হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
উনিশ শতকের কলকাতার অফিস, কাছারি, স্কুল থেকে বিকেলের বেড়াতে যাওয়া সব কিছুই যেন হঠাৎ করে এক যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে এসে গেল। ‘হঠাৎ’ বলছি, কারণ ইউরোপে যে পরিবর্তন আসতে প্রায় পাঁচশো বছর লেগেছিল, সেটাই আমাদের দেশে ঘটেছিল এক শতাব্দীর মধ্যে। হ্যাঁ, বলছিলাম প্রহর-দণ্ড-পলের হিসেব থেকে ঘড়ির কাঁটা ধরে ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডের অনুশাসনে সাধারণ মানুষের জীবনের তার বাঁধা হয়ে যাওয়ার কথা। উনিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে কলকাতার সমাজ জীবনের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ লিখতে গিয়ে হুতোম তাই ফিরে ফিরে আসেন মেকাবি ক্লাকের টাং টাং আওয়াজ বা গির্জার ঘড়ির গম্ভীর ঢং ঢং ধ্বনির কাছে।
ক্লক টাওয়ার বা ঘড়ি মিনারের প্রচলন ভারতে দেখা যায় ১৮৫৭-র ‘স্বাধীনতার যুদ্ধে’র পর থেকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, এই যুদ্ধ জেতার পর ঘড়ি মিনারগুলি স্থাপিত হতে থাকল এদেশীয়দের সব সময় মনে করাতে যে, তাঁদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের উপর শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ। সেই সূত্রেই নামী বিলিতি ঘড়ি প্রস্তুতকারকদের কাজ সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে হাজির হল ভারতে।
তবে শুধু পাবলিক নয়, প্রাইভেট ওয়াচের উল্লেখও পাচ্ছি হুতোমের নকশায়। তিনি জানাচ্ছেন— ‘ক্রমে পুলিশের হুকুমমত সব গাজন ফিরে গেল। সুপারিন্টেণ্ডেন্ট রাস্তায় ঘোড়ায় চ’ড়ে বেড়াচ্ছিলেন, পকেট-ঘড়ি খুলে দেখলেন, সময় উতরে গেছে, অমনি মার্শাল ল জারি হলো...’
পুরনো কলকাতার আদি ঘড়ি নির্মাতাদের খোঁজে প্রাচীন দলিলপত্র ঘাঁটলে পাওয়া যায় জনৈক মিস্টার গুঠেরির নাম, যার দোকান ছিল রাধাবাজার এলাকায়। ১৭৮০ সালের ২৭ মে তারিখে হিকির বেঙ্গল গেজেটি পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপনে ঘড়ি হারানোর কথা জানিয়ে ফেরত পেলে পুরস্কার ঘোষণা করা হচ্ছে। যোগাযোগের জন্য দেওয়া হয়েছে রাধাবাজারের একটি দোকানের ঠিকানা, যার মালিক ঘড়ি নির্মাতা মিস্টার গুঠেরি। এই ভদ্রলোক ঠিক কোন সালে কলকাতায় আসেন, সেটা জানা না গেলেও বেঙ্গল গেজেটির ১৭৮০ সালের আরও একটি বিজ্ঞাপনে জানা যায় যে, মিস্টার গুঠেরি তাঁর তিন বছরের পুরনো ঠিকানা থেকে নতুন ঠিকানায় উঠে এসেছেন। এর থেকে মনে হয়, এ শহরে অন্তত ১৭৭৭ বা ৭৮ সাল থেকেই তিনি ব্যবসা করতেন। এই ভদ্রলোক নিজের ওয়ার্কশপে কিছু শিক্ষানবিশও নিয়োগ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যেই মিস্টার স্টাইলাস নামে একজন ১৭৮১ সালে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাচ্ছেন যে, মিস্টার গুঠেরির কাছে কাজ শিখে এবার নিজের ব্যবসা খুলছেন লালবাজারে। নতুন ব্যবসায় আরও এগিয়ে যাওয়ার আগেই অবশ্য স্টাইলাসের জীবনে নেমে আসে পূর্ণচ্ছেদ। বৈঠকখানা থেকে বালিগঞ্জ যাওয়ার পথে ঘোড়ার গাড়ির এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান গুঠেরির এই প্রতিভাবান শিষ্য।
