মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের তাড়া ছিল। তা সত্ত্বেও অস্ট্রিয়ায় বসে মাত্র ১০ দিনে পরিকল্পিত আত্মজীবনী লেখার সূচনা করেন সুভাষচন্দ্র। সম্পূর্ণ হয়েছিল মাত্র ন’টি পরিচ্ছদ। তা শেষ করার অবকাশ কিংবা সুযোগ, কোনওটাই হয়তো মেলেনি। অখণ্ড ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তথা আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের সেই অসমাপ্ত আত্মজীবনীর নাম ‘অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ বা ‘ভারত পথিক’।
বইটির সূচনা খসড়ায় রয়েছে ১৩টি অধ্যায়। ১৯৩৭ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত লেখা। সুভাষচন্দ্রের বংশের মোট ২৭ প্রজন্মের খোঁজ মেলে সেখানে। জানা যায়, সংস্কৃত মূল শব্দ ‘ভাসু’ কীভাবে কথ্য বাংলায় ‘বোস’ হয়ে উঠল।
বসুদের দক্ষিণ-রাঢ়ী (দক্ষিণ বাংলায়) গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দশরথ বসু। তাঁর দুই পুত্র। প্রথমজন, পরম বসু চলে যান পূর্ববঙ্গে। সেখানেই বসবাস শুরু করেন। অপর পুত্র কৃষ্ণ পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে যাননি। দশরথ বসুর প্র-প্রপৌত্র মুক্তি বসু চলে এসেছিলেন মাহীনগর গ্রামে। সেখানেই তাঁরা বিখ্যাত হয়ে ওঠেন বসু পরিবার নামে। কলকাতা থেকে ১৪ মাইল দক্ষিণে ছিল এই মাহীনগর। কায়স্থ সমাজের মহাসম্মেলনের কারণে অঞ্চলটি প্রায় তীর্থস্থানের মর্যাদা পেয়েছিল।
সেই সময় বাংলায় চলছে সুলতানি শাসন। আদি গঙ্গার উত্তাল স্রোত বয়ে যেত এই অঞ্চল দিয়ে। এই পথেই ভক্তিতরঙ্গের ধারা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব। ইতিহাসের গর্ভে তখন রচিত হচ্ছিল আর এক মহামানবের পূর্বপুরুষদের উদ্ভাস পর্ব। কেই বা সেদিন জানত, ভবিষ্যতে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সহ অখণ্ড ভারতবর্ষে দেশপ্রেমের বাঁধভাঙা তরঙ্গে তিনি কাঁপিয়ে দেবেন ২০০ বছরের গোলামির ভিত!
নেতাজির পূর্বপুরুষদের বাসস্থানের অদূরে প্রবাহিত হতো গঙ্গা। লৌকিক রীতি মেনে তখনকার গঙ্গাগর্ভের পুকুরগুলিকে আজও গঙ্গা বলা হয়। যেমন—বোসের গঙ্গা, করের গঙ্গা ইত্যাদি। কবি কৃষ্ণরামের ‘রায়মঙ্গল’ গ্রন্থে ফিরে পাওয়া যায় সেই অতীতকে—
‘সাধুঘাটা পাছে করি সূর্যপুর বাহে তরী
চাপাইলা বারুইপুরে আসি।
বিশেষ মহিমা বুঝি বিশালাক্ষী দেবী পূজি
বাহে তরী সাধু গুণরাশি।।
মালঞ্চ রহিল দূর, বাহিয়া কল্যাণপুর
কল্যাণ-মাধব প্রণমিল।
বাহিলেক যত গ্রাম, কি কাজ করিয়া নাম
বড়দহ ঘাটে উত্তরিল।।’
(রায়মঙ্গল। ৪৯।)
গঙ্গার স্রোত রুদ্ধ হওয়ার পর ওই অঞ্চলে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে মহামারী জ্বর (অনুমান করা যায় আজকের ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি)। কেউ কেউ গ্রাম, বাড়ি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান। নেতাজির পূর্বপুরুষ নগেন্দ্রনাথ বসুর বর্ণনায় জানা যায়—‘মাহীনগরের উপকণ্ঠ কোদালিয়া ও তৎনিকটস্থা চিংড়িপোতা, রাজপুর, হরিনাভি, লাঙ্গল রেড়ে প্রভৃতি স্থানে বিদ্যাবাচস্পতি প্রভৃতি প্রাতঃস্মরণীয় পণ্ডিত বংশধরগণের স্মৃতি আজও উজ্জ্বল রহিয়াছে। ওই সকল স্থানে শত শত খ্যাতনামা পণ্ডিত জন্মগ্রহণ করিয়া গিয়াছেন; ওই সকল পণ্ডিতগণের সমাগমে দাক্ষিণাত্য বৈদিক সমাজে কোদালিয়া কাশীপুরি সদৃশ বলিয়া কীর্তিত হইয়াছিল। এ সম্বন্ধে এইরূপ একটি শ্লোক শুনা যায়—
