মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
উত্তরপ্রদেশের পর দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলু হয় পশ্চিমবঙ্গে। এরাজ্যের প্রায় এক কোটি মানুষ আলু চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। চাষিরা আলুর লাভজনক দাম পেলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে জোয়ার আসে। দোকানে, বাজারে ভিড় জমে। চায়ের দোকানে আড্ডা গড়ায় রাত পর্যন্ত। আবার আলুর দাম নেমে গেলে বাজার একেবারে ঝিমিয়ে যায়। এমনকী পুজোর সময়েও কাপড়ের, জুতোর দোকানে মাছি তাড়ানোর অবস্থা হয়।
এরাজ্যে প্রায় এক বছর ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। তার ফলে গ্রামবাংলার অর্থনীতি প্রায় বিপর্যস্ত। এই অবস্থায় চাষিরা আলুর দাম না পেলে সরকারের দুশ্চিন্তা অবশ্যই বাড়ত। কারণ সাধারণ মানুষের আর্থিক সুস্থিতি বিঘ্নিত হলে সরকার বিরোধী আন্দোলন জমাট বাঁধে অত্যন্ত দ্রুত। তখন সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে খ্যাপানো অনেক সহজ হয়ে যায়। সেকথা মাথায় রেখেই বিরোধীরা আলু চাষিদের সরকারের বিরুদ্ধে উস্কে দিতে চাইছে। তারজন্য ব্যক্তিগত কারণে আত্মহত্যার ঘটনাকেও আলুতে লোকসানের জের বলে চালাতে চাইছে। তা করতে গিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড়ের ভাতমৌদি গ্রামে মুখ পুড়েছে বিজেপির।
তবে, চাষিদের আস্থা অর্জনের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এসব কিছুই করতে হয়নি। কারণ তাঁর একের পর এক প্রকল্প বুঝিয়ে দিয়েছে, তিনি আছেন চাষিদের পাশেই। এখন আর শস্যবিমা করার জন্য চাষিদের কোনও টাকা দিতে হয় না। নাম নথিভুক্ত করালেই চাষিদের দায়িত্ব শেষ। বাকি দায় সরকারের। তারপর কোনও কারণে ফসল নষ্ট হলে ক্ষতিপূরণের টাকা ঢুকে যায় সরাসরি চাষিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।
বাম আমলে বছরের পর বছর চাষিরা ধান আর আলুতে লোকসান খেতেন। আলুতে তিন বছর লোকসান খেলে লাভ পেতেন এক বছর। এটাই হয়ে গিয়েছিল প্রথা। প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলে চাষিরা আলুর দাম পেতেন না। তাতে অনেকেরই চাষের প্রতি তৈরি হয়েছিল অনীহা। তাই বহু চাষির কাছেই জমি হয়ে উঠেছিল ‘যম’। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে সেই জমিই চাষির কাছে হয়ে উঠেছে ‘সম্পদ’। কারণ এখন এরাজ্যে কারও এক একর চাষের জমি থাকলেই ‘কৃষকবন্ধু’র সৌজন্যে সরকারের অনুদান বাবদ তিনি প্রতি বছর পেয়ে যাচ্ছেন ১০ হাজার টাকা।
জমি থেকে এমন নিশ্চিত রিটার্নে চাষিদের দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমেছে। এখন সার, বীজ কেনার জন্য আর মহাজনের কাছে চাষিদের হাত পাততে হয় না। চাষের আগেই মহাজনের কাছে বন্ধক পড়ে না তাঁদের ঘাম ঝরানো ফসল। এর ফলে চাষিদের মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। তাঁরা আর কেউ খুব বিপাকে না পড়লে জমি বিক্রি করতে চাইছেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য।
এবার দেখা যাক, সত্যিই কি এরাজ্যের চাষিরা কমদামে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন? বিভিন্ন রাজ্য থেকে পাওয়া তথ্য কিন্তু সেকথা বলছে না। যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা কুইন্টাল দরে। পাশের রাজ্য বিহারে আলুর কুইন্টাল ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কুইন্টাল। নরেন্দ্র মোদির নিজের রাজ্য গুজরাতে আলুর কুইন্টাল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। আর এখানে? উত্তরবঙ্গে দাম কিছুটা কম থাকলেও দক্ষিণবঙ্গে অধিকাংশ চাষিই জ্যোতি আলু বিক্রি করেছেন ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কুইন্টাল। এখন দাম আরও বেশি। অথচ বিরোধীরা বলছেন, বাংলায় চাষিদের অবস্থা নাকি খুবই খারাপ। তাহলে উত্তরপ্রদেশের চাষিদের অবস্থা কি খুবই ভয়ঙ্কর? কারণ সেখানে তো আলুর দাম ৪০০টাকা কুইন্টাল।