১৭৮৭ সালের আশপাশে কাগজের বিজ্ঞাপন থেকে আরও বেশ কয়েকজন ঘড়ি প্রস্তুতকারকের নাম পাওয়া যায়। যেমন— জন শেলভারটন, জন ব্রুস, উইলিয়াম মিলস, আলেকজান্ডার উইলসন প্রমুখ। এঁদের মধ্যে আবার ফ্রান্সিস আগার আদালতের জুরি সদস্য হয়েছিলেন যার থেকে এই পেশার মানুষদের আর্থিক প্রতিপত্তির সঙ্গে সামাজিক সম্মানের আন্দাজ পাওয়া যায়। এই একই সময় খবরের কাগজের পাতায় উঠে আসতে শুরু করে ঘড়ি তৈরির যন্ত্রপাতির বিজ্ঞাপন। এর থেকে বোঝা যায় যে, এই শিল্প ততদিনে বেশ জমে গিয়েছে। নতুন নতুন ওয়ার্কশপ খুলছে আর কাজ শিখতে আসছে নতুন ছেলেরা। তাদের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন মেটাতে বাজারে আসছে নানা ধরনের টুলবক্স। আরও একটা জিনিস খেয়াল করার মতো। ঘড়ির এই বাজার গড়ে উঠছে লালবাজার-রাধাবাজার এলাকা। যে এলাকা আজও বিখ্যাত ঘড়ির বাজার হিসেবে। এই এলাকার আরও একটি চরিত্র তার জনবিন্যাস। এখানে ইউরোপিয়ান ও ইউরেশিয়ান জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বাস করতেন চীনা, আর্মেনীয় এবং এদেশীয় হিন্দু ও মুসলমান মানুষ। এর ফলে এক গোষ্ঠীর মানুষের থেকে কাজের দক্ষতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে অন্য গোষ্ঠীতে। কিন্তু আশ্চর্য লাগে ভাবতে যে, সে আমলে কোনও নামী এদেশীয় হিন্দু বা মুসলমান ঘড়ি প্রস্তুতকারকের নাম পাওয়া যায় না। একেবারেই পাওয়া যায় না যে, সেটাও একদম ঠিক নয়। এই সময় আমরা পাদরি জেমস লঙ সাহেবের লেখায় পাই একটি ঘড়ি চুরির আসামি হিসেবে ব্রজমোহন দত্তের নাম। যদিও তার পেশা বলা হয়েছিল ঘড়ি প্রস্তুতকারক, কিন্তু পারিপার্শ্বিক তথ্য দিয়ে সেই পেশা নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া বেশ মুশকিল।
এদেশীয়দের মধ্যে ঘড়ি তৈরির পেশাদার সহজে খুঁজে না পাওয়ার একটা কারণ হয়তো সামগ্রিকভাবে ঘড়ি ব্যবহার এদেশের মানুষের নাগালে এসে না পৌঁছনো। আমরা কলকাতায় যে সময় গুঠেরি সাহেবের খোঁজ পাই, তার ঠিক দু’দশক আগে দেখি, সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলার মসনদের উত্তরাধিকারী ঘোষিত হওয়ার পর হুগলির ইউরোপীয় বাণিজ্যকেন্দ্রগুলি পরিদর্শন করতে গেলে, সেখানে ভাবী নবাবকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে যে সব মহার্ঘ উপহার দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে একটি ঘড়ি। যার মূল্যমান কোম্পানির খাতায় লেখা হয়েছে ৮০০ টাকা। তারও আগে ১৭০১ সালে উইলিয়াম নরিসের নেতৃত্বে যে ইংরেজ বাণিজ্য দল আলমগির আরঙ্গজেবের সাক্ষাৎ প্রার্থী হয়েছিল, তারাও নজরানার মধ্যে রেখেছিল বিভিন্ন রকম ঘড়ি। এর থেকে ঘড়ি যে অতি মহার্ঘ বস্তু ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আর এই সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকাটাই ছিল ঘড়ির অন্যতম আকর্ষণ।
আঠারো শতকের শেষ দিকে ঘড়ি কেনার পেছনে ক্রেতাদের উদ্দেশ্য একটু খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, সে সময়ের ঢিলেঢালা সামাজিক পরিবেশে সময় মেনে চলার নিয়মানুবর্তিতা খুব একটা চালু ছিল বলে মনে হয় না। অন্তত পুরনো কলকাতার আরেক লিপিকার আইনজীবী উইলিয়াম হিকির ১৭৭৫-১৭৮২ সালের মধ্যবর্তী সময়ের স্মৃতিকথায় আমরা তেমনই বেশ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ পাই। সামাজিক মেলামেশায় বেশ খানিকটা সময় কাটানোর পর সাহেব হয়তো মনে করলেন দশটা বাজে কিন্তু ঘড়ি বের করে দেখলেন যে, সেখানে দেখাচ্ছে বেলা দুটো। আবার আরেক জায়গায় হিকি বলছেন যে, সকাল ন’টার আগে থেকেই এক পরিচিতের সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ ঘড়িতে দেখেন বিকেল চারটা বেজে গিয়েছে। সুতরাং সেই সমাজে সময়ানুবর্তিতার প্রয়োজন যে খুব তীব্র ছিল, তা মনে হয় না।
