মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
মার্চ ১০, ১৯৫৯। হঠাৎই চীনা নর্তকীদের এক নাচের আসরে আমন্ত্রণ পেলেন দলাই লামা। নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছেন চীনের জেনারেল ঝাং চেনুয়া স্বয়ং। সঙ্গে শর্ত, দলাই লামাকে আসতে হবে একা! একা কেন? চীনা জেনারেলের আপ্যায়নের বহরে সন্দেহের উদ্রেক হল তিব্বতি সেনা অফিসারদের। চীনাদের কোনও বদ মতলব নেই তো! নিরস্ত্র দলাইকে বাগে পেয়ে গুম করে দিতে পারলেই লাল-ফৌজের পথের কাঁটা দূর হয়। ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে তড়িঘড়ি তাঁকে লাসা থেকে সরানোর গোপন প্রস্তুতি শুরু করল তিব্বতি সামরিক বাহিনী। কারণ, একমুহূর্ত সময় নষ্ট হলে তাঁর জীবন বিপন্ন হতে পারে। দলাই যে তাদের নয়নের মণি!
মধ্যরাতের অভিযান
মার্চ ১৭, ১৯৫৯। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা আর ছুরি-বেঁধানো বরফঝড়ে ধুয়ে যাচ্ছে তিব্বত। ম্লান একফালি চাঁদের নিভু নিভু ভৌতিক আলোয় রহস্যময় গোটা চরাচর। রাত বারোটার পর সপারিষদ লাসার রাজপ্রাসাদ ছাড়লেন দলাই লামা। গায়ে ‘কাশিয়া’র (বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মেরুন/লাল রঙের গা ঢাকা জোব্বা) বদলে সম্পূর্ণ সামরিক পোশাক। সেই ছদ্মবেশে দলাইকে তাঁর মাও প্রথমে চিনতে পারেননি। এরপর শুরু হল পথ চলা। বিভিন্ন সীমান্তবর্তী গ্রামে লুকিয়ে কেবল রাতের বেলা পদব্রজে বিস্তীর্ণ বিপদসঙ্কুল তুষারাচ্ছাদিত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তাঁরা পৌঁছলেন তিব্বত সীমান্তের শেষ গ্রাম ‘শুনা’য়। দলাইয়ের সঙ্গে তখন তাঁর মা, ১২ বছরের ভাই, বোন, চারজন মন্ত্রী, কয়েকজন দেহরক্ষী এবং ঘরকন্নার কাজের লোক।
২৭ মার্চ। তাওয়াংয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট পলিটিক্যাল অফিসার টি এস মূর্তির কাছে খবর এল, ‘ম্যাকমোহন লাইন’ টপকে ‘চুথাংমু’ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে চলেছেন দলাই। ২৯ মার্চ। ‘চুথাংমু’ পৌঁছলেন দলাইয়ের দূত। সরকারি আধিকারিকদের হাতে তুলে দিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে লেখা ভারতে আপৎকালীন আশ্রয়প্রার্থী দলাই লামার স্বাক্ষরিত চিঠিটি। সঙ্গে সঙ্গে ওয়ারলেস মারফৎ তা পাঠানো হল দিল্লিতে। মার্চ ৩১। দলাইকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ভারতে বরণ করে নিতে চুথাংমু পৌঁছলেন মিস্টার মূর্তি। উপরমহল থেকে সেরকমই নির্দেশ এসেছিল।
অরুণাচলে দলাই
কথা ছিল, তিব্বতের শেষ সীমান্ত চৌকি ‘খেনজিমানে’ পেরিয়ে বেলা দুটো নাগাদ ভারতের ‘চুথাংমু’তে প্রবেশ করবেন দলাই। যথাসময়েই সেখানে উপস্থিত হলেন তিনি। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পূর্বাহ্নেই সেখানে হাজির চীনা ভাষায় দক্ষ মূর্তি। ২ এপ্রিল। জিমিনথাংয়ের বৌদ্ধ স্তূপ ‘গোরসাম চোর্তেন’-এ পৌঁছলেন দলাই। মিস্টার মূর্তির কাছে উদ্বিগ্ন গলায় বারবার জানতে চাইছেন, বহির্বিশ্ব, বিশেষত ইংল্যান্ড-আমেরিকা তাঁকে নিয়ে কী বলছে বা ভাবছে!