দেশের মধ্যে আলুতে সর্বাধিক দাম পাচ্ছেন এরাজ্যের চাষিরাই। তা সত্ত্বেও চাষিরা যে খুব লাভবান হচ্ছেন, এমনটা বলা যাবে না। কারণ সারের দামের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে অগ্নিমূল্য হয়েছে সার। ডিজেলের দামও আকাশছোঁয়া। আগে ডিজেলের দাম বেশি থাকায় চাষিরা কেরোসিন দিয়ে সেচের পাম্প চালাতেন। নরেন্দ্র মোদি সরকারের সৌজন্যে খোলাবাজারে সেই কেরোসিনের দাম এখন ডিজেলের চেয়েও বেশি। ফলে সস্তায় সেচের রাস্তাটাও এখন বন্ধ। এবার আবার পুজোর পর থেকে আলু ওঠা পর্যন্ত বৃষ্টিই হয়নি। তাই সেচেও পড়েছে টান। ফলে মার খেয়েছে আলুর উৎপাদন।
ফলন মার খাওয়ার ছবিটা স্পষ্ট হতেই আলুর দাম বেড়ে গিয়েছে। ফলে হিমঘর খোলার এক সপ্তাহ পর যাঁরা আলু তুলেছেন তাঁরা লোকসানের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছেন। এরাজ্যের চাষিরা রক্ষা পেলেও বিহার, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাতের অবস্থা ভয়ঙ্কর। সেখানে চাষিদের লাভ তো দূরের কথা, সারের খরচটুকুও উঠছে না। তাঁদের ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি হওয়ার জোগাড়। কিন্তু বঙ্গে বিরোধীদের প্রচার দেখে মনে হচ্ছে, দেশের মধ্যে বাংলার আলু চাষিদের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। আর তারজন্য দায়ী সেই ‘নন্দঘোষ’।
অনেকে বলছেন, এখন যে বিপ্লবীরা চাষিদের জন্য কান্নাকাটি করছেন, হিমঘর খোলার পর আলুর দাম বাড়তে থাকলে তাঁরাই সবচেয়ে আগে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামবেন। যাঁরা হাজার টাকা কুইন্টাল দরে আলু কেনার দাবি জানাচ্ছেন, দাম বাড়লে তাঁরাই কালোবাজারির অভিযোগ তুলবেন। টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ করে স্লোগান তুলবেন, আলুর দাম বাড়ল কেন, রাজ্য সরকার জবাব দাও।
বাংলার তুলনায় অন্য রাজ্যে আলুর দাম যে অনেক কম, সেটা বিরোধী দলের নেতারাও জানেন। তাঁরা সব জেনেই রাজ্যের চাষিদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরির চেষ্টা করছেন। কিন্তু কেন?
পঞ্চায়েত ভোট যত এগিয়ে আসছে বিরোধীরা ততই অস্থির হয়ে পড়ছে। কারণ গ্রামবাংলার মানুষকে নিজেদের দিকে টানার মতো কোনও ইস্যু তাদের হাতে নেই। ১০০ দিনের কাজ এক বছরেরও বেশি সময় বন্ধ। ফলে সেই কাজে দুর্নীতি হচ্ছে বা স্বজনপোষণ হচ্ছে, এমন অভিযোগ আর তুলতে পারছে না। আবাস যোজনা নিয়ে শোরগোল ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন জেলায় প্রশাসনিক স্তরে সার্ভের পর ত্রুটি অনেকটাই সংশোধন করা সম্ভব হয়েছে। তাই রাজ্যে টিম পাঠিয়ে তদন্ত করার পর কেন্দ্রীয় সরকার আবাস যোজনায় ক্লিন চিট দিয়েছে।
ফলে শাসক দলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্র বলতে সেই নিয়োগ দুর্নীতি। তার প্রভাব শহরে ও শিক্ষিত পরিবারের মধ্যে থাকলেও সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের তেমন হেলদোল নেই। এমনকী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর বাড়ি থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধারের পর মানুষের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তা অনেকটাই স্তিমিত। তাই পঞ্চায়েত ভোটে পায়ের তলায় মাটি জোগাড়ের আশায় চাষিদের টার্গেট করেছে বিরোধীরা। তাঁদের কাছে পেতে গোপন করে যাচ্ছে প্রকৃত সত্য।
চাষিদের সমর্থন ছাড়া বাংলার ক্ষমতা দখল যে অসম্ভব, সেটা দিল্লির বিজেপি নেতারাও জানেন। তারজন্যই একুশে বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি নেতারা দিল্লি থেকে উড়ে এসে চাষি পরিবারে মধ্যাহ্নভোজ সেরেছিলেন। চাষিদের কাছে টানতে ভোটের আগে শুরু হয়েছিল নতুন গিমিক, ‘মুষ্ঠি ভিক্ষা’। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার গ্রামে গিয়ে গ্রহণ করেছিলেন সেই ‘মুষ্ঠি ভিক্ষা’। চাষিরা মুষ্ঠি ভিক্ষার নামে চাল, আলু, কলা, মুলো দিলেও ভোটটি বিজেপিকে দেয়নি। কারণ ‘নাটক’ আর ‘আন্তরিকতা’র ফারাকটা বাংলা বোঝে। তাই পঞ্চায়েত ভোটের মুখে বিরোধীরা যতই চোখের জল ফেলুক না কেন, চাষিরা জানেন এ হল ‘কুমিরের কান্না’।