মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
দশ বছর আগে...২০১৩
এটা হল অগস্ত্যমুনি। বাঁদিকে মন্দাকিনীর জল ফুঁসছে। আর ডানদিকে প্রতি ১৫ থেকে ৩০ মিনিট পর পর অনেকটা উপরে থাকা আপাতত ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রধান রাস্তার পাশের বোল্ডার খসে খসে পড়ছে। মাঝখানের এই সরু মেকশিফট পথ পেরিয়ে আচমকা একটা ১৫০ মিটারের চড়াইয়ে উঠতে হবে। অতএব এই গোটা কাজটি করতে হবে মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই। কারণ, যে কোনও সময় আবার বোল্ডার পড়বে। গাড়ির উপরে। গাড়িচালক প্রকাশ সিং বললেন, ‘আপনি নেমে যান। আমি গাড়িটা নিয়ে যাচ্ছি।’ কিন্তু সেটা মেনে নেওয়া যায় কীভাবে? হরিদ্বার থেকে যেখানে কোনও গাড়ি আসতে চায়নি, তখন একমাত্র এই প্রকাশ সিং তাঁর পুরনো ইন্ডিকায় চাপিয়ে নিয়ে আসতে রাজি হয়েছিলেন এই বিপদসংকুল ধ্বংসপ্রাপ্ত দেবভূমিতে। সুতরাং, তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে সাক্ষী হওয়া সম্ভব নাকি?
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। প্রকাশকে বলেছিলাম, ‘যা হবে একসঙ্গেই হবে। আপনি চলুন, আমি বসছি।’
স্টার্ট নিতেই দৌড়ে এলেন আর্মি অফিসার কর্নেল পূরণ চাঁদ। ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘এটা কী হচ্ছে? এখান থেকে যাওয়া সম্ভব? সুইসাইড করছেন কেন?’
প্রকাশ সিং বললেন, গুপ্তকাশী যেতেই হবে ওঁকে আজ। কাল মহাভিষেক কেদারনাথে। তাই...। আমিও অনুনয় করলাম কর্নেল সাহেবকে—‘স্যর, বিপর্যয়ের ৮৮ দিন পর কেদারনাথের মহাভিষেক আগামী কাল। আজই উখিমঠ থেকে ডোলি যাবে কেদারে। আমাকে ওটা কভার করতে যেতেই হবে। মিডিয়ার কাজ, বোঝেন তো। কোনওমতে হেলিকপ্টারে একটা জায়গা পেতেই হবে।’
কর্নেল চাঁদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। বললেন, ‘ওই পিছনের বাইপাস দিয়ে গেলেন না কেন? অনেকেই তো গিয়েছে।’ প্রকাশ বললেন, ‘আমরা তো দেরি করে বেরিয়েছি। আর দেবপ্রয়াগে তিন ঘণ্টা আটকে স্যর। বৃষ্টি। ধস। আর রাস্তা বন্ধ ছিল। টায়ার সারালাম রুদ্রপ্রয়াগে। তাই বাইপাসে গেলে অনেক দেরি হবে। আমি পারব।’
কর্নেল সাহেব কাউকে ডাকলেন। হীতেন চোপরা। দু’জনের কথার পর জানা গেল, লোকটি আর্মির ভূবিজ্ঞানী। বললেন, ‘ধরে নিন ২৫ মিনিট আছে আপনার হাতে। পারবেন?’ প্রকাশ বললেন, ‘পারব স্যর।’ কর্নেল বললেন, ‘বেস্ট অব লাক।’
প্রকাশ স্টার্ট করে বললেন, ‘শুনুন, আমি বলব, ধারীমাতা কি...। আপনি বলবেন জয় হো...। এই এখন থেকে শুরু হল। নিন বলুন।’ প্রকাশ চিৎকার করলেন, ‘ধারী মাতা কি...।’ ঠিক ১১ মিনিটে প্রকাশ পথ আর চড়াই অতিক্রম করে উঠে এলেন। আর উপরে রাস্তায় এসে বললেন, ‘দেখলেন! ভাগ্যিস পুজো দিয়েছিলাম আমরা! আপনার যাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।’