৩ এপ্রিল। ‘নামজিয়াং চু’ নদী পেরিয়ে দলাই সদলে পৌঁছলেন তাওয়াং। তাঁকে আপ্যায়ন করে এগিয়ে নিয়ে চললেন ‘কামেং ফ্রন্টিয়ার ডিভিশন’-এর পলিটিক্যাল অফিসার হরমন্দার সিং এবং লাসায় ভারতের তদানীন্তন রাষ্ট্রদূত পি এন মেনন। ৪ এপ্রিল। ‘লুমলার’ স্থানীয় ‘মনপা’দের সঙ্গে মিলিত হলেন দলাই। পলিটিক্যাল অফিসার, হরমন্দার সিংকে একান্তে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘খামপাস’ আর তিব্বতের স্বায়ত্তশাসনে জীবন বাজি রাখা বীর যোদ্ধাদের ভারত কোনওরকম সাহায্য করতে পারে কি না! ইতিমধ্যে ২০০০ সেনার মৃত্যু হয়েছে তিব্বতে। উত্তরে হরমন্দার সিং জানালেন, ভারত সাহায্যে প্রস্তুত।
শরীর বিদ্রোহ করায় দলাই তাওয়াং-এ কয়েকদিন কাটিয়ে ‘বমডিলায়’ যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। সরকারি তরফে সব ব্যবস্থাই পাকা হল। ৫ এপ্রিল, ১৯৫৯। সন্ধ্যাবেলায় ভারতের বৃহত্তম তাওয়াং বৌদ্ধমঠে দলাইয়ের বিরাট সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা ও ‘মনপা’রা। অসম রাইফেলসের তরফেও সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। এদিকে দলাইকে কব্জা করতে না পেরে আহত শার্দূলের মত ফুঁসছে চীন। ভারতের সঙ্গে বৈরিতাও বাড়ছে। ১৯৬২তে দলাই লামাকে আশ্রয় দেওয়ার বদলা নিতে শেষমেশ ‘নুরানাং’-এর যুদ্ধেই ঝাঁপিয়ে পড়ল বেজিং।
সেলা-নুরা, নুরানাং যুদ্ধ
১৭ নভেম্বর, ১৯৬২। শুরু হল ‘নুরানাং’ যুদ্ধ। ভয়ানক প্রতিশোধ স্পৃহায় সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল চীন। ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’র অতর্কিত হামলার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না ভারতীয় সেনাবাহিনী। চৈনিক আগ্রাসনে পিছু হটতে শুরু করল তারা। বড় ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ভারতীয় সেনাদের পশ্চাদপসরণের নির্দেশও দেওয়া হল। সেই সময় চতুর্থ গাড়োয়াল রাইফেলসের অকুতোভয় রাইফেলম্যান ‘যশবন্ত সিং গোরলা রাওয়াত’ চীনা সেনাদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন। চীনারা লড়ছে ‘মিডিয়াম মেশিন গান’ নিয়ে। যশবন্ত দেখলেন, বারো-চোদ্দ গজ দূরে এক চীনা সেনা খানিকটা অরক্ষিত অবস্থায় নাগাড়ে এমএমজি থেকে গুলিবর্ষণ করে নির্বিচারে ভারতীয় সেনাদের যমালয়ে পাঠাচ্ছে।
