মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
আমার সংক্ষিপ্ত তালিকায় পাঠকরা তাঁদের পর্যবেক্ষণ যোগ করতে পারেন, কীভাবে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে। এখানে আমার তালিকা:
১. বিরোধী দলের সদস্যরা, জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ জরুরি বিষয় রাজ্যসভার কার্যপ্রণালী বিধির বিধি ২৬৭ (লোকসভার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম রয়েছে) অনুসারে আলোচনা করার দাবি জানান। গত কয়েক মাসে, জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ জরুরি বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করার জন্য উভয় কক্ষে বহুবার এই বিধি অনুসারে দাবি জানানো হয়েছে। তার মধ্যে ভারতে চীনা অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ এলএলসি রিপোর্ট পর্যন্ত অনেক বিষয়ই ছিল। কিন্তু অধ্যক্ষ প্রতিটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন। উপসংহার: ভারতের সংসদের হিসেবে, ‘জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ জরুরি বিষয়’ এমন কিছু নেই, যার আলোচনার জন্য সেইদিনের নির্দিষ্ট কার্যসূচি বাদ রাখা প্রয়োজন। আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, ভারতীয় জনগণ এতটাই নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং সন্তুষ্ট যে তাদের কোনও উদ্বেগ এবং জরুরি ভিত্তিতে সংসদে আলোচনার যোগ্য কোনও বিষয়ই নেই।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী
২. প্রধানমন্ত্রী যদি লোকসভার সদস্য হন, তবে তিনি সেই সদনের নেতা। ১৭তম লোকসভার নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সংসদের উভয় কক্ষে তিনি খুব কমই উপস্থিত থাকেন। প্রতিবছর রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের উপর বিতর্কের জবাব দেন তিনি। অন্যকোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি হস্তক্ষেপ করেছেন বলে আমি অন্তত মনে করতে পারছি না। সংসদে উত্থাপিত প্রশ্নগুলির জবাব দেন না প্রধানমন্ত্রী মোদি। তাঁর তরফে সাধারণত একজন মন্ত্রীই জবাব দেন। (প্রতি বুধবার হাউস অফ কমন্সে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকে। ভাবি, আমরাও যদি সেটা পেতাম।) সংসদে মোদিজির দৃষ্টিভঙ্গি জওহরলাল নেহেরু, মনমোহন সিং বা অটলবিহারী বাজপেয়ির থেকে ভীষণ অন্যরকম। এই প্রধানমন্ত্রী ‘প্রেসিডেন্সিয়াল’ হয়ে গিয়েছেন। যদি প্রধানমন্ত্রীরা প্রেসিডেন্সিয়াল হন এবং তাঁরা প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন, তবে ভারত বেশিদিন সংসদীয় গণতন্ত্র থাকবে না।
৩. হাউস অফ কমন্সের অধিবেশন চলে বছরে ১৩৫ দিন। ২০২১ সালে লোকসভার অধিবেশন হয়েছিল ৫৯টি এবং রাজ্যসভা বসেছিল ৫৮ দিন। ২০২২ সালে দুটি কক্ষেরই অধিবেশন সংখ্যা কমেছে—লোকসভা এবং রাজ্যসভা, প্রতিটিরই অধিবেশন হয়েছে ৫৬টি করে। বিঘ্ন ঘটার কারণে অনেকগুলি অধিবেশন বরবাদও হয়ে গিয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে অরুণ জেটলির একটি উক্তি, ‘ইচ্ছাকৃত বাধার সৃষ্টি (অবস্ট্রাকশনিজম) হল বৈধ সংসদীয় কৌশলের অঙ্গ।’ ২০১০ সালে শীতকালীন অধিবেশনের পুরোটাই একজন মন্ত্রীর পদত্যাগ এবং একটি যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) গঠনের দাবিতে বরবাদ হয়ে গিয়েছিল। সেই অধিবেশনে বরাদ্দ সময়ের মাত্র ৬ শতাংশ লোকসভা এবং ২ শতাংশ রাজ্যসভা ব্যবহার করতে পেরেছিল। কৌশল পরিমার্জিত হয়েছে দেরিতে। চলতি বাজেট অধিবেশনে (দ্বিতীয়ার্ধে) সরকার পক্ষই প্রতিদিন বিঘ্নসৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। অধিবেশনের দিনের স্বল্পতা এবং অধিক বাধাবিঘ্ন সংসদের অধিবেশনকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে। কোনওরকম বিতর্ক ছাড়াই বিলগুলো পাশ হতে পারত (সময়বিশেষে অতীতেও তা হয়েছে)। আমরা এমন একটি দিনের কথা ভাবতে শুরু করতে পারি—যখন পার্লামেন্ট বছরে কয়েকটি মাত্র দিন ‘বসবে’, কোনও বিষয়ে বিতর্ক হবে না, এবং সব বিল পাশ হয়ে যাবে হল্লা ও বিশৃঙ্খলার ভিতর দিয়ে।
বিতর্ক ছাড়াই সংসদ
৪. সংসদের দুটি কক্ষই হল বিতর্কের মঞ্চ। ভারতের পার্লামেন্টে অনেক বিখ্যাত বা স্মরণীয় বিতর্ক হয়েছে। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতের পরাজয় হয়েছিল অপমানজনক। সংসদে বিতর্ক হয়েছিল তা নিয়ে। হরিদাস মুন্ধরার কোম্পানির শেয়ারে এলআইসির বিনিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। বোফর্স কামান আমদানির অভিযোগ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল বহুবার। বিতর্ক হয়েছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংস ইস্যুতে। প্রতিটি বিতর্ক শেষ হয়েছে কোনওরকম ভোটাভুটি ছাড়াই। সংসদীয় গণতন্ত্রে, সরকারের পক্ষে বিতর্ককে ভয় পাওয়ার দরকারই নেই। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য সবসময় তো তারই পক্ষে থাকবে, এটাই ধরে নেওয়া যায়। তবুও আজকের সরকার বিতর্কের অনুমতি দিতেই রাজি নয়। একটি পুরনো সত্য এই যে, ‘বিরোধীদের কিছু বক্তব্য থাকবে এবং সরকারের থাকবে একটি পন্থা।’ আমি নিশ্চিত যে, সরকার দিশেহারা হওয়ার ভয় পায় না। সরকার যে ভয়টা পায় তা হল, বিরোধীদের বক্তব্যের ভিতর দিয়ে অপ্রিয় ও অস্বস্তিকর কিছু সত্য প্রকট হয়ে পড়বে। ভারত কি বিতর্কহীন সংসদীয় যুগের দিকে যাত্রা করেছে? আমি এই ভয়টাই পাই। আমার আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হলে, আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে, ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিদায় অনুষ্ঠান আসন্ন।
৫. কল্পনা করুন, সংসদের একটি অধিবেশন ডাকা হয়েছে। ভাবুন, সমস্ত সদস্য ওই মহান সদনে সমবেত হয়েছেন। আরও কল্পনা করুন যে, সমস্ত সদস্য একজন নেতা নির্বাচনের জন্য ভোট দিচ্ছেন, যিনি হবেন এই সাধারণতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি। সেই প্রার্থীর বিরোধিতা করে কোনও ভোট পড়ছে না। ভোটদানে কেউ বিরতও নন। আসলে, অন্য প্রার্থীও আছেন। এই ফলাফলকে দেশ উদযাপন করছে ‘পিপলস ডেমোক্রেসি’-র বিজয় হিসেবে। ভারতে এটা হতে পারে কি? এটা হতে পারে, কারণ আমরা দৃঢ় পদক্ষেপে একদলীয় শাসনের দিকেই এগচ্ছি। যদি ১৫টি রাজ্য একটি দলের শাসনে থাকে এবং সেই দলটি (এবং তার অবিচল বন্ধুরা) যদি লোকসভায় ৩৬২ জন সদস্য ও রাজ্যসভায় ১৬৩ জন সদস্য জিতিয়ে আনতে পারে, তবে ভারতের পক্ষে আর একটি ‘পিপলস রিপাবলিক’ হয়ে ওঠা ঠেকানো যাবে না। সৌভাগ্যবশত, সেই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা এখনও কিছুটা দূরে, তবে এটি পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ভারত যেদিন ‘পিপলস রিপাবলিক’ হয়ে উঠবে, সেদিন ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্র চির বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করবে।