কোন পুজোর কথা বলছেন প্রকাশ? কয়েক ঘণ্টা আগেই শ্রীনগর ও রুদ্রপ্রয়াগের মধ্যবর্তী স্থানে আচমকা গাড়ি থামিয়ে প্রকাশ বলেছিলেন, ‘ওই যে মন্দির। ওখানে প্রণাম করে আসুন।’ তাড়া ছিল। তাই প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তু প্রকাশের ধমকে গিয়েছিলাম। ক্রেন দিয়ে আটকে রাখা মন্দির। কারণ, তেহরির পর আর একটি বৃহৎ বাঁধ নির্মাণের কারণে প্রাচীন ধারীমাতার মন্দির সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এই হল ধারীমাতা। অলকানন্দা তটের ধারীমাতা সম্পর্কে উত্তরাখণ্ডবাসীর বিশ্বাস, ধারীমাতা এই দেবভূমিকে ধারণ করে আছেন। যতদিন তিনি তুষ্ট, ততদিন উত্তরাখণ্ড নিশ্চিন্ত। ঘরে ঘরে পূজিতা। সেই ধারীমাতার মন্দিরকে তথাকথিত উন্নয়ন আর পরিকাঠামো নির্মাণের তাড়নায় সরিয়ে ফেলা? এই পাপ সহ্য হবে? এই প্রশ্ন করেছিলেন ধারীমাতা মন্দিরের তৎকালীন পূজারি পুরুষোত্তম মিশ্র। রাগত কণ্ঠে হাতে ফুল দিয়ে বলেছিলেন, ‘দক্ষিণা এক পয়সাও দিতে হবে না। শুধু সংকল্প করে যান যে, পাহাড়ে কোনও অনাচার করবেন না। ধ্বংস করবেন না পাহাড়ের স্বাভাবিকতাকে। প্রচার করতে পারবেন? নাকি বছর বছর শুধু বেড়াতে আসবেন আপনারা? পাহাড়ের কাছে আসেন ব্যক্তিগত আনন্দ ও শান্তির খোঁজে। তারপর সারা বছর আর পাহাড়ের স্বাস্থ্যের খোঁজ রাখেন না। বাঁধের জন্য, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য গ্রামের পর গ্রাম ডুবে যায়, মানুষ ভেসে যায়। মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়। শেষ পর্যন্ত শিক্ষিত মানুষের এতই স্পর্ধা যে ধারীমাতাকে পর্যন্ত উদ্বাস্তু করা হয়? এর ফল ভালো হবে না। মিলিয়ে নেবেন।’
সেই ধারীমাতাকে স্মরণ করে প্রকাশ সিং আমাকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন অনিশ্চিত কেদারনাথ যাত্রায়। ২০১৩ সালের জুন মাসে হয়েছিল কেদারনাথের উপরে এক ভয়ঙ্কর ক্লাউড বার্স্ট। হিমবাহ ফেটে গিয়ে জল এল চারুবাড়ি তালে। সেই জল ভাসিয়ে দিয়েছিল গান্ধী সরোবরকেও। কত ছিল কেদারনাথের তাপমাত্রা সেই ১৬ জুন? ৩১ ডিগ্রি! উত্তরাখণ্ডের বিস্তীর্ণ অংশকে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল জলস্রোত। হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ। কত যে মৃত্যু সেটা আজও প্রায় হিসেবের বাইরে। ভয়াবহতা এমন ছিল যে, চিরচেনা কেদারনাথ মন্দিরের ঠিক পিছন থেকে আসা মন্দাকিনীর ধারা তার গতিই বদলে ফেলেছিল। গৌরীকুণ্ড থেকে কেদারনাথ যাওয়ার যাত্রাপথটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কেদারনাথ মন্দিরের ঠিক পিছনে থাকা এক বিরাট পাথর সেই ভয়ঙ্কর জলস্রোত থেকে রক্ষা করে মন্দিরকে। আর তারপর সেই পাথর হয়েছে আজ নতুন আরাধ্য। এসব তথ্য সকলেই অবগত। কেদারনাথে কী ছিল দৃশ্য সেই বিবরণও পূর্বলিখিত। কিন্তু সেই যাত্রাপথ যেন পূর্বাভাস দিয়েছিল ১০ বছর পরের যোশিমঠ বিপর্যয়ের। ২০১৩ সালের জুন মাসের বিপর্যয়ের সেই ঘটনার ৮৮ দিন পর কেদারনাথে আয়োজিত হয়েছিল পুনরায় মহাভিষেক পুজো। সেখানেই যেতে হবে, এই ছিল সেই সেপ্টেম্বর মাসে আমার লক্ষ্য।
আরও দেরি করছেন প্রকাশ। তাঁর জেদ, যেতে হবে বাসুকেদার গ্রামে। ওই বাসুকেদার মন্দির দর্শন না করা হলে কেদারনাথ দর্শন অসম্পূর্ণ। এই নাকি রীতি! এসব রীতি কে তৈরি করেছে? চন্দ্রপুরীর গণেশ গিলদিয়াল বলেছিলেন, ‘কেন, স্বয়ং মহাদেব? কেদারনাথে যাওয়ার আগে এই বাসুকেদারই তো ছিল তাঁর সর্বশেষ বাসস্থান! মহাদেব যে পথে গিয়েছিলেন, সেই রুট অনুসরণ করতে হবে। না হলে কেদারনাথের আশীর্বাদ পাওয়া যাবে না।’
