মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
মহাশক্তিশালী কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এককভাবে কোনও দল লড়াই করে জয়ী হতে পারবে না। তাই জয়প্রকাশ নারায়ণের নির্দেশিকা ও ফর্মুলা অনুসরণ করে তৈরি হল একটি জোট। যার নাম দেওয়া হল জনতা মোর্চা। কয়েকটি দলের সম্মিলিত একক সংগঠন। সেই মোর্চার অন্তর্গত হয়েছিল, কংগ্রেস (সংগঠন),জনসঙ্ঘ, সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং লোকদল। গুজরাত বিধানসভা ভোটে এই মোর্চা একসঙ্গে লড়াই করবে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। জনসঙ্ঘের সভাপতি কে ছিলেন? লালকৃষ্ণ আদবানি। তাঁর থেকেও সিনিয়র আর এক নেতার নাম অটলবিহারী বাজপেয়ি।
১২ জুন গুজরাত বিধানসভার ভোটের ফলাফল ঘোষিত হয়। দেখা যায়, স্বাধীনতার পর এই প্রথম গুজরাতে কংগ্রেস পরাস্ত হয়েছে। জয়ী হয়েছে জনতা মোর্চা। এই ফর্মুলা যে সফল হবে, এটা বুঝে এরপর ১৯৭৭ সালে যখন ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থার অবসান ঘটিয়ে দেশে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা করেছিলেন, তখনও এই জনতা মোর্চাই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জোট করে লড়াই করবে স্থির করে। সেই নির্বাচনে লালকৃষ্ণ আদবানিদের স্লোগান কী ছিল? ইন্দিরা হটাও, দেশ বাঁচাও! নির্বাচনে ভরাডুবি হয় ইন্দিরা গান্ধীর। পতন ঘটে কংগ্রেস সরকারের।
জনসঙ্ঘকে জনতা দলে মিশিয়ে দিয়ে তাঁরা মোরারজি দেশাইয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের সরকারে যোগ দেন। এরপর ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে তাঁরা ভারতীয় জনতা পার্টি নামক নতুন একটি দলের জন্ম দেন। লালকৃষ্ণ আদবানি দেশভাগের পর থেকেই দিল্লির বাসিন্দা। দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রার পর আজও তিনি দিল্লিতেই বসবাস করছেন। যিনি ‘ইন্দিরা হটাও দেশ বাঁচাও’ স্লোগানের অন্যতম সমর্থক ছিলেন, তাঁর শহরেই দিল্লিতে ‘মোদি হটাও দেশ বাঁচাও’ পোস্টার ছাপানো ও লাগানোর কারণে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সব পোস্টার বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তল্লাশি চলছে আর কোথায় কোথায় এরকম পোস্টার আছে। সবথেকে আশ্চর্য হল, ‘ইন্দিরা হটাও দেশ বাঁচাও’ স্লোগানের সেই জরুরি অবস্থা বিরোধী জয়প্রকাশ আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধার নাম ছিল নরেন্দ্র মোদি।
১৯৮৯ সালের নির্বাচনে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর সঙ্গে কিছুতেই সরাসরি জোটে রাজি নয় বিজেপি। কিন্তু জোট ছাড়া রাজীব গান্ধীকে পরাস্ত করা যাবে কীভাবে? রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের নেতা ভাউরাও দেওরসকে জনতা দলের পক্ষ থেকে বার্তা দেওয়া হয়েছিল যেভাবেই হোক একটা সমঝোতায় আসতে হবে। কারণ, বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক ছাড়া এককভাবে জনতা দলের পক্ষে কংগ্রেসকে হারানো সম্ভব নয়। অবশেষে দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর আসন সমঝোতা এবং যৌথ প্রচারের চুক্তি হয়। সেই যৌথ প্রচারেই কলকাতায় একটি আশ্চর্য দৃশ্য দেখা গিয়েছিল অটলবিহারী বাজপেয়ির সঙ্গে জ্যোতি বসুকে একই মঞ্চে। সেই ১৯৮৯ সালের ভোটের প্রচারের প্রধান ইস্যু কী ছিল? বোফর্স দুর্নীতি। আর সেই ইস্যুকে সামনে রেখে এই বিরোধীদের প্রধানতম স্লোগান ও দেওয়াল লিখন কী ছিল? ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়...রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়। চোর হটাও...দেশ বাঁচাও...।’
২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল কানপুর এয়ারপোর্টে প্রধানমন্ত্রী ডক্টর মনমোহন সিং নেমেছিলেন। তাঁকে বিজেপি কর্মী সমর্থকরা কালো পতাকা দেখায় এবং স্লোগান দেয় ‘প্রধানমন্ত্রী মুর্দাবাদ’! ২০১৪ সালের প্রাক্কালে লাগাতার বিজেপির আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন মনমোহন সিং। তাঁকে বিজেপি নেতৃত্ব প্রকাশ্যেই আখ্যা দিয়েছিলেন, ‘মৌন মনমোহন’।