এই পরিস্থিতিতে আর কী কী কারণে ঘড়ি কিনতেন ক্রেতারা, সেটা একবার দেখা যাক। নতুন প্রযুক্তি ও মহার্ঘ বস্তুর মালিক হওয়ার শ্লাঘা তো একটা কারণ অবশ্যই ছিল। তাছাড়া আরও একটা অদ্ভুত কারণের কথা লিখেছেন অ্যারন আপজন। যিনি আবার কলকাতার প্রাচীন মানচিত্র নির্মাতাদেরও অন্যতম। আপজন জানাচ্ছেন যে, কানের কাছে ঘড়ির টিক-টিক শব্দ সঙ্গীতচর্চার প্রাথমিক শিক্ষার জন্য খুব উপযোগী। তার জন্যও অনেকে ঘড়ি কিনতেন! এছাড়াও আরেকটি প্রয়োজন ছিল সমুদ্রযাত্রার সময় দেখার কাজে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে, ক্রোনোমিটার নামে এক যন্ত্রের ব্যবহারে, যা ছিল এক বিশেষ ধরনের ঘড়ি। সমুদ্রে নানা ধরনের আবহাওয়া ও দুলুনি সত্ত্বেও ঠিকঠাক সময় দেওয়ার জন্য এই ঘড়ি তৈরি হতো। যা বিলেত ও ভারতের মধ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সময় নির্দেশের গোলমাল কমাতে প্রতিটি জাহাজে তিনটি করে ক্রোনোমিটার থাকত এবং সেই তিনটি যন্ত্রের দেওয়া তথ্যের গড় ধরে সময় নিরূপণ করা হতো। এর থেকে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, এই দামি ঘড়িগুলির ক্যালিব্রেশন ছিল জাহাজিদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, এটা সত্যি যে, এই ক্যালিব্রেশন লন্ডনের থেকে কলকাতায় অনেক ভালো করতেন এখানকার ঘড়ির যন্ত্রীরা। এর নেপথ্যে কারণগুলি খুঁজে বের করেছিলেন কলকাতা নিবাসী বিজ্ঞানী হেনরি পিডিংটন। যিনি সাইক্লোন ও নদীর জোয়ার-ভাটার উপর গবেষণার জন্য বেশি বিখ্যাত। পিডিংটন ধারণা দিলেন যে, বিষুবরেখার কাছে অবস্থানের জন্য পৃথিবীর চৌম্বকীয় শক্তির প্রভাব কলকাতায় অনেক দুর্বল। তুলনায় লন্ডনে সেটি অনেক শক্তিশালী। আর সেই সময়ে কলকাতার তুলনায় লন্ডন উন্নত শহর হওয়ায় তার পরিকাঠামোয় অনেক বেশি লোহার উপস্থিতি এবং বিলেত থেকে ভারতগামী জাহাজে প্রচুর লোহার জিনিস ম্যাগনেটাইজড হয়ে ঘড়ির ঠিক সময় দেওয়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করত।
পরিবহণ ও ঘড়ির সম্পর্ক যখন আলোচনায় এসেই পড়ল, এই সূত্রে রেল পরিবহণের কথাও উঠে আসে। ভারতের রেল ব্যবস্থা চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়ানুবর্তিতার একটা অন্য অর্থ সামনে এল। রেল পরিষেবা দেওয়া এবং সেই পরিষেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘সময়’ এবং ঘড়ির খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তৈরি হল। ১৮০২ সালে প্রথম মাদ্রাজ টাইম ব্যবস্থা চালু করা হয় এবং রেলওয়ে এই সময় ব্যবস্থাই মেনে চলত। তবে কলকাতা ও বম্বের জন্য আলাদা টাইম জোন ব্যবহৃত হতো। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের আরোপ করা সময়ের এই স্টান্ডার্ডাইজেশন নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে ক্ষোভ জমতে শুরু করে এবং বম্বে শহরে অন্তত দু’টি ক্ষেত্রে এই ক্ষোভ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের চেহারা নেয়। বম্বের ক্রফোর্ড মার্কেটের ঘড়ি মিনার ও বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজবাই ঘড়ি মিনারে সরকার থেকে মাদ্রাজ টাইম লাগু করার চেষ্টার বিরুদ্ধে বড় আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলনের চাপে সরকারকে শেষ পর্যন্ত পিছু হটে মিনারগুলির ঘড়িতে স্থানীয় বম্বে টাইম দেখানোর প্রস্তাব মেনে নিতে হয়। এলাহাবাদের ৮২.৫ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ মেনে ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম বলে আজ আমরা যে সময়টা ব্যবহার করি, সেই ব্যবস্থার উপর সরকারি সিলমোহর পড়ে এই সবে ১৯০৬ সালে।