কিন্তু চন্দ্রপুরী তো যাওয়া যাবে না! যোগাযোগের রাস্তা সম্পূর্ণ উধাও। নদী পেরিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর এই খরস্রোতা নদী কীভাবে পেরনো সম্ভব? নদীর এই প্রান্তে কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখা গেল সার সার তাঁবু। চন্দ্রপুরীর গ্রামবাসীদের। পূর্ণিমা কাঁনোয়ার তাঁবুর বাইরে সারাদিন বসে থাকেন। মন্দাকিনীর দিকে তাকিয়ে। একটা দুটো কালো বস্তু দেখলেই উচাটন হন তিনি। তাঁর দুই ছেলে ভেসে গিয়েছে বিপর্যয়ে। মন্দাকিনীর জলে। পূর্ণিমা দিনরাত ধারীমাতাকে স্মরণ করে বলতেন, মন্দাকিনীকে যেন ধারীমাতা সুমতি দিয়ে বলেন, তাঁর হারানো ছেলে ফিরিয়ে দিতে। দিন যায়। রাত যায়। মন্দাকিনী ফুঁসে ওঠে। আবার শান্ত হয়। কিন্তু ছেলেদের আর ফিরে পাননি পূর্ণিমা। তাঁবু আছে। মা সেখানে যান না। সময় কেটে যায় নদীর দিকে তাকিয়ে। এখন এই ১০ বছর পরও কি পূর্ণিমা কাঁনোয়ার অপেক্ষা করেন? পূর্ণিমা বলেছিলেন, ‘বাসু কেদার আমাকে কি ছেলেদের ফেরত দেবে না?’ তাঁর ক্ষোভ বর্ষিত হয় আত্মঘাতী উন্নয়নের দিকে। বলে চলেন, ‘উঁচুতলার মানুষের জন্য এরকম হল! ওই বাঁধ দিয়ে গঙ্গা, যমুনা, মন্দাকিনী, অলকানন্দকে বেঁধে রাখা, ওই পাহাড় ভেঙে শয়ে শয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি এসবের কী দরকার? আমাদের গ্রামে স্কুল নেই, হাসপাতাল নেই, জল নেই। আমাদের আশেপাশের অনেক গ্রামকে ভূতের গ্রাম বলা হয়। কারণ, কোনও জীবনযাপনের সুবিধা না পেয়ে গোটা গ্রাম ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। সকলে চলে গিয়েছে। একের পর এক শূন্য গ্রাম। শুধু ভূত থাকে। বিজলি,পানি, গ্রামের ছোট সড়ক, ছোট একটা হাসপাতাল এই সামান্য ব্যবস্থাগুলি করতে পারেনি সরকার। অথচ বড় বড় ড্যাম, টানেল, রেলপথ, রাস্তা করে পাহাড়ের জীবনটাই ধ্বংস করে দিচ্ছে। আজ এই বাঁধ না থাকলে ওই মেঘভাঙা জল এভাবে আটকে আটকে যেত না। আমার ছেলেদুটো বেঁচে যেত। আমার ছেলেদের এজীবনে আর পাব না। আমি অভিশাপ দিচ্ছি, এইসব কাজ কোনওদিন শেষ হবে না। রাতে ঘুম হয় না আমাদের, জানেন! সারা বছর ধরে বিস্ফোরণ, পাহাড় ফাটিয়ে দেওয়া হয়। যে পাহাড়ে পাণ্ডবরা থেকেছে, যে ত্রিযুগীনারায়ণে শিব-পার্বতীর বিবাহ হল, সেগুলিতে ডিনামাইট দিয়ে ফাটানো যায়!’ গণেশ গিলদিয়ালের চোখে ছিল তখন বিস্ময়। উত্তরাখণ্ডের গ্রামে গ্রামে গত ১০ বছর ধরে চলে আসছে প্রতিবাদ। নাটক দিয়ে, অনশন দিয়ে। সেই প্রতিবাদ চলে হারিয়ে যাওয়া কবি গির্জার লেখা কবিতা আর গান দিয়ে। কেমন কবিতা আর গান? হাহাকারের।
সারা পানি চুষ রহে হো
নদী সমন্দর লুট রহে হো
গঙ্গা যমুনা কি ছাতি পর
কঙ্কর পাত্থর ফুঁট রহে হো
এক তরফ হো সুখি দুনিয়া
এক তরফ হো তুম
এক তরফ হো পিয়াসি দুনিয়া
এক তরফ হো তুম
লেকিন ডোলেগি যব ধরতী
বোল ব্যাপারি তব কেয়া হোগা?
