হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
৩৬৯ মিনিটের চোয়ালচাপা লড়াই শেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস। করতালিতে ফেটে পড়ছে গ্যালারি। আবেগ চেপে রাখতে পারেনি ছেলেটিও। না পারাটাই তো স্বাভাবিক। এই দিনটার জন্য তাকে অনেক লড়াই, সংগ্রাম করতে হয়েছে। দিতে হয়েছে একের পর এক পরীক্ষা। তাই সেঞ্চুরির পর দু’হাত শূন্যে ছুঁড়ে ছেলেটা হয়তো বলতে চাইছিল ‘আমি পেরেছি।’
ঠিকই ধরেছেন। ১৯৯৬ সালের লর্ডসে অভিষেক টেস্টে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের রূপকথার উত্থানের কথাই বলছি। যা শুধু ভারতীয় ক্রিকেটের অভিমুখ নয়, বদলে দিয়েছিল ফুটবলপ্রিয় বাঙালির সনাতনী চিন্তাভাবনাকেও। সৌরভের আগে বাংলার অনেকেই টেস্ট খেলেছিলেন। হাঁকিয়েছিলেন শতরানও। কিন্তু ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সৌরভের অভিষেক টেস্টে শতরান, দেশের পাশাপাশি বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, বাঙালিরাও ক্রিকেট খেলতে পারে।
টেমস দিয়ে তারপর অনেক জল গড়িয়েছে। বেহালার মহারাজে সুরভিত হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সৌরভ সম্পর্কে বলতে গেলে ঘড়ির কাঁটাও হয়তো থমকে দাঁড়াবে। আসলে তিনি শুধু জাতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেননি, সাফল্যের সঙ্গে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। তাঁর সময়েই গড়ে উঠেছিল ‘টিম ইন্ডিয়া’। অবসরের পরেও ক্রিকেটের সেবায় নিয়োজিত মহারাজ। বোর্ড সভাপতি হিসেবে তাঁর এই ইনিংসও কম রোমাঞ্চকর নয়। মহেন্দ্র সিং ধোনি, শচীন তেণ্ডুলকরদের আত্মজীবনী নিয়ে তথ্যচিত্র হয়েছে। কিন্তু সৌরভের মতো ক্রিকেটে এমন এক বিরল চরিত্র আজও কেন সেলুলয়েডে স্থান পেলেন না, তা ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে।
১৯৯২ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরেই মহারাজের ক্রিকেট জীবনের উপসংহার লিখে ফেলতে চেয়েছিলেন তৎকালীন বোর্ডের একাধিক কর্তা। কিন্তু পারেননি। তাঁরা শেষ পর্যন্ত হার মেনেছিলেন সৌরভের অদম্য জেদের কাছে। ৯২ থেকে ৯৬—এই চার বছরে নিজেকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। বাবা চণ্ডী গঙ্গোপাধ্যায় সাহস জুগিয়ে বলতেন, ‘তুই পারবি।’ সেটাই ছিল মহারাজের কাছে ফিরে আসার সঞ্জীবনী সুধা।
অবশেষে পালাবদল শুরু। ইংল্যান্ডগামী ভারতীয় দল নির্বাচনের দিন সৌরভ খেলছিলেন ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে। জাতীয় দলে কামব্যাকের খবরটা পেয়েছিলেন ময়দানেই। তবে ১৬ জনের দলে তাঁর নাম হয়তো সেবারও থাকত না, যদি তৎকালীন জাতীয় নির্বাচকমণ্ডলীতে বাংলার প্রতিনিধি সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঝোড়ো ব্যাটিং না করতেন। স্মৃতির সরণি হাতড়ে সম্বরণ বলছিলেন, ‘অনেক লড়াই করতে হয়েছিল সৌরভকে দলে রাখার জন্য। কখনও হাল ছাড়িনি। জগমোহন ডালমিয়া ছিলেন তৎকালীন বোর্ড সচিব। তাঁর কথা না বললে অন্যায় হবে। আর সেই সময়ের নির্বাচকপ্রধান জি আর বিশ্বনাথ ও অংশুমান গায়কোয়াড়কে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম কেন সৌরভকে দরকার। মিটিংয়ে ওরা ভীষণভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন আমাকে। ক্যাপ্টেন