-ভারতের জ্বালানি বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে নয়াদিল্লির অবস্থানও
সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করেছে আমেরিকা।
মার্কিন মিত্র ইজরায়েল ও তুরস্কের মতো ভারতও ইউক্রেনের যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। ফলে ভারতের উপর নজরদারি বাড়াতে শ্রীলঙ্কাতেও ঘাঁটি গাড়তে চাইছে ওয়াশিংটন।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আক্সেল দ্য ভারনিউ এশিয়া টাইমসে লিখেছেন, নিউ স্টার্ট চুক্তি (পরমাণু চুক্তি) থেকে মস্কোর বেরিয়ে আসার পর রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক দ্রুতগতিতে বিকশিত হচ্ছে। চীনের নতুন বিদেশমন্ত্রী ঝিন গ্যাং বলেছেন, ‘বিশ্বে আজ যেভাবে অস্থিতিশীলতা বাড়ছে, তাতে রাশিয়া-চীনের সম্পর্ক টেকসই হওয়া প্রয়োজন।’ রাশিয়ানদের সঙ্গে চীনাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক কোন দিকে গড়াচ্ছে, সেটা এখন আমেরিকার কৌশলগত অগ্রাধিকারের বিষয়। তাই ভারতের প্রতি ওয়াশিংটনের সরাসরি মনোযোগ দেওয়া উচিত। ভারতকে ক্রেমলিনের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করাই ওয়াশিংটনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। একই সুরে নয়াদিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক ব্রহ্ম চেলানি বলেছেন, আমেরিকাকেও মনে রাখতে
হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা না থাকলে দ্বিপক্ষীয় অংশীদারি ধ্বংস হয়ে যায়। ওয়াশিংটন যদি কৌশলগত ফোকাস ইন্দো-প্যাসিফিকের দিকে সরাতে চায়, তবে
এশিয়ায় তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে হবে। কিন্তু আমেরিকা উল্টো অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমানবহরের আধুনিকীকরণের জন্য ইসলামাবাদের সঙ্গে ৪৫ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে। যা ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে মার্কিন অস্ত্র দেওয়ার তিক্ত
স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছে।
প্রশ্ন উঠছে, ওয়াশিংটন ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতে ঘাঁটি গাড়তে চাইছে কেন? সিআইএ প্রধান উইলিয়াম বার্নসের কু-নজরে আসলে কে?