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়
একইসঙ্গে কেউ বিজ্ঞানে অবিশ্বাসী আবার ঈশ্বরবিশ্বাস অথবা দেবত্বগাথাকেও গ্রাহ্য করেন না! এরকম হয় নাকি? যে কোনও একটি বিশ্বাসে তো আস্থা রাখতে হবে!
কে বলেছে রাখতেই হবে? ভারত নামক রাষ্ট্রের পরিচালকবৃন্দ এসব চেনা ফর্মুলায় আস্থাহীন। তাদের ফর্মুলা হল—নিজের সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী পরিস্থিতিকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসার জন্য যে কোনও মডেল যখন তখন গ্রহণ করা, আবার পরিত্যাগও করা। বহু বছর আগে যোশিমঠ সঙ্কট নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করা একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অমোঘ রিপোর্টকে গ্রাহ্য করেনি ভারত সরকার। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি তথা ভূ-বিজ্ঞানীদের হাতেকলমের ফিল্ড নোট থেকে তুলে আনা পূর্বাভাসকে অস্বীকার করেছে। আবার একইসঙ্গে রাষ্ট্রনায়কেরা ভারতের সনাতন হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে রচিত এক পুরাণগাথাকে অনুসরণ করে সতর্ক হওয়ার পথেও হাঁটেননি। আর তার পরিণামে আজ যোশিমঠ চোখের সামনে ক্রমেই মাটিতে বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে অগ্রসর হয়ে চলেছে।
১৯৭৬ সালে জরুরি অবস্থার সময়ই গঠিত হয়েছিল মিশ্র কমিশন। ১৮ জন বিশেষজ্ঞকে সদস্য করে। তাঁদের উপর দায়িত্ব ছিল যোশিমঠের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি বিজ্ঞানসম্মত রিপোর্ট তৈরি করা। অর্থাৎ শোনা যাচ্ছিল, সেখানে প্রকৃতিগত বদল ঘটছে। এত মানুষের আনাগোনা আর জনবসতি বৃদ্ধির জেরে নাকি যোশিমঠের ভূপ্রকৃতির এই মৃদু পরিবর্তন। মিশ্র কমিশন অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে দীর্ঘ বিশ্লেষণের পর যা জানিয়েছিল, সেটা আজ ২০২৩ সালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এক অলৌকিক ভবিষ্যৎবাণী, যা সত্য হয়েছে। কী বলেছিল মিশ্র কমিশন? বলেছিল, যোশিমঠ পাহাড়ের বা পাথরের উপর নির্মিত কোনও জনপদ নয়। বরং উল্টো। বহুকাল ধরে নিয়মিত পাহাড়ের ধসের ফলে বালি, মাটি, দুর্বল পাথরে তৈরি একটি বিরাট স্তূপ, যার উপর চাপ বাড়তে থাকলে ধীরে ধীরে বসে যাবে মাটিতে। নীচে বহমান ধৌলি গঙ্গা আর অলকানন্দা এই চাপ সহ্য করে যোশিমঠকে ধরে রাখতে পারবে না। যতবার বেশি গাড়ি যাতায়াত করবে, যতবার পাহাড়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সুড়ঙ্গের পর সুড়ঙ্গ তৈরি হবে, ততবার তার অভিঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠবে ভূমি। আর ক্রমেই দুর্বল হবে ধারণক্ষমতা। বসে যেতে থাকবে যোশিমঠ। কিন্তু বিজ্ঞানের এই সতর্কতা কি শুনেছে রাষ্ট্র? শোনেনি।