যশবন্ত এমন ভান করলেন, তিনি যেন সাংঘাতিক জখম-নিরস্ত্র-অসহায়; স্বেচ্ছায় ধরা দিতে চান। তাঁর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে ল্যান্সনায়েক ত্রিলোকী সিং এবং রাইফেলম্যান গোপাল সিংও আহত হওয়ার ভান করে বরফের ওপর নিঃসাড়ে পড়ে রইলেন। চীনা সেনাদের তাঁবুর কাছে খোঁড়াতে খোঁড়াতে পৌঁছে অতর্কিতে গ্রেনেড ছুড়লেন যশবন্ত। গোটা তাঁবু গ্রেনেডে উড়ে গেল। বেশ কিছু চীনা সৈন্য তৎক্ষণাৎ মারা পড়ল। হামাগুড়ি দিয়ে যশবন্ত এমএমজিটি বাগিয়ে ফিরে এলেন ভারতীয় বাঙ্কারে। তারপর পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ বাদেই চীনা সেনারা যশবন্তের চালাকি ধরে ফেলে। তখন তারা ব্যাপক গোলা-গুলিবর্ষণ শুরু করল। ত্রিলোকী এবং গোপাল অচিরেই বীরগতিপ্রাপ্ত হলেন। একা কুম্ভ যশবন্ত মেতে উঠলেন চীনা সেনাদের সঙ্গে অসম লড়াইয়ে! রাতের অন্ধকারে এক বাঙ্কার থেকে আর এক বাঙ্কারে দৌড়ে, লাফিয়ে, স্থানবদল করে ধরাশায়ী করলেন শত্রুদের।
দুই ‘মনপা’ রমণী, সেলা এবং নুরা আশপাশ থেকে কুড়িয়ে আনা মৃত সেনানীদের অস্ত্র জুগিয়ে যাচ্ছেন যশবন্তকে। জোগাচ্ছেন খাবারও। যশবন্তের সমর কৌশলে ধোঁকা খেয়ে চীনা সেনারা ভাবল, নিশ্চয়ই বড়সড় এক সাঁজোয়া বাহিনীকে সমরাঙ্গনে হাজির করে ফেলেছে ভারত। তাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার সুযোগে একাই ৩০০ শত্রু সেনাকে কোতল করলেন যশবন্ত। তিনরাত-তিনদিন বা ৭২ ঘণ্টা নাগাড়ে চলল তাঁর এবং সেলা-নুরার এই অবিস্মরণীয় রক্তক্ষয়ী ‘নুরানাং’ যুদ্ধ। সাংঘাতিক জখম, অবসন্ন যশবন্ত এরপর নাকি চীনা সেনাদের হাতে ধরা পড়ে যান। চীনা সেনারা তাঁর মুণ্ডচ্ছেদ করে। সেলা পাহাড় চূড়া থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মঘাতী হন। চীনা সেনাদের চরম অত্যাচারের শিকার হন নুরা।
সেলার সঙ্গে নাকি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যশবন্তের। এক স্থানীয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় চীনারা জেনে গিয়েছিল, গোপন ডেরায় বসে তাঁর অভূতপূর্ব লড়াইয়ের কৌশল। দুই স্থানীয় রমণীর প্রেমগাথা, যশবন্তের আত্মবলিদান অমর হয়ে আছে সেলা পাস, নুরা ফলস এবং যশবন্তগড়ের ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধে। ছবির মতো ‘সেলা পাস’ অতিক্রমণের পরেই পড়বে ‘নুরানাং বা জাং ফলস’। তারপর ‘যশবন্তগড়’ স্মৃতিসৌধ। সেখানে সযত্নে রক্ষিত বীর সেনানী যশবন্তের ব্যক্তিগত সামগ্রী। রয়েছে ৬২’র যুদ্ধে ব্যবহৃত তাঁর ‘স্টেন মেশিন গান’টিও। ‘নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি’, অধুনা অরুণাচলের বাসিন্দাদের কাছে সাক্ষাৎ ভগবান মরণোত্তর মহাবীরচক্রে ভূষিত যশবন্ত সিং রাওয়াত। তাঁর ব্যবহৃত জুতোজোড়া প্রতিদিন সাফসুতরো করা হয়। যেন তিনি সবে সীমান্ত টহল সেরে ফিরলেন। ভয়ঙ্কর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সীমান্ত পাহারা দেওয়ার সময় কোনও ভারতীয় সেনা ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যশবন্ত নাকি মৃদু চপেটাঘাতে জাগিয়ে তোলেন তাঁকে। অশরীরী যশবন্তের অদৃশ্য উপস্থিতি, তাওয়াংয়ের চীন-ভারত সীমান্তে আজও রাতজাগা ভারতীয় সেনানীদের বল-ভরসা।