দলের উপর কর্তৃত্ব। গোটা দেশে তুমুল জনপ্রিয়তা। বিরোধীদের কার্যত গুরুত্বহীন করে দেওয়া। ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যে নরেন্দ্র মোদি প্রায় স্পর্শ করেছেন ইন্দিরা গান্ধীকে। মোদির ভক্তরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে, ‘প্রায় স্পর্শ কেন’? তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। তারা আবেগাপ্লুত হয়ে এই দাবি করলেও, সেই বিবৃতি অতিকথন হবে। ইতিহাসের সঙ্গে সাযুজ্যহীন তো বটেই। কারণ, ইন্দিরা গান্ধীর কোনও রেকর্ডই এখনও পর্যন্ত মোদি ভাঙতে পারেননি। পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এককভাবে ৩৫২ আসন পেয়েছিলেন লোকসভা ভোটে। পরমাণু বিস্ফোরণ পরীক্ষা করেছিলেন প্রথম। সুতরাং কার্যত সব রেকর্ড একাই করে রেখেছেন। আর আসন সংখ্যার বিচারে মোদিকে এককভাবে আগে ইন্দিরা গান্ধীর ৩৫২ এবং তারপর রাজীব গান্ধীর ৪১৪ আসন পাওয়াকে টপকাতে হবে। ২০১৯ সালে এনডিএ জোট পেয়েছে ৩৫১। বিজেপি এককভাবে ৩০৩। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও সন্দেহ নেই মোদি এখনও দেশে জনপ্রিয়তম। দলেও তাঁর বিরোধী কোনও শিবির নেই যারা মাথা তুলতে পারে।
ঠিক এখানেই প্রশ্ন তথা একটি বিস্ময়ের জন্ম হচ্ছে যে, নরেন্দ্র মোদি হঠাৎ এতটা ভীত এবং অসহিষ্ণু হয়ে গেলেন কেন? দিল্লির রাস্তায় ‘মোদি হটাও দেশ বাঁচাও’ লেখা কিছু পোস্টার লাগানো হয়েছে তো কী হয়েছে? এই সামান্য পোস্টারে মোদির জনপ্রিয়তায় কে ভাগ বসাবে? তাহলে তিনি কেন সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না? কেন একটি পোস্টারের কারণে দিল্লি পুলিস এত সক্রিয় হয়ে গেল! ভারতের রাজনীতিতে এই স্লোগানটি তো সবথেকে পরিচিত এবং বহু ব্যবহৃত। সব বিরোধী দলই কোনও না কোনও সময় এই স্লোগান দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। তাহলে এত ক্রুদ্ধ এবং অসহিষ্ণু হওয়ার কারণ কী? বিজেপির দিল্লি শাখাই পাল্টা কোনও স্লোগান কিংবা পোস্টার দিয়ে আম আদমি পার্টিকে আক্রমণ করতেই পারে! সেটাই স্বাভাবিক। সেসব না করে পোস্টার লাগানোর অপরাধে সরাসরি পুলিস নামানোর সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হল?
বিজেপি সারা বছর ধরে বলে চলে যে, রাহুল গান্ধী গুরুত্বহীন। তাঁকে ‘পাপ্পু’ নামে ব্যঙ্গাত্মক আখ্যা দেওয়া হয়। স্পষ্টই জানানো হয় যে, মোদির সামনে তিনি কোনও নেতাই নন। ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে লন্ডন অথবা ভারতে রাহুল গান্ধীর যে কোনও বক্তব্য নিয়ে এভাবে গোটা বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়ে কেন?
আর এবার তো দেখা যাচ্ছে নজিরবিহীন এক ঘটনা। রাহুল গান্ধী লন্ডন এবং কেমব্রিজে দুটি সেমিনার ও সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের গণতন্ত্র সংক্রান্ত যে বক্তব্য রেখেছেন, তার প্রতিবাদে শুধু সামগ্রিক বিজেপি নয়, গোটা মোদি সরকারই আসরে নেমেছে। প্রতিদিনই একাধিক মন্ত্রী রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে আক্রমণ করছেন। সংসদের বিজেপি শাসক পক্ষ। অথচ তারাই স্লোগানে স্লোগানে সংসদে সরব হচ্ছে রাহুল গান্ধী মাফি মাঙ্গো...রাহুল গান্ধী মাফি মাঙ্গো! সংসদের বাইরে, ভিতরে, বিজেপি পার্টি অফিসে, সাংবাদিক সম্মেলনে, নেতামন্ত্রীদের ভিডিও ও টুইটার বার্তায়, সর্বত্র বিজেপির একটাই ইস্যু। রাহুল গান্ধী। তিনি তো এখন কংগ্রেস সভাপতি নন। সোনিয়াও নন। আর তিনি যদি গুরুত্বহীন হন, তাহলে তাঁকে এত গুরুত্ব কেন দেওয়া হচ্ছে?
নির্বাচনী ময়দানে, সরাসরি মানুষের ভোটে বিরোধীদের রাজ্যে রাজ্যে পরাজিত করার আত্মবিশ্বাস কি তাহলে বিজেপির এখন নেই? এই সন্দেহ হওয়ার কারণ হল, তাহলে বিজেপি কিংবা নরেন্দ্র মোদি সামান্যতম রাজনৈতিক সমালোচনা, আক্রমণ কিংবা বিরোধিতা কেন সহ্যই করতেই পারছেন না! কারণ কী? তিনি যতটা মহাশক্তিমান হিসেবে বিজেপি ব্যাখ্যা করে, সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো এসব ক্ষুদ্র ব্যাপারে তাদের কোনও হেলদোল হওয়ারই কথা নয়! অথচ সমালোচনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। কেন? নরেন্দ্র মোদি কি ভয় পাচ্ছেন? পরাজয়ের? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, তাঁর নিজের ভোটব্যাঙ্ককেও কি তিনি ভরসা করতে পারছেন না?