সিপাহি বিদ্রোহের কাছাকাছি সময় থেকেই সমাজের নানা স্তরে ঘড়ির ব্যবহার বাড়তে থাকে। ১৮৫৭-র পরবর্তী সময় সেই ব্যবস্থা আরও প্রসারিত হয়। ব্যক্তিগত স্তরেও ঘড়ির ব্যবহার বাড়তে থাকে ঔপনিবেশিক প্রশাসন ও বাণিজ্য ব্যবস্থার সঙ্গে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের আদানপ্রদান গড়ে ওঠার ফলে। এই অবস্থাতেই ১৮৪৭ সালে বেঙ্গল অ্যান্ড আগ্রা অ্যানুয়াল গাইডের পাতায় প্রথম বাঙালি ঘড়ি প্রস্তুতকারকের উল্লেখ খুঁজে পেয়েছিলেন বিশিষ্ট গবেষক প্রজিতবিহারী মুখোপাধ্যায়। সেখানে চারজন ‘নেটিভ ওয়াচমেকার’ বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন গাইডে। কালাচাঁদ দাস, গোবিন্দচন্দ্র দাস, পীতাম্বর দাস, রামচাঁদ দাস— যাঁদের সকলেরই দোকান ছিল রাধাবাজারে। এই দেশীয় ঘড়ি নির্মাতাদের সম্পর্কে যদিও আর কোনও তথ্য পাওয়া যায় না।
এই ১৮৪০-এর দশক থেকেই ঘড়ি নির্মাণের বাজারে খুব দ্রুত বৃদ্ধি দেখা যেতে শুরু করে। কলকাতার নানা জায়গায় যেমন বহু ব্যক্তিগত উদ্যোগে নতুন ঘড়ি নির্মাণ ব্যবসা শুরু হল, তেমনই শহরের কেন্দ্রে শুরু হল বৃহৎ ইউরোপীয় ঘড়ি নির্মাতাদের দাপট। প্রথমেই খুব বড় আকারে তাঁরা ব্যবসা শুরু করেছিলেন কি না সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ না হওয়া গেলেও এই দশকেই কলকাতা প্রথম শুনল ব্ল্যাক অ্যান্ড মারে অথবা সেই হুতোমের ‘মেকাবি’ ক্লকের নির্মাতা এইচ ম্যাকাবি অ্যান্ড কোম্পানির নাম। এই পথ ধরেই কলকাতার অফিস পাড়ায় পা পড়ল কুক অ্যান্ড কেলভি থেকে ওয়েস্ট অ্যান্ড ওয়াচ কোম্পানির মতো ডাকসাইটে ঘড়ি নির্মাতা ও বিক্রেতাদের। ফিরে এলাম হুতোমের প্রসঙ্গে। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে হুতোমের নকশায় কলকাতায় প্যালানাথ বাবুরা হীরের ওয়াচ গার্ডে আধুলির আকারের মেকাবি কোম্পানির ‘হন্টিং’ ঘড়ি ঝুলিয়ে চলাফেরা করা রপ্ত করে ফেলেছেন। অবশ্য রপ্ত না করেও উপায় নেই, কলকাতার তাবত কেরানিকুলের টিকি যে ততদিনে অফিসে হাজিরার খাতায় বাঁধা হয়ে গিয়েছে। ফলে সাত পুরুষের ‘সময় বোধ’ বিসর্জন দিয়ে ঘণ্টা- মিনিটের শাসন মেনে নিতেই হয়।
কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ঘড়ি তখনও যথেষ্ট দামি। তাই আজকের দুনিয়ার ‘ডিজিটাল ডিভাইস’-এর মতো সেকালেও দেখা দিল এক সামাজিক বিভাজন। একদল মানুষের ঘড়ি আছে, অন্য দলের ভরসা ক্লক টাওয়ার বা সর্বজনীন জায়গায় স্থাপিত ঘড়ি। নিজস্ব ঘড়ি না থাকা বিশাল সংখ্যক মানুষদের সময় বলে দেওয়ার দায়িত্ব নিল সকলের চোখে পড়ার মতো জায়গায় স্থাপিত ঘড়িগুলি। বাজার, গির্জা বা রেলস্টেশন ছাড়াও অনেক বড় মানুষ নিজের বাড়িতেও বসাতেন ঘড়ি মিনার। সে সব ঘড়ি মিনারের কাঁটা ঘুরত রোমান বা ইংরেজিতে লেখা সংখ্যা ধরে। তবে, মানিকতলা বাজারের ঘড়িটির কাঁটা ঘোরে বাংলায় লেখা সংখ্যার ঘর ধরে। ভীম নাগের বউবাজারের দোকানের বাংলায় সংখ্যা লেখা ঘড়ির কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু মানিকতলা ক্লক টাওয়ারের আবছা হয়ে যাওয়া বাংলায় লেখা ডায়ালের দিকে আমরা হয়তো খেয়াল করি না। কলকাতার বহু ঘড়ি মিনার অকেজো হয়ে হারিয়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অতলে। আবার তেমনই কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরির লাগোয়া হেরিটেজ তালিকাভুক্ত ঘড়ি মিনারের ঘড়িটি বেশ কয়েক বছর অচল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর গত বছর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে সংস্কার হয়ে ফিরেছে স্বমহিমায়।
ঘড়ির কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা এই শহরের কয়েকজন মানুষ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় ডেভিড হেয়ার সাহেবের। উনি ঘড়ি নির্মাতা হিসেবেই পেশা শুরু করে পরবর্তীকালে জনসেবা ও শিক্ষা বিস্তারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। আরেকজন হলেন কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট। এদেশে পশুক্লেশ নিবারণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা। উনিশ বছর বয়সে বিলেত থেকে কলকাতায় এসে গ্রান্ট তাঁর দাদা জর্জের ঘড়ি ও ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রপাতি তৈরি ও বিক্রির কাজে সহায়তা করতে শুরু করেন।
বিদেশি বণিকদের সূত্রে যান্ত্রিক ঘড়ির সঙ্গে ভারতের পরিচয় হয়েছিল আগেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, সময় পরিমাপের এই পদ্ধতি উনিশ শতকের আগে সেভাবে সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে অঙ্গীভূত হওয়ার পর ঘড়ির ব্যবহার সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অনেকটাই দায়ে পড়ে সেটা মেনে নেয় এদেশের মানুষ। কিছু কিছু প্রতিরোধও হয়— যেমন তৎকালীন বম্বের ঘটনাগুলি প্রমাণ করে। অন্যদিকে উনিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে এই ঘড়ি ধরে অফিসকাছারি যাওয়ার ব্যবস্থাটাও যেন তেতো পাচনের মতো করেই গিলেছে ভারতীয়রা। এ প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে কিছু সূত্র তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিক সুমিত সরকার। বহু যুগ ধরে ভারতের সাধুরা কামিনী কাঞ্চনের মোহ নির্বাণ লাভের অন্তরায় বলে বিশ্বাস করে এসেছেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে এই দু’টির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সরকারি বা সওদাগরি অফিসের ঘড়ি ধরা ‘চাকরি’। চাকরির সময়ানুবর্তিতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ঈশ্বর সাধনার পথে অন্তরায়। আর তাই অনেকের চোখে ঘড়ি হয়ে উঠেছিল সর্বনাশা কলি যুগের প্রতীক। সমাজের একটি অংশের কাছে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও প্রগতির সূচক হলেও এক বড় সংখ্যক মানুষের কাছে ঘড়ি ছিল অমঙ্গলের চিহ্ন। এই পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়েই সমাজে ঘড়ি জায়গা করে নেয় ধীরে ধীরে। আজকাল অনেকেই মোবাইল ফোনে সময় দেখার কাজ সারেন। তাই ঘড়ি রাখার প্রয়োজন আর হয় না। কিন্তু আমাদের দেশ ও সমাজের বিবর্তনের ইতিহাসের নিরিখে ঘড়ির গুরুত্ব কোনওদিন কমবে না। তাই হয়তো সব পুরনো ঘড়ি আমাদের কাছ থেকে আরও যত্ন দাবি করে।
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস