মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
—হ্যাঁ...হ্যাঁ...হ্যাঁ...।
আপনারা চান বাংলা কিংবা অন্য কোনও অংশ ভারত ইউনিয়নে চলে যাক?
—না...না...না...।
এই প্রদেশে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, সেটা নিয়ে কিছু উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদীরা প্রশাসনকে বিব্রত করার লক্ষ্যে ছাত্রসমাজকে ব্যবহার করছে। এসব বরদাস্ত করা হবে না। ...আমরা আমাদের রাষ্ট্রে বিশ্বাসঘাতক ঘরোয়া শত্রুদের সহ্য করব না।
কিন্তু বোঝা গেল, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে জীবনযাপনের প্রতিটি প্রশাসনিক পদক্ষেপে ঊর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার পণ করেছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। আর তখন থেকেই যা স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল, তা হল, আসলে দেখতে একটিই দেশ। কিন্তু দেশভাগের পর নতুন এই রাষ্ট্রেও আদতে একটি ফল্গুধারার মতোই রয়ে যাচ্ছে ‘টু নেশন থিওরি’! পশ্চিম পাকিস্তান সুয়োরানি। পূর্ব পাকিস্তান দুয়োরানি। সেটা না হলে ভাষার সম্মানের দাবি যারা করছে, তাদের মুখের উপর বলা যায় যে, তারা রাষ্ট্রদ্রোহী?
এখন ১৯৫২। শুধু ঢাকা নয়, পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে হবে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন। রংপুর, মাদারিপুর, পাবনা সর্বত্র রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের শাখাকে ছড়িয়ে দেওয়া হল। বলা হল, যে যেমনভাবে পারবেন সেভাবেই সভা-সমাবেশ করুন। অন্যদিকে, ঢাকায় বিভিন্ন গণসংগঠন একজোট হয়ে একটা কোনও জোরদার প্রভাব সৃষ্টির পরিকল্পনার কথা ভাবতে শুরু করল। সেইমতো ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যুব লীগের কার্যকরী কমিটির বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের কর্মসূচিকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। স্থির হল ২১ ফেব্রুয়ারি সারা বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট পালন করা হবে। এছাড়া ১১ এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি হবে পতাকা দিবস। হঠাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি ফাঁস হল। জানা গেল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমান এবং বরিশালের মহিউদ্দিন আহমেদ মুক্তির দাবিতে অনশন শুরু করেছেন। সংবাদটি যেন বিদ্যুৎ চমকের অভিঘাত তৈরি করল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তো আছেই, এবার রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতেও পাকিস্তান সরকারকে চেপে ধরতে হবে। বাংলার প্রাদেশিক সরকারকে বিশ্বাস করা যায় না। কারণ স্বয়ং পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন এই তো সেদিন ২৭ জানুয়ারি প্রকাশ্যে জিন্না আর লিয়াকৎ আলি খানদের সমর্থন করে বলেছেন, ঊর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। সুতরাং তাঁর কাছে সুবিচারে আশা করা যায় না। এবার লক্ষ্য আন্দোলন।
হঠাৎ করেই কিছুদিন আগে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব হায়দারকে বদলি করা হল। হায়দার সাহেব ছিলেন বয়স্ক মানুষ। শান্ত। স্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া লোক। কিন্তু তাঁকে সরিয়ে দিয়ে আচমকা নিয়ে আসা হল এক কমবয়সি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস এইচ কোরেশিকে। একসময় ফরিদপুরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তিনি। সমস্যা একটাই, ক্রাইসিস সামলাননি বিশেষ। বড়সড় আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা উপস্থিত হলে কীভাবে জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেটা একটা প্রফেশনাল আর্ট। মাথা গরম করা, ইগো দেখানো অফিসারদের নিয়ে এই কাজ হয় না।