আজহারউদ্দিন কিছুতেই বাংলার ক্রিকেটারকে দলে নিতে চাইছিল না। বিনোদ কাম্বলির জন্য সওয়াল করেছিল কোচ সন্দীপ পাতিল। কিন্তু নির্বাচনী সভায় আমি এটা বোঝাতে চেয়েছিলাম, শুধু ব্যাটসম্যান নয়, সৌরভকে অলরাউন্ডার হিসেবে ইংল্যান্ড নিয়ে যাওয়া উচিত। সেটা পরে সঠিক প্রমাণিত হয়। লর্ডসে অভিষেক টেস্টে মহারাজের শতরানের পাশাপাশি তিনটি উইকেটও নিয়েছিল। আজহারের মতো প্রবল বিরোধীও ট্রেন্টবিজে দ্বিতীয় সেঞ্চুরির পর সৌরভকে চুপিসারে ঘড়ি উপহার দিয়েছিল। প্রথম টেস্টেই সৌরভ বুঝিয়ে দিয়েছিল, ও লম্বা রেসের ঘোড়া। আমার খুব মনে পড়ে, যেদিন ও সেঞ্চুরি করল, তখন চলছিল ইউরো কাপ। তুমুল উন্মাদনা কলকাতা সহ বাংলায়। কিন্তু মহারাজ হাফ-সেঞ্চুরি করার পরেই বাঙালি চ্যানেল চেঞ্জ করেছিল। সৌরভের ওই ইনিংস দেখার পর বঙ্গবাসীর বিশ্বাস হয়েছিল, আমরাও ক্রিকেট খেলতে পারি।’
ভারতীয় ক্রিকেটে বঙ্গবিদ্বেষ নতুন নয়। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্রিকেটারের জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নপূরণ হয়নি। একইভাবে অবজ্ঞা ও বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছিল মহারাজকেও। ইংল্যান্ড সফরগামী দলে সুযোগ পাওয়া নিয়ে অনেক টিপ্পনি শুনতে হয়েছিল তাঁকে। রাহুল দ্রাবিড়ও প্রথম টেস্ট খেলেছিলেন ওই সফরেই। কিন্তু সৌরভের মতো তাঁকে বৈমাতৃসুলভ আচরণের মুখে পড়তে হয়নি। সহযোগিতা তো দূরে থাক, সতীর্থদের থেকে অধিকাংশ সময়ই শুনতে হতো কটাক্ষ। প্র্যাকটিস ম্যাচে দলে রেখেও ব্যাট করার সুযোগ দেওয়া হতো না। তবুও তিনি পণ করেছিলেন, আর যাই হোক এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। ব্যর্থ হওয়া মানে চিরকালের জন্য ভারতীয় দলের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া। তাই অপেক্ষা করেছেন সুযোগের। মনের গভীরতম কোণে স্থান দেননি হতাশাকে। মন খারাপ হলে টেলিফোনে কথা বলতেন পরিবারের সঙ্গে। ইংল্যান্ডে থাকতেন কাকা-কাকিমা। সেখানে তাঁরাই ছিলেন মহারাজের অভিভাবক।
ভারতীয় দলের হয়ে প্রথম ইংল্যান্ড সফর ঘিরে আজও আলাদা আবেগ কাজ করে সৌরভের মধ্যে। লর্ডস টেস্টে সেঞ্চুরি নিয়ে তিনি স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন। হিথরো বিমানবন্দরে নেমে মধ্য লন্ডনের পিকাডেলিয়ার যে ছোট্ট হোটেলে ভারতীয় দল সেদিন চেক-ইন করেছিল, তার প্রতিটি অন্দরসজ্জা এখনও মুখস্থ বলতে পারেন মহারাজ। কারণ, ওটাই তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উত্থানের গর্ভগৃহ। আজও লন্ডনে গেলে সময় বের করে একবার ঢুঁ মারেন সেখানে। সৌরভের কথায়, ‘লন্ডন বরাবরই আমার খুব প্রিয় জায়গা। সেকেন্ড হোম বলতে পারেন। ভারতীয় দলের হয়ে প্রথমবার ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়ে যে হোটেলে উঠেছিলাম, তা আমার কাছে আজও স্পেশাল। যখনই ওই হোটেলের সামনে দিয়ে যাই, পুরনো দিনগুলো মনে পড়ে। থমকে দাঁড়ালে সানা (মেয়ে) প্রশ্ন করে, বাবা কী রয়েছে এখানে? তুমি এভাবে ভাবুক হয়ে তাকিয়ে থাকো কেন? আমি শুধু বলি সানু, সবকিছু তো এখান থেকেই শুরু।’