দ্বিতীয় অগ্রাহ্যের নমুনাটি কী? প্রতিটি শীতে যুগ যুগ ধরে বদ্রীনাথ ধামের শ্রীবিষ্ণুনারায়ণ বদ্রীবিশালকে নামিয়ে আনা হয় যোশিমঠে। ঠিক যেমন কেদারনাথ নেমে আসেন উখিমঠে। নিঝুম, শীতল, একাকী বদ্রীনাথ আর কেদারনাথের পথে তখন ওক আর দেওদারে শুধুই জমে থাকে তুষার। দেবভূমির ব্ল্যাক বাইট, স্পটেড ডাভ, ব্লু ম্যাগপাই অথবা গোল্ডেন বুশ রবিন নামক পাখিগুলি ঠিক কোথায় যায় এই অসীম রহস্যময় তুষারযুগের সময়? তাদের ঠিকানা গোপন থাকলেও বদ্রীনাথ থাকেন তাঁর শীতকালীন সিংহাসনে। যোশিমঠের নৃসিংহ মন্দিরে। শীতকালে ভক্তদের পঞ্চবদ্রী যাত্রায় দর্শন দেওয়ার জন্য। এই নৃসিংহ মন্দির কে স্থাপন করলেন? অন্যতম প্রধান বিশ্বাস হল আদি শঙ্করাচার্য। বিষ্ণু অবতার হিসেবে নৃসিংহদেবকে স্থাপন করে একটি রহস্য রেখে যান। কী সেই রহস্য? কেদার খণ্ড সংহিতা অনুযায়ী, নৃসিংহ অবতারের বাঁ হাত সেই স্থাপনার পর থেকেই প্রতিদিন একটু একটু করে সরু হয়ে যাচ্ছে। দুই হাতের গঠনের তারতম্য থাকছে। আর একদিন এমন এক সময় আসবে যেদিন ওই হাত সরু হতে হতে বিলীন হয়ে যাবে বাতাসে। অর্থাৎ আর দৃশ্যমান থাকবে না। ঠিক তখন জয় আর বিজয় পর্বতও মিলিত বা সংযুক্ত হয়ে যাবে। তারা আর পৃথক অস্তিত্ব থাকবে না। এর পরিণতি কী হবে? আজকের বদ্রীনাথ ধামের সঙ্গে বাকি পৃথিবীর সংযোগ সূত্রটি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর যাওয়া যাবে না সেখানে। তাহলে উপায়? আগে থেকে, সেই অষ্টম শতকেই তপোবন পেরিয়ে নির্মিত হয়ে রয়েছে ভবিষ্যতের বদ্রীধাম। বিশাল বদ্রী। সেখানেই যেতে হবে পুণ্যার্থীদের বদ্রীদর্শনে। সেই বিশালবদ্রী মন্দিরে লিপিবদ্ধ আছে কিছু বাক্য। কিন্তু কী লেখা আছে? কোন ভাষায়? নিশ্চিতভাবে আজও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি!
বদ্রীনাথ যাওয়ার প্রবেশদ্বার কী? যোশিমঠ! নৃসিংহদেবের হাত কি সরু হচ্ছে আরও? যোশিমঠবাসীদের বিশ্বাস, হ্যাঁ, সরু হচ্ছে! তা না হলে আগে যেখানে যোশিমঠ বছরে এক সেন্টিমিটার করে বসে যাচ্ছিল বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করতেন, সেখানে আজ কেন ভারত সরকারের ইসরো তাদের রিপোর্টে বলছে যে, মাত্র ১২ দিনের মধ্যেই সম্প্রতি ৫ সেন্টিমিটার মাটিতে বসে গিয়েছে! তাহলে কি মিশ্র কমিশনের সতর্কতা এবং সংহিতার পূর্বাভাসের মেলবন্ধন ঘটতে চলেছে? বিজ্ঞান ও ধর্ম বিশ্বাসের এই অলৌকিক সমন্বয় কতটা বিস্ময়কর? কিন্তু এসবে কোনও ভ্রূক্ষেপ করা হয়েছে? একেবারেই না।
১৯৯৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর কাছে চাঁদপাড়া থেকে চলে এসেছিলেন তাপস বিশ্বাস। এই যোশিমঠেই। এখানে তাঁর ওষুধের দোকান। নিজেও চিকিৎসা করতে পারেন ছোটখাট অসুস্থতার। অতএব যোশিমঠে বাঙালি বিশ্বাসবাবুর কদর যথেষ্ট। এই তাপস বিশ্বাসের বাড়ি কোথায়? ঠিক যে দু’টি হোটেল সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে ভাঙনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই হোটেল মাউন্টেন ভিউ এবং হোটেল মালারি ইনের ঠিক পিছনেই। এই হোটেল দু’টি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট সংস্থা। কারণ, এই এলাকাটিই