হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
ইংরেজি ভাষায় অপরাধ শব্দটিকে বলা হয় ‘ক্রাইম’। এই কাহিনির দুটি শ্রেণি— ডিটেক্টিভ ও ইনভেস্টিগেশন। প্রথম কাহিনিতে সমস্ত তথ্য পেয়ে বা নিজের বুদ্ধিবলে তথ্য সংগ্রহ করে ডিটেক্টিভ। পরের কাহিনিতে পুলিস বা ডিটেক্টিভ তাদের দলবল নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। তারপরেই তা যাচাই করে অপরাধ নির্ণীত হয়। সব ডিটেক্টিভ গল্পেই অপরাধী ও ডিটেক্টিভের দ্বৈত নায়কত্ব থাকে। একজন থাকে আড়ালে, অন্যজন পাঠকের মানসপটে। ‘গীতা’য় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন সেটাই ডিটেক্টিভ কাহিনির মূলমন্ত্র—অর্থাৎ বুদ্ধির খেলা দিয়ে অপরাধ বা অপরাধী নির্ণয় করা।
এক
বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা কাহিনির সূত্রপাত হয়েছিল ‘দারোগার দপ্তর’ পত্রিকায়। এ ছাড়াও গোয়েন্দা বিভাগের প্রাক্তন কর্মী প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় কয়েকটি গোয়েন্দা কাহিনি লিখেছিলেন। যেমন—‘ডিটেকটিভ পুলিশ’, ‘বনমালী দাসের হত্যা’ ইত্যাদি। তবে ‘দারোগার দপ্তর’-এর অনুসরণে শরচ্চন্দ্র দেব (সরকার) প্রকাশ করেছিলেন ‘গোয়েন্দা কাহিনি’ পুস্তকনামা। এর মধ্যে ছিল ‘খুন না হত্যা’, ‘উইল জাল’, ‘রঘু ডাকাত’, ‘ডবল খুন’ ইত্যাদি। অগ্রগণ্য লেখক হিসেবে অবশ্যই মনে আসে পাঁচকড়ি দে-র নাম। তিনিই প্রথম বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে দুটি ডিটেক্টিভ চরিত্রের সৃষ্টি করেছিলেন। তারা দেবেন্দ্রবিজয় ও তার সহকারী অরিন্দম। পাঁচকড়ি যে সব গোয়েন্দা কাহিনি লিখেছিলেন বা সংকলন করেছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘নীল বসনা সুন্দরী’, ‘মায়াবিনী’, ‘হত্যাকারী কে’, ‘হত্যা রহস্য’ ইত্যাদি। এর পরের লেখকরা হলেন রজনীচন্দ্র দত্ত, দীনেন্দ্রকুমার রায়, জগদানন্দ রায় ও সরলাবালা দাসী। ওঁরা সকলেই গোয়েন্দা কাহিনি লিখে ‘কুন্তলীন’ পুরস্কার পেয়েছিলেন। বিশেষ করে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ‘রহস্য লহরী’ সিরিজের গোয়েন্দা কাহিনিগুলি সেকালেই বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
বাংলা গোয়েন্দা কাহিনিতে প্রথম বাঁক এনেছিলেন রায় বাড়ির সন্তান কুলদারঞ্জন রায়। তিনিই প্রথম শার্লক হোমসের গল্পগুলি বাংলায় রূপ দিয়েছিলেন। তবে ত্রিশূল ফর্মুলায় গোয়েন্দা রহস্যের সমাধান করেছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। হেমেন্দ্র-সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রের নাম জয়ন্ত। সে বুদ্ধিমান, পাশাপাশি বলশালীও। একমাত্র নেশা নস্যি। ওর সহযোগী মানিক। দু’জনেই সাহসী, ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন। রহস্য উন্মোচনের নেশায় তারা দেশ-বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। হেমেন্দ্রকুমারের লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গোয়েন্দা কাহিনি হল—‘জয়ন্তের কীর্তি’, ‘শনি মঙ্গলের রহস্য’, ‘সাজাহানের ময়ূর’ ইত্যাদি। বাংলা কিশোরপাঠ্য গোয়েন্দা কাহিনিকে বয়স্ক পাঠ্যের মর্যাদা প্রথম দিয়েছিলেন হেমেন্দ্রকুমার। এতদিন পর্যন্ত গোয়েন্দা গল্পে কাহিনিই মুখ্য ছিল, কিন্তু শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে কাহিনির পাশাপাশি মুখ্য হয়ে দাঁড়াল চরিত্র। এক্ষেত্রে প্রথম জনপ্রিয় ও বিখ্যাত গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সী এবং তার সহকারী অজিত। কন্যান ডয়েল গোয়েন্দা শার্লক হোমসের পাশাপাশি সহকারী হিসেবে ওয়াটসনকে রেখেছিলেন—ঠিক সেইরকমভাবে শরদিন্দু ব্যোমকেশের সহযোগী অজিতকে রাখলেন। তিনিই প্রথম গোয়েন্দা কাহিনিকে সাধারণ উপন্যাসের মর্যাদা দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাহিনি ‘সত্যান্বেষী’, ‘চোরাবালি’, ‘রক্তমুখী নীলা’, ‘সীমন্তহীরা’ ‘ব্যোমকেশ ও বরদা’ ইত্যাদি।
ব্যোমকেশ বক্সী সত্যান্বেষী রূপে পরিচিত। তার আবির্ভাব ‘সত্যান্বেষী’ (১৯৩২) রচনার মধ্যে দিয়ে। কথিত আছে, জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে হ্যারিসন রোডের এক মেস বাড়িতে একসময় থাকতেন শরদিন্দু। সেই বাড়ির প্রেক্ষাপটেই জন্ম হয়েছিল সত্যন্বেষী ব্যোমকেশের। শরদিন্দু ব্যোমকেশের বর্ণনায় লিখেছেন, ‘তাহার বয়স বোধকরি তেইশ চব্বিশ হইবে, দেখিলে শিক্ষিত ভদ্রলোক বলিয়া মনে হয়। গায়ের রঙ ফর্সা, বেশ সুশ্রী সুগঠিত চেহারা—মুখে চোখে একটা বুদ্ধির ছাপ আছে।’ ব্যোমকেশ কাহিনির বেশিরভাগ গল্পই অজিতের জবানিতে লেখা। অজিত ব্যোমকেশের বন্ধু, রুমমেট ও সহযোগী। ‘অর্থমনর্থম’ গল্পে সত্যবতীর সঙ্গে ব্যোমকেশের প্রথম আলাপ হয়। ওই গল্পে সত্যবতী ছিল খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত সুকুমারের বোন। আলাপ থেকে প্রেম, তা থেকে বিয়ে হয় ওদের। কয়েকটি কাহিনিতে সত্যবতীও তদন্তের কাজে ব্যোমকেশের সহযোগী হয়েছে।
ব্যোমকেশের গড়ন লম্বা, নাকটি টিকালো কিন্তু মুখমণ্ডল স্থূল প্রকৃতির। কথা কম বলার ফলে বাইরে থেকে তাকে সহজে পড়া যায় না। তবে তার মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত বিশ্লেষণী ক্ষমতা। বুদ্ধিমত্তা ও শুভিবুদ্ধির দ্বারা সহজেই সে জটিল রহস্যের জাল খুলে ফেলেছে। ব্যোমকেশ তার নিজের বাড়ির দরজায় লিখে রেখেছিল শ্রীব্যোমকেশ বক্সী, সত্যান্বেষী। এর কারণ হিসেবে ‘সত্যান্বেষী’-র অর্থ সে অজিতকে জানিয়েছিল, ‘ওটা আমার পরিচয়। ডিটেকটিভ কথা শুনতে ভালো নয়, গোয়েন্দা শব্দটা আরও খারাপ, তাই নিজের খেতাব দিয়েছি সত্যান্বেষী।’ শরদিন্দু ব্যোমকেশকে নিয়ে তেত্রিশটি কাহিনি রচনা করেছেন। আজ আর শুধু বইয়ের পাতাতেই বন্দি নেই ব্যোমকেশ, তার কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছে হিন্দি, বাংলায় একাধিক সিনেমা, টিভি সিরিয়াল ও বেতার অনুষ্ঠান।