কোদালিয়া পুরী কাশী গোঘাটা মণিকর্ণিকা।
তর্ক পঞ্চাননো ব্যাসো রামনারায়ণঃ স্বয়ং।।
বলিতে কি, যে বিদ্যাবাচস্পতির বংশে রামনারায়ণ তর্ক পঞ্চানন জন্মগ্রহণ করেন, সেই বংশেই সোমপ্রকাশ সম্পাদক দ্বারিকানাথ বিদ্যাভূষণ জন্মলাভ করিয়াছিলেন।’
কোদালিয়া নামের নেপথ্যে আছে জনশ্রুতি। পুকুর খননের পর প্রচুর পরিমাণ কোদাল এই জায়গায় জড়ো করে রাখা হতো। নেতাজি সুভাষচন্দ্র অবশ্য পূর্বপুরুষের গ্রাম কোদালিয়া প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক, ব্রাহ্মসমাজের প্রবক্তা পণ্ডিত আনন্দ বেদান্তবাগীশ, পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী, ভারতচন্দ্র শিরোমণি, বিখ্যাত চিত্রকর কালীকুমার চক্রবর্তী, সঙ্গীতজ্ঞ অঘোর চক্রবর্তী, কালীপ্রসন্ন বসু এই অঞ্চলে সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থানের নেপথ্যে। পাশাপাশি কয়েকটি দশক ধরে এই অঞ্চল জাতীয় আন্দোলনেও বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করে। হরিকুমার চক্রবর্তী ও সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের (যিনি ১৯৩৬ সালে দেউলি বন্দিশিবিরে প্রাণত্যাগ করেন) মতো প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা এবং কমরেড এম.এন রায়ের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পুরুষ এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ফিরে যাই, নেতাজির পূর্বপুরুষদের নানা কীর্তিগাথায়। দশরথ বসুর একাদশতম বংশধর মহীপতি। তিনি ছিলেন অসাধারণ বুদ্ধিমান। যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়ায় তদানীন্তন বাংলার শাসক অর্থ ও যুদ্ধমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে নিযুক্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ‘সুবুদ্ধি খাঁ’ উপাধিতেও মহীপতিকে ভূষিত করেন মুসলিম ধর্মাবলম্বী সুলতান। সেই সময়কার প্রথা অনুযায়ী ভূ-সম্পত্তি বা জায়গির প্রদান করা হতো। সুবুদ্ধিপুর গ্রাম আজও সেই স্মৃতি বহন করছে বলে মনে করা হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, বাংলার মুসলিম শাসকরা তাঁদের উপাধিতে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতেন। কিন্তু, খাঁ অবশ্য খাঁটি মুসলিম উপাধি।
মহীপতির চতুর্থ পুত্র ইশান খাঁ। তিনিও রাজসভায় পিতার সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখেন। ঈশান খাঁয়ের তিন পুত্রই রাজ উপাধি লাভ করেছিলেন। দ্বিতীয় পুত্র গোপীনাথ বসু তথা পুরন্দর খাঁ তৎকালীন সুলতান হুসেন শাহ কর্তৃক অর্থমন্ত্রী ও নৌ সেনাপতি নিযুক্ত হন। তাঁর নামেই মাহীনগরের কাছের পুরন্দরপুর গ্রাম। ওই অঞ্চলটি জায়গির হিসেবে পেয়েছিলেন। তাঁর বাগানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মালঞ্চ গ্রাম।
সমাজ সংস্কারক হিসাবে পুরন্দর খাঁয়ের খ্যাতি ছিল। বল্লাল সেনের আমল থেকে চলে আসা কুলীন-মৌলিক দূরত্ব ঘোচাতে সক্রিয় হন। অসবর্ণ বিবাহ সংস্কারের জন্য এক লক্ষ কায়স্থের সমাবেশ ঘটান তিনি। উপস্থিত অভ্যাগতদের কাছে বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের জন্য এক মাইল দীর্ঘ একটি দিঘি খনন করেছিলেন। তারই অবশেষ অংশ এখন ‘খানপুকুর’ নামে পরিচিত। পুরন্দর খাঁ পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। বৈষ্ণবদের ভক্তিমূলক পদাবলীর রচয়িতাদের মধ্যে তাঁকে গণ্য করা হয়।
সুভাষচন্দ্রের পিতামহ ছিলেন হরনাথ বসু। তাঁর চার পুত্র। যদুনাথ চাকরি করতেন ইম্পিরিয়াল সেক্রেটারিয়েটে। অধিকাংশ সময়ই থাকতেন সিমলায়। কেদারনাথ কলকাতার বাসিন্দা হন। দেরবেন্দ্রনাথ সরকারি শিক্ষাদপ্তরে অধ্যক্ষের পদে উন্নীত হন। এবং জানকীনাথ শেষ জীবনে চলে আসেন কলকাতায়। তাঁরই পুত্র সুভাষচন্দ্র। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে শাক্ত মতাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও হরনাথ ছিলেন ধার্মিক ও একনিষ্ঠ অহিংস স্বভাব বৈষ্ণব। বাড়িতে দুর্গাপুজোয় পাঁঠাবলি পর্যন্ত বন্ধ করেছিলেন।
নেতাজির বাবা জানকীনাথ বসু ১৮১০ সালের ২৮ মে কোদালিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে ছিলেন জয়নগর বিদ্যালয়ে শিক্ষক। সেখান থেকে একদা কটক মিউনিসিপ্যালিটির প্রথম নির্বাচিত বেসরকারি চেয়ারম্যান, গর্ভমেন্ট প্লিডার, পাবলিক প্রসিকিউটর, রাষ্ট্রীয় আইনসভার সদস্য, এমনকী রায়বাহাদুর উপাধিও পান। তা সত্ত্বেও নানা সমাজসেবা মূলক সংখ্যার পাশাপাশি জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন তিনি। ১৯১৭ সালে জেলাশাসকের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে শেষ দু’টি পদে ইস্তফা দেন। ব্রিটিশদের দমন নীতির বাড়াবাড়ি শুরু হলে ১৯৩০-এ রায়বাহাদুর খেতাব পর্যন্ত বর্জন করেন।
নেতাজির মা প্রভাবতী দেবী ছিলেন তিনি হাটখোলা দত্ত পরিবারের কন্যা। জানকীনাথের থেকে নয় বছরের ছোট। দু’জনেই ছিলেন ধার্মিক এবং দানশীল। ১৯১২ সালে শ্যামনাথ ভট্টাচার্যের কাছে শাক্ত মন্ত্রে দীক্ষিত হন। কোদালিয়াতে তিনি উন্মত্ত ঠাকুর বলে পরিচিত ছিলেন। গুরুর মৃত্যুর পর অনুকূলচন্দ্রের কাছে দীক্ষা নেন জানকীনাথ ও প্রভাবতী দেবী। কোদালিয়ার সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। জানকীনাথ তাঁর মা ও বাবার নামে যথাক্রমে কামিনী দাতব্য চিকিৎসালয় ও হরনাথ লাইব্রেরি স্থাপন করেন। পরিচারক ও পোষ্যদের জন্য অবসর ভাতারও ব্যবস্থা করে যান। ১৯৩৪ সালে কটক আদালতে সওয়াল করতে করতে হঠাৎ অচৈতন্য হয়ে পড়েন তিনি। তারপর থেকে কলকাতার বাড়িতে পুত্র ডাঃ সুনীল চন্দ্রের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। আর সুস্থ হননি। ওই বছরই ২ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান জানকীনাথ। তাঁর সুভাষ তখন ইউরোপ থেকে করাচি বিমানবন্দরের পথে।
১৯৪৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্দামানে অখণ্ড ভারতের প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিলেন আজাদ হিন্দের সর্বাধিনায়ক। ঠিক তার আগের রাতে নিরুদ্দেশের পথিক ছেলে সুভাষের বিচ্ছেদের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে অন্য লোকে পাড়ি জমিয়েছেন তাঁর শয্যাশায়ী মা। কলকাতার সেই এলগিন রোডের বাড়িতেই।
পূর্বপুরুষদের সমস্ত গুণাবলী একসঙ্গে প্রকট হয়েছিল একমাত্র সুভাষচন্দ্রের মধ্যেই। জাতির জন্য পরাধীনতার গ্লানি মোচনের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। তাই ইতিহাসের পাতায় তিনি চিরকালের, চিরদিনের নেতাজি। ধর্মে, কর্মে, ত্যাগে, সাহসে, সেবায়, শিক্ষায় এবং মনীষাদীপ্ত প্রজ্ঞায় এক এবং অদ্বিতীয়।
ছবি সৌজন্য: লেখক