সবচেয়ে বেশি বিপদের দোরগোড়ায়। আর ঠিক সেখানেই তাপসবাবুর পরিবারের বসবাস। আশপাশে সব মিলিয়ে ১০টি বাড়ি আছে। তার মধ্যে আটটিই বিপজ্জনক বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তাপসবাবু ও এক প্রতিবেশীর বাড়ি কোনওমতে টিকে আছে। কিন্তু তাঁদের পরিবার রাত কাটাতে পারছেন না নিজেদের বাড়িতে। প্রশাসনের তরফে কঠোরভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, রাতে চলে যেতে হবে নিরাপদ স্থানে। কারণ, কেউ জানে না কখন যে ভেঙে পড়বে বাড়িঘর, জমি, মাটি। অতএব প্রতিদিন রাতে খাওয়া দাওয়া দ্রুত সেরে এই দুই পরিবার নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কখনও অন্য হোটেল অথবা গুরুদ্বারে চলে যান। শুধু রাত কাটাতে। কতদিন এভাবে চলবে? তাপস বিশ্বাস জানালেন, ‘জানি না! ১৯৯৫ সাল থেকে দেখে চলেছি কতটা বিশৃঙ্খলভাবে বাড়ি-ঘর-হোটেল বাড়ছে। যে এলাকায় একসময় ৫০ জন থাকত, আজ দেখি সেখানে ২০০ পরিবার। যত্রতত্র হোটেল। আর পাহাড় ধ্বংস! কতদিন থাকতে পারব আমরা? আজ ঘর ছাড়তে হচ্ছে রোজ রাতে। কাল কি যোশিমঠও আর থাকবে না? চলে যেতে হবে?’
২০১৩ অথবা ২০২১। একের পর এক পূর্বাভাস দিয়েছে দেবভূমি। পরিবেশ মন্ত্রকের গঠন করা কমিটির পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল, হেলং থেকে তপোবন পর্যন্ত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির জন্য টানেল নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত টারবাইন বোরিং মেশিন ১২ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় মাটিতে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। হাইডেল পাওয়ার প্রকল্প, ৯০০ কিলোমিটার চার ধাম রোড, হৃষিকেশ থেকে নয়া রেলপথ...পাহাড়ের বুকে যেন এক ময়দানবের নির্মাণ যজ্ঞ চলছে। আগুনে পুড়ে গিয়েছিল খাণ্ডবঅরণ্য। গড়ে উঠেছিল ইন্দ্রপ্রস্থ! দেবভূমিতে কি আধুনিক যুগের শাসকেরা ইন্দ্রপ্রস্থ গড়ে তোলার নেশায় মত্ত হয়েছেন? আর তারই পরিণতিতে যোশিমঠ বসে যাচ্ছে? কর্ণপ্রয়াগে ফাটল ধরেছে বহু ভবনে। রুদ্রপ্রয়াগে ভেঙে যাচ্ছে রাস্তা ক্রমাগত। দেবভূমি ঘোর সঙ্কটে!
যোশীমঠ পেরিয়ে বদ্রীনাথ। ওই যে ব্যাসগুহা। ওই যে গণেশ গুহা। ওই ওখানে বসে মহাভারত লিখেছেন ব্যাসদেব! ওই যে ওই শিলায় শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় সখা উদ্ধব তপস্যা করেছিলেন। ওই তো পঞ্চশিলা। পঞ্চধারা বেশি দূরে নয়। এই কিংবদন্তি, এই লোককথা, এই ধর্মবিশ্বাস আর এই শান্তিনিবাসের ভবিষ্যৎ কী?
ভারতের পর্যটন, ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পুরাণ, ইতিহাস তো বটেই, দেবভূমির লক্ষ লক্ষ বাসিন্দার জীবনের স্থায়িত্ব নিয়েও কি এই ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণের মহাযজ্ঞের পুরোহিতরা বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন? নির্বিচার অত্যাচারে দেবভূমি কি মহাপ্রস্থানের পথে হারিয়ে যাবে একদিন!