এবারে ফেলুদার কথা। আর্থার কন্যান ডয়েলের শার্লক হোমস, আগাথা ক্রিস্টির এরকুল পোয়ারো ও শরদিন্দুর ব্যোমকেশকে সামনে রেখে সত্যজিৎ রায় ফেলুদা চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। ফেলুদার পুরো নাম প্রদোষচন্দ্র মিত্র। জীবনের অন্ধকার দিক নিয়ে কাজ করলেও সে তাজা আলোবাতাস ঢোকানোর জন্যে মনের জানলাটা খোলা রেখেছে। কন্যান ডয়েলের ওয়াটসন বা শরদিন্দুর অজিতের মতোই সত্যজিৎ ফেলুদার সহযোগী হিসেবে তোপসেকে এনেছেন। আর হাস্যরস সৃষ্টির জন্যে লালমোহনবাবু বা জটায়ু।
জয়যাত্রার শুরুতেই (১৯৬৫) আলোড়ন তুলেছিল ফেলুদা। স্মার্ট, সুদর্শন, কারুবাক, বুদ্ধিদীপ্ত ছ’ফুট দু’ইঞ্চি উচ্চতার এই যুবক সাধারণ বাঙালি হয়েও অন্যরকম। ফেলুদা রহস্য দেখলেই সত্য উদ্ঘাটনে নেমে পড়ে। ‘হত্যাপুরী’ উপন্যাসে তোপসে বলেছে যে, কেস জমাটি হলে রোজগার হল কি না সেটা ফেলুদা ভুলে যায়। তাই অনেক মক্কেল সরাসরি নিযুক্ত না করলেও ফেলুদা সেখানে যেচে গিয়েছে রহস্যের সমাধান করতে।
ফেলুদাকে নিয়ে সত্যজিৎ ঊনচল্লিশটি কাহিনি লিখেছেন। তার মধ্যে চারটি অসমাপ্ত। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ‘বাদশাহী আংটি’, ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘লন্ডনে ফেলুদা’ ইত্যাদি। রহস্য উন্মোচনে দার্জিলিং, পুরী, রাজস্থান, সিমলা, বোম্বাই, কাশ্মীর কেদারনাথসহ ফেলুদা গিয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। বিদেশে মূলত হংকং, লন্ডন ও নেপালে। খুনের রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি ফেলুদা উদ্ধার করেছে অ্যান্টিক, প্রাচীন রত্নালঙ্কার বা দুষ্প্রাপ্য সব জিনিস। কোথাও ধাঁধার রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে মূল রহস্যের সমাধান করেছে সে। গোয়েন্দাগিরিতে খুশি হয়েই জটায়ু ফেলুদাকে বলেছে এ. বি. সি. ডি অর্থাৎ ‘এশিয়াজ ব্রাইটেস্ট ক্রাইম ডিটেক্টর’। ফেলুদা একেবারেই দেশি, খাঁটি বাঙালি গোয়েন্দা। তবে চারমিনার সিগারেট তার নিত্য সঙ্গী। ব্যোমকেশ কাহিনির মতো একাধিক ভাষায় ফেলুদা কাহিনির সিনেমা হয়েছে। তা ছাড়া টিভি সিরিজ বা বেতার নাটক তো আছেই।
একসময় পাঠকদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিল নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটী রায়। চিকিৎসক হবার সুবাদে ইংল্যান্ডে থাকাকালীন আগাথা ক্রিস্টির সঙ্গে দেখা করেছিলেন নীহাররঞ্জন। তাঁর অনুপ্রেরণা পেয়েই তিনি লিখেছেন ‘কালো ভ্রমর’ (১৯৩০) উপন্যাসটি। একটি জমিদার বাড়িতে ঘটে যাওয়া কাহিনি তাঁকে গোয়েন্দা উপন্যাসের প্লট ও কিরীটী চরিত্র সৃষ্টির অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। হেমেন্দ্রকুমারের জয়ন্ত ও শরদিন্দুর ব্যোমকেশ ছিল নীহাররঞ্জন গোয়েন্দাভাবনার মূলে। তিনি পঁচাত্তরটি উপন্যাস লিখেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বিস্ময়ের ইন্দ্রজাল’, ‘রক্তলোভী