৯ ডিসেম্বর ‘ইয়াংসে’
৩,৪৮৮ কিমি ব্যাপী অরুণাচলের ‘এলএসি’ বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বরাবর ভারত-চীন সীমান্তের ২৫টা বিতর্কিত স্পর্শকাতর এলাকার মধ্যে ‘ইয়াংসে’ অন্যতম। ১৯৬২ সালের ৮-৯ ডিসেম্বর গভীর রাতে প্রচণ্ড তুষারঝড়ের মধ্যে আনুমানিক ৩০০ ‘পিএলএ’ সেনা ‘ইয়াংসে’ সীমানা পেরিয়ে ভারতে ঢোকে। ভারতীয় সেনারা লাঠিপেটা করে তাদের তাড়ায়। ১৯৯৯, ২০১৬ এবং ২০২১’এও লালফৌজ ‘ইয়াংসে’তে চুপিসারে সিঁধোবার চেষ্টা করেছিল। চীনাদের উদ্দেশ্য ছিল ‘ইয়াংকি’ সীমান্ত চৌকির দখল। অবস্থানগত সুবিধার কারণে ১৭০০০ ফিট উচ্চতার ‘ইয়াংসে’ থেকে চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে স্পষ্ট দেখা যায়। মাত্র ১০০০ মিটার ব্যবধানে একটি নালা পৃথক করেছে দু’টি দেশের সীমানা চৌকিকে।
২০১৩ সালে শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনা আগ্রাসনের ধার বেড়েছে। ২০১৩-র এপ্রিলে ‘ডেপসাং’, ২০১৪-র অক্টোবরে ‘চুমার’, ২০১৭-র জুলাই-আগস্টে ‘ডোকা লা’ এবং ২০২০-র ‘গলওয়ান’ই তার প্রমাণ। কৌশলগতভাবে ‘ইয়াংসে’র থেকে বহুগুণ গুরুত্বপূর্ণ ‘বুমলা পাস’। ১৯৬২ সালে এই বুমলা পাস টপকেই চীনা সেনারা ভারতে অনুপ্রবেশ করে। তাহলে বুমলা ছেড়ে বারবার কেন ‘ইয়াংসে’তে হুজ্জতি? এখানে রয়েছে ১০৮ জলধারার পবিত্র ‘চুমে গাৎসে’ জলপ্রপাত। বৌদ্ধদের পরম
পূজনীয় ‘পদ্মনানাভন’-এর উপাসনাস্থল ‘চুমে গাৎসের’ পবিত্র জলধারায় স্নান সমাপনে যে কোনও রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলেই বৌদ্ধদের বিশ্বাস। তিব্বতি বৌদ্ধদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হানতেই বারেবারে ‘ইয়াংসে’ আক্রমণ।
সালামি স্লাইসিং
বিভিন্ন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে খুব ছোট ছোট সেনা অভিযান চালানোর মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশের প্রতিরোধের বহর এবং স্নায়ু সহনশীলতা জরিপ করে চীন। সামরিক পরিভাষায় এই রণকৌশলের নাম ‘সালামি স্লাইসিং’। সম্প্রতি নেপালের বেশ কিছুটা জায়গা এই সালামি স্লাইসিং কায়দাতেই দখলের চেষ্টা করে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল বেজিং। তাছাড়াও বিভিন্ন পার্শ্ববর্তী দেশের সীমানায় অনৈতিকভাবে ‘আদর্শ চীনা গ্রাম’ বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জিনপিংয়ের সরকার। ২০২১ সালের ‘চীনা সামরিক আইনে’ সামরিক-অসামরিক মেলবন্ধনে তিব্বতে ৬৪০টি আদর্শ গ্রাম গড়ার পরিকল্পনা সামনে আনা হয়। একটি তিব্বতি সংবাদপত্রের বয়ানে, এরকম একটি আদর্শ গ্রাম ‘জিয়াওকাঙ’। তার এক বাসিন্দাকে চীন সরকার নাকি বছরে ১৩,৮৭১ ইউয়ান ভর্তুকির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এলাহি এই ভর্তুকির বিনিময়ে তাঁকে সর্বক্ষণ বেজিংয়ের হয়ে প্রতিবেশী দেশের উপর গোপনে নজরদারি চালিয়ে যেতে হবে।
চীনের গাত্রদাহ
অরুণাচল প্রদেশকে বরাবরই চীন তার নিজের সম্পত্তি বলে দাবি করে আসছে। অরুণাচলের অধিবাসীদের চীনা বা তিব্বতীয়দের মতো মঙ্গোলীয় ধাঁচের দেখতে। সেজন্যই নাকি অরুণাচলের উপর একচ্ছত্র অধিকার জন্মে যায় চীনের! জাতিসত্তার ভিত্তিতে কোনও দেশের কোনও অংশকে দাবি করা যায় না। এই নিয়ে বারবার মুখ পুড়েছে বেজিংয়ের। তা সত্ত্বেও দখলদারি সম্প্রসারণবাদী মানসিকতায় ভারতের জমি জায়গা দখলের কুঅভ্যাস তারা ছাড়তে পারছে না। অরুণাচলের ১৫টি জায়গার নতুন নামকরণ করে তাকে দক্ষিণ তিব্বত বা ‘জাঙ নান’ বলে অভিহিত করছে চীন। ১৯৫৫-এর বান্দুং কনফারেন্সের ‘পঞ্চশীল তত্ত্বকেও’ বেমালুম অস্বীকার করে অনবরত ‘সালামি স্লাইসিং’এ ভারতের জমি-জায়গা দখলের বেআইনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
নেহরু বা কংগ্রেস কখনওই চীনের আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদী মনোভাবকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা করেনি। যেমন নিন্দা বা প্রতিবাদ করেনি চীনের তিব্বত আগ্রাসনকেও। ভারতের এই নরম মনোভাবে বেপরোয়া চীন শুধু ১৯৬২ নয়, সুযোগ পেলেই সীমান্তে ছোটখাট ঝামেলা বাঁধানোর ফিকির খোঁজে। ২০১৪তে এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় পালাবদলের। ২০২০তে গলওয়ানে ভারতীয় সেনাদের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয় লাল ফৌজ। চীনের অস্বস্তি বাড়িয়ে বাইডেন প্রশাসন সম্প্রতি ইন্দো-মার্কিন সম্পর্কের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশ্যেই ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে। বলেছে, অরুণাচল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছুতোনাতায় চীনের অরুণাচলে সীমান্ত অনুপ্রবেশের চেষ্টা ঘৃণ্য অপরাধ। চীনের ওজর-আপত্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে ১৯৮৩ থেকে সাতবার অরুণাচলে পা রাখেন দলাই লামা। বেশরম বেজিংয়ের তাতেও সম্বিত ফেরে না। সীমান্তে রাস্তাঘাট বা পরিকাঠামোর প্রভূত উন্নতিসাধন ও সমরাস্ত্রের বিপুল সংযোজনে চোখে চোখ রেখে ভারত যেই চীনের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে শুরু করল, সেই মুহূর্তে প্রমাদ গুনল চীন।
তিব্বতযোগ
তিব্বতের ‘পোটালা হাউস’-এর পর মানমর্যাদায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৌদ্ধগুম্ফার অধিষ্ঠান তাওয়াংয়ে। এখানকার বৌদ্ধগুম্ফা তিব্বতিদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। ষষ্ঠ দলাই লামার জন্মস্থান তাওয়াং। পঞ্চম দলাই লামার ইচ্ছানুসারে ১৬৮১তে তাওয়াং বৌদ্ধগুম্ফার প্রতিষ্ঠা করেন মারেক লামা লোড্রে গিয়াৎসো। চীন প্রশাসনের অনুমান, বর্তমান চতুর্দশ দলাই লামা (গালা রিনপোসে বা তেনজিং গিয়াৎসো) তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন করবেন তাওয়াং বৌদ্ধগুম্ফা থেকেই। চীনের বিড়ম্বনা তাতে বাড়বে বই কমবে না! কারণ বর্তমান দলাই লামাই তিব্বতিদের ওপর চীনের দীর্ঘ অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনিকে প্রথম সারা বিশ্বের গোচরে আনেন। ১৯১৪ পর্যন্ত তাওয়াং ছিল তিব্বতের নিয়ন্ত্রণাধীন। ইংরেজ শাসনকালে ‘ম্যাকমোহন লাইন’ মারফৎ ভারতের সীমানা নির্ধারিত হয়। তারপর তিব্বতের হাত থেকে তাওয়াং গুম্ফার পরিচালনার দায়িত্ব আসে দিল্লির হাতে।
তিব্বতের অধিকার বেজিং কোনওদিনই ছাড়েনি। ‘ম্যাকমোহন লাইনের’ অস্তিত্ব পর্যন্ত কখনও মানেনি। তাই অরুণাচলের ৮৩,৭৪৩ বর্গ কিমি এলাকার পুরোটাই চীন তার নিজের সম্পত্তি বলে দাবি করে থাকে। মে, ২০০৭। অরুণাচলের ভূমিপুত্র আইএএস অফিসার ‘গণেশ কায়ু’-কে ভিসা দিতে অস্বীকার করে তারা। বেজিং ও সাংহাইতে ১০৭ জন আইএএস অফিসারের শিক্ষা সফরের কথা ছিল। সেই দলেই ছিলেন গণেশ। বেজিংয়ের হাস্যকর যুক্তি ছিল—অরুণাচল যেহেতু চীনেরই অঙ্গ এবং গণেশ সেখানকার নাগরিক, তাই তাঁর সেদেশে প্রবেশের জন্য কোনও ভিসার প্রয়োজন নেই। একই যুক্তিতে ২০১২-র জানুয়ারিতে যৌথ বিমান মহড়ায় অংশগ্রহণকারী বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন ‘মোহন্ত পানজিং’কে ভিসা দেয়নি চীন। জুন, ২০০৯। চীন ভেটো দিয়ে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ২৯০ কোটি ডলারের ঋণ আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে। কারণ, সেই ঋণের ৬ কোটি ডলার বরাদ্দ ছিল অরুণাচলের পরিকাঠামোগত উন্নয়নে। যদিও নিজের নাক কেটে সে ঋণকে চীন শেষপর্যন্ত আটকাতে পারেনি।
২০০৯ সালে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, ২০১২ সালে তত্কালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি, ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (যদিও সেটি বাতিল হয়) অরুণাচল সফরকে ঘিরে তীব্র অসন্তোষ ব্যক্ত করে বেজিং। সুচতুরভাবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং বাণিজ্য থেকে সীমান্ত সমস্যাকে সযত্নে আলাদা করে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা তুলছে তারা। ভারতীয় রাজনীতিবিদদের চোয়াল শক্ত করে চীনের এই ধাষ্টামো মোকাবিলার সময় এসেছে। নতুবা সেলা-নুরা-যশবন্তের আত্মবলিদান যে বিফলে যাবে!