এই নয়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সমগ্র ঢাকা শহরে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করলেন। নোটিসে জানালেন, এই ১৪৪ ধারা এক মাসের জন্য বলবৎ করা হচ্ছে। জনগণের একাংশ ঢাকা শহরে জনসভা মিছিল, বিক্ষোভের মাধ্যমে একটা অরাজকতা তৈরির প্ল্যান করছে। তাই আমার মনে হচ্ছে জনসাধারণের জীবনে শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গ হতে পারে। অতএব কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, লালবাগ, রমনা আর তেজগাঁও—এই পাঁচ থানা এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা শহরের সমগ্র এলাকায় আমার লিখিত পূর্ব অনুমতি ছাড়া আজ থেকে আগামী ৩০ দিন সব ধরনের জনসভা, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ সমাবেশ নিষিদ্ধ।
সেদিনই সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা। নবাবপুরে আওয়ামি মুসলিম লিগ দপ্তরে চলছে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির বৈঠক। কিছুতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে নাকি মেনে নেওয়া হবে? কেউ বলছেন, এখন তো আর এই আন্দোলন ছাত্রদের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নেই! গোটা জাতির সর্বস্তরে মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। সুতরাং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে তার পরিণতি যা হবে, সেটা সামাল দেওয়ার মতো সাংগঠনিক শক্তিই তো আমাদের নেই। তাই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে অগ্রসর হওয়াই কাম্য। কিন্তু, বিপরীত অবস্থানও শোনা যাচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য, মুসলিম লিগ সরকার কোনও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে নাকি? এই তো টাঙ্গাইলে উপনির্বাচনে যেই তারা পরাস্ত হল, তারপর থেকে আর কোনও উপ নির্বাচন করে না। হেরে যাওয়ার ভয়ে। এটা কোনও পন্থা? ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আমাদের অন্যায়ের প্রতিরোধ করার দরকার আছে। নাও অর নেভার! অবশেষে তুমুল তর্কবিতর্কের পর ঠিক হল, ভোটাভুটি হোক। ভোটে জয়ী হল শান্তিকামীরা। অর্থাৎ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা উচিত নয় বলে যাঁরা মনে করেন, সেই গোষ্ঠী। কিন্তু অন্য পক্ষ জানিয়েই দিল, ভোটের ফল যাই হোক, আগামী কাল আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করব। দেখা যাক কী হয়!
ঢাকা শহরের ডেপুটি পুলিস কমিশনার সিদ্দিক দেওয়ান বড়সড় বাহিনী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এসে পজিশন নিয়েছেন। তিনি জানতে পেরেছেন, ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও বেরিয়ে আসতে পারে। সেই রকমই পরিকল্পনা। মেইন গেটের সামনে অবশ্য এসপি সাহের আছেন। পি মাহমুদ ইদ্রিশ। মেডিক্যাল কলেজ গেটের সামনেও একটা বাহিনী রাখা হয়েছে। আর সেলিমউল্লা মুসলিম হলের সামনে আর্মস সহ পোস্টিং করা হয়েছে ১১ জন কনস্টেবলকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তখনও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও তার বিরোধিতা করা দুই পক্ষের মধ্যে মতান্তর চলছে। একপ্রস্থ হাতাহাতিও চলল। পরে ঠিক হল, ১০ জন করে গেট থেকে বেরনো হবে। যাতে কোনও বড়সড় অস্থিরতা অথবা অরাজকতার বার্তা না যায়। প্রতীকী প্রতিবাদ বলা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পুলিস-প্রশাসন বলতে পারবে না যে, ছাত্ররা প্ররোচনা দিয়েছে বা আক্রমণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত মনঃপূত হল সকলের।
সবাইকে বলা হল, রুমাল ভিজিয়ে নিতে। কারণ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়বে পুলিস। চোখে ভেজা রুমাল চেপে ধরবে সকলে। তৎক্ষণাৎ স্লোগান উঠল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই... ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে...।’
কোথায় যাওয়া হবে? পরিষদ ভবনের দিকে! অর্থাৎ যাকে আমরা বিধানসভা বলি। সেখানে সভা চলছে। সুতরাং, কিছুতেই ঢুকতে দেওয়া যাবে না। পুলিস প্রস্তুত। গেট থেকে কয়েকটি ব্যাচের ছাত্ররা বেরতেই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হল। তবে ছাড় দেওয়া হল ছাত্রীদের। হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শুরু হুড়োহুড়ি। এবার সকলেই বেরোতে চায়। পুলিস আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। বাধা দিল। ঢিল ছুঁড়ছে ছাত্ররা। কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটাল পুলিস। চরম আতঙ্ক। কোনটা কাঁদানে গ্যাস আর কোনটা গুলি কে বুঝবে? শোনা গেল, মেডিক্যাল কলেজের গেটের দিকে গুলি চলছে।
আব্দুল জব্বারকে ফল কিনতে হবে। মেডিক্যাল কলেজের বাইরে এসেছেন তিনি। বিয়ে করেছেন মাত্র তিন বছর। হঠাৎ শাশুড়ির ক্যান্সার ধরা পড়েছে। সেই কারণেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আসা। এক চেনা ছাত্রের সঙ্গে হস্টেলে থাকছেন তিনি। আজ শাশুড়ির অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। জব্বারের মন ভালো নেই। অন্যমনস্ক হয়ে গেট থেকে বেরিয়ে দেখলেন, সামনে মিছিল। দূরে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে পুলিস। মিছিল থেকে স্লোগান উঠছে বাংলা আমার মাতৃভাষা...বাংলা ভাষার সম্মান চাই...ইত্যাদি। মাথাটা কেমন করে উঠল। মিছিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁদের কথা শুনছেন। ময়মনসিংহের এক গ্রাম থেকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে জব্বার চলে গিয়েছিলেন বার্মায়। ১০ বছর পর আবার ফিরে এসেছিলেন। ন্যাশনাল গার্ডে কাজও নিয়েছেন। তাঁর মনেপ্রাণে বাংলা ভাষার প্রতি এক অদম্য টান। মিছিল দেখতে দেখতে হঠাৎই মাটিতে পড়ে গেলেন জব্বার। গুলি লেগেছে তাঁর। রক্ত ঝরছে অনর্গল। ছুটে এলেন সিরাজুম ইসলাম, হুরমৎ আলিরা। জব্বারকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সময় পাওয়া গেল না। জব্বার আর নেই। তিনি শহিদ হয়েছেন। ভাষার জন্য।
২০ নম্বর ব্যারাকের কামরায় একটা সিগারেট খাচ্ছিলেন শামসুল। হঠাৎ দেখলেন, চলতে চলতেই মাটিতে পড়ে গিয়েছেন আবাই মামু। আবুল বরকত।
কী ব্যাপার? কাঁদানে গ্যাস? চোখে জ্বালা? ততক্ষণে ১৭ নম্বর ব্যারাক থেকে ছুটে এলেন শফিকুর রহমান। তিনি পানি খুঁজছেন। বরকতের মুখে চোখে দেবেন। কিন্তু এ তো রক্ত! অর্থাৎ গুলি। বরকতের বড়সড় শরীর বহন করে মাঠের মাঝখান থেকে দৌঁড়চ্ছেন শামসুল আর শফিকুর। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে এসে বরকতকে দেখে কেঁদে ফেললেন কয়েকজন। তাঁকে সকলেই চেনে। এ কী হল! ঝড়ের বেগে একটি শরীর নিয়ে ঢুকল আরও দু’জন। সেদিকে তাকানো যাচ্ছে না। কারণ, সেই শরীরের মস্তিষ্কের একাংশ নেই। উড়ে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সালাহুদ্দিন।
মৃত্যুমিছিল থামেনি। আবার একটি শরীর আসছে। তাঁর চোখ দু’টি তখনও খোলা। সেই চোখে বিস্ময়। তবে প্রাণ আছে। কী তাঁর পরিচয়? রফিকউদ্দিন আহমেদ। মিছিলে থাকা বহু ছাত্র গুলিবিদ্ধ। হস্টেল লক্ষ্য করেও গুলি চলেছে। গুলিবিদ্ধ বহু ছাত্রকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন ছাত্র ও বন্ধুরা। এঁদের মধ্যে কেউ প্রাণে বেঁচে যাবেন। কেউ বা আবার রফিকউদ্দিনের মতো হাসপাতালেই প্রাণ হারাবেন।
কতজন শহিদ হয়েছিলেন? সত্যিটা হয়তো আজও জানা যায়নি। কারণ বহু লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। নিরুদ্দেশ কতজন, সে সম্পর্কেও সঠিক তথ্য নেই। কোথায় গেলেন তাঁরা? বাংলা নামক ভাষার জন্য এই আহুতি ব্যর্থ হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা ভেবেছিল এভাবেই দমনপীড়ন করে চিরকাল চলবে! বাংলা ভাষা হেরে যাবে।
কিন্তু ১৯৫২ সালের সেই একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে অনেক দূরের এক ভবিষ্যতে শান্ত হয়ে অপেক্ষা করছিল ১৯৭১ সাল। যখন প্রত্যাঘাতের আশ্চর্য আখ্যান রচিত হবে। সে এক অন্য কাহিনী!