খেলার মাঠে কোচেদের মুখে একটা কথা সব সময় শোনা যায়—পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই! সৌরভও সেই পরিশ্রমেরই সুফল পেয়েছেন। অফ সিজনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা না মেরে ব্যাগ গুছিয়ে চলে যেতেন ইংল্যান্ডে। কারণ, বাবা চণ্ডী গঙ্গোপাধ্যায় ভীষণভাবে চাইতেন, ছোট ছেলেকে ক্রিকেট শিক্ষায় আরও শিক্ষিত করে তুলতে। ইংল্যান্ডে বিভিন্ন লিগে খেলতেন সৌরভ। কিন্তু কে জানত, সেই বিনিয়োগই একদিন এত ভালো রিটার্ন দেবে। স্মৃতি হাতড়ে সৌরভ বলছিলেন, ‘আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে কলকাতা থেকে ইংল্যান্ডে চলে যেতাম বিভিন্ন লিগে খেলতে। সেই অভিজ্ঞতা প্রথম টেস্টে কাজে দিয়েছিল। তবে টেস্ট ক্রিকেট অনেক বড় মঞ্চ। এর সঙ্গে কোনও কিছুরই তুলনা চলে না। শুরু থেকেই মানসিক প্রস্তুতি খুব ভালো ছিল। অভিষেক টেস্ট খেলা নিয়ে বাড়তি কোনও চাপ ছিল না। বরং খেলাটা উপভোগ করতে চেয়েছিলাম।’
ইংল্যান্ড সফরে সাফল্যের পিছনে সৌরভ বরাবরই দু’জনের কথা ভীষণভাবে স্মরণ করেন। ডেসমন্ড হেইন্স আর মার্ক ক্রেইগ। মহারাজের কথায়, ‘ইংল্যান্ডে গ্রীষ্মের শুরুতে কীভাবে ব্যাট করতে হবে, সেটা হেইন্সের থেকেই জানা। বলেছিলেন, তোমার অফস্টাম্প কোথায়, সেটা আগে জানতে হবে। আর খেলতে হবে ফ্রন্ট ফুটে। সেটাই আমি বরাবরই মেনে চলার চেষ্টা করেছি। আর ক্রেইগ ছিলেন মনোবিদ। ওর সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। ক্রেইগ বলতেন, কত বলে কত রান করলে বড় ব্যাপার নয়। যতক্ষণই ক্রিজে থাকো না কেন, চেষ্টা করতে হবে ম্যানেজমেন্টকে খুশি করতে। জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির বরাবরই আলাদা গুরুত্ব থাকে। কিন্তু লর্ডসের সাফল্যের পথ চলা শুরু অনেক আগেই। ওল্ড ট্রাফোর্ডে একদিনের ম্যাচে ৪৬ রানের ইনিংস আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থা অর্জনেও সফল হয়েছিলাম। আমার মনে আছে, প্রথম টেস্টে হারার পর একদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে ক্যাপ্টেন আজহার এসে আমাকে বলল, পরের ম্যাচে খেলবে তুমি। সেদিন কতটা আনন্দ হয়েছিল, বলে বোঝাতে পারব না। তবে এটাও মনে হচ্ছিল, ঠিক শুনলাম তো! পরে রাহুল দ্রাবিড়ের মুখে শুনে নিশ্চিত হই।’
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, রাখে হরি মারে কে। সৌরভের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছিল। নভজ্যোত সিং সিধু টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে ঝামেলা করে দেশে ফিরে যান। আর সেটাই যেন সৌরভের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে প্রথম টেস্টে ভারতের হার অনুঘটকেরও কাজ করেছিল। অনেকে বলেন, সৌরভকে ‘এক্সপোজড’ করার পরিকল্পনা ছিল সন্দীপ পাতিলদের। ভেবেছিল, সুইং খেলতে পারবে না। কিন্তু, তাবড় তাবড় ইংরেজ বোলারদের শান্ত করে দিয়েছিল মহারাজকীয় ব্যাট। দ্বিতীয় দিনে সৌরভ যখন ২৬ রানে অপরাজিত থেকে সাজঘরে ফিরেছিলেন, তখনও সতীর্থরা ভাবতে পারেননি যে, তিনি সেঞ্চুরি হাঁকাবেন। কিন্তু কথায় আছে, ভীরুর মৃত্যু বারবার, বীরের মৃত্যু একবার। সৌরভ সাহস দেখিয়েছিলেন ফ্রন্ট ফুটে কভার ড্রাইভ হাঁকানোর। আর তাতেই বেসামাল হয়ে গিয়েছিল বিপক্ষ বোলাররা। বাউন্ডারি হাঁকিয়ে অর্ধশতরান, আবার বাউন্ডারি হাঁকিয়েই শতরান। এভাবেই ক্রিকেটের মক্কায় লেখা হয়েছিল সুরভিত রূপকথা।
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়