নিশাচর’, ‘অদৃশ্য কালো হাত’, ‘মৃত্যুবাণ’, ‘বিষের তীর’ ইত্যাদি। গোয়েন্দা কাহিনি রচনায় তাঁর খ্যাতি একসময় হেমেন্দ্রকুমারকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিরীটী চরিত্রে মুগ্ধ ছিলেন স্বয়ং উত্তমকুমার। একদিন স্বয়ং মহানায়ক কিরীটী চরিত্রে অভিনয়ের ইচ্ছে প্রকাশ করে বাড়িতে গেলে নীহাররঞ্জন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ওই চরিত্রে উত্তমকুমারকে কিছুতেই মানাবে না। তাঁর মতে, নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ই এক্ষেত্রে ছিলেন পারফেক্ট।
জনশ্রুতি আছে, নীহাররঞ্জন একবার নিজের পেন দিয়ে অটোগ্রাফ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখক হবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ নাকি বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া পেন দিয়ে লিখলেই লেখক হওয়া যায় না।’ শেষপর্যন্ত নীহাররঞ্জন লেখক হয়েছিলেন। ‘কিরীটী অমনিবাস’ চোদ্দোটি খণ্ডে আজও বিক্রি হয়ে চলেছে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায়। তাঁর অনেক গল্প টিভি সিরিজ, চলচ্চিত্র বা বেতারে রূপ পেয়েছে। কিরীটী কাহিনি পড়ে স্বয়ং প্রমথনাথ বিশী বলেছিলেন যে, কিরীটী রায় সমসাময়িক ডিটেক্টিভ কাহিনির নায়কদের মধ্যে অন্যতম সেরা।
গোয়েন্দা হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবুর জুড়ি মেলা ভার। কাকাবাবুর আসল নাম রাজা রায়চৌধুরী। আফগানিস্তানে এক দুর্ঘটনায় সে পঙ্গু হয়ে যায়। তারপর থেকে তার নিত্যসঙ্গী ক্রাচ। ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন এই কর্মকর্তার নিত্য নেশা গোয়েন্দাগিরিতে মেতে থাকা। কাকাবাবু বিয়ে করেনি। শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে জটিল রহস্যের সমাধান করেছে সে। রহস্যের সন্ধান পেলেই সে ছুটে গেছে অজানা জায়গায়। অভিযানে তার সব সময়ের সঙ্গী হয়েছে ভাইপো সন্তু। মাঝে মাঝে সন্তুর বন্ধু জোজো তাদের সঙ্গ নিয়েছে। তা ছাড়া অবশ্য কাকাবাবু কাহিনিতে দেখা গিয়েছে দেবলীনা দত্ত, শৈবাল দত্ত, বিনি বা নরেন্দ্রকে। সুনীল ১৯৭৯ সালে ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন। সেখানেই আমরা প্রথম পেয়েছি কাকাবাবুকে। কাকাবাবুকে সামনে রেখে তিনি ছত্রিশটি উপন্যাস ছাড়াও কিছু গল্প লিখেছেন। তাকে নিয়ে বাংলায় কয়েকটি সিনেমাও হয়েছে। কয়েক বছর আগে কাকাবাবুকে নিয়ে একটি গান তৈরি করেছিলেন অনুপম রায়।
সুনীলের সমসাময়িক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা শবর দাশগুপ্ত। শবর কলকাতা পুলিসের গোয়েন্দাকর্তা। তাকে রহস্য উন্মোচন করতে দেখা গিয়েছে পুলিসি ট্রেনিংয়ের সাহায্যে। বাজে কোনও নেশা নেই শবরের। সে অবিবাহিত, তবে সংবেদনশীল। তার তদন্ত প্রক্রিয়া এবং জেরায় এক লহমায় ভেঙে পড়ে অপরাধীরা। শবরকে সামনে রেখে একাধিক সিনেমাও হয়েছে টলিপাড়ায়।
ঋজুদাও কিন্তু কম বিখ্যাত নয়। প্রোফেসর শঙ্কুর মতোই ঋজুদা জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে অভিযান করেছে। স্রষ্টা বুদ্ধদেব গুহ স্বয়ং ঋজুদা সম্পর্কে বলেছেন, ‘এগুলি শুধুমাত্র গোয়েন্দা বা শিকার কাহিনি নয়, এগুলো পড়লে বাড়িসুদ্ধু সকলের নতুন নতুন নানা জায়গায় বেড়িয়ে আসার সুযোগ হবে।’ অনেকটা ফেলুদা কাহিনির ভ্রমণের মতো। ঋজুদার প্রথম বই ‘ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে’। তার সবসময়ের সঙ্গী রুদ্র। মাঝে মাঝে অবশ্য রহস্য অভিযানে যোগ দিয়েছে তিতির ও ভটকাই।
আমাদের ছোটবেলায় অন্যতম প্রধান রহস্য কাহিনি ছিল ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’। পাঁচ দুঃসাহসী ছেলেমেয়ে ও একটি কুকুর পঞ্চুকে নিয়ে এই গোয়েন্দা দল গঠিত। অনেকটা নলিনী দাশের গণ্ডালুর মতো। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এরা রোমাঞ্চকর অভিযানে শামিল হয়েছে। এই দলের নায়ক বাবলু। সে বুদ্ধিমান, সাহসী ও সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী। পিস্তল চালাতে ওস্তাদ সে। তার সঙ্গী বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু ও বিচ্চু। ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল মাসিক ‘শুকতারা’ (১৯৭০) পত্রিকায়। তারপর ওই নামে প্রকাশিত একাধিক গল্প, উপন্যাস শিশুকিশোদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সদ্য শেষ হয়েছে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’ টিভি সিরিজ।
সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ খুদে কিশোর পাঠকদের জন্যে সৃষ্টি করেছিলেন গোয়েন্দা কর্ণেল। আসল নাম নীলাদ্রি সরকার। সমরেশ মজুমদারই বা বাদ যাবেন কেন গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টিতে? তাঁর জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র অর্জুন। এই সিরিজের প্রথম বই ‘খুনখারাপি’। আমরা যদি একটু পিছনে তাকাই তবে দেখব শৈলবালা ঘোষজায়া লিখেছিলেন ‘জয় পতাকা’। পুলিসের পাশাপাশি এখানে গোয়েন্দাগিরি করেছে জীমূতবাহন ও তার দুই বন্ধু। প্রেমেন্দ্র মিত্রও গোয়েন্দা গল্প লিখেছিলেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের নাম পরাশর বর্মা। সে ছিল একাধারে কবি ও গোয়েন্দা। শিবরাম চক্রবর্তীর দুইজন গোয়েন্দা ছিল কল্কে আর কাশি। এরা ছিল হাস্যরসের গোয়েন্দা। শিবরামের কল্কে-কাশির দেখাদেখি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যও গোয়েন্দা কাহিনি লিখেছিলেন। তাঁর গোয়েন্দার নাম হুকোকাশি। একসময় শশধর দত্ত ‘মোহন সিরিজ’ লিখে বইপাড়া মাতিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর গোয়েন্দাহিরো মোহন স্বয়ং। স্বপনকুমারের গোয়েন্দা কাহিনিও একসময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই হিসেবে গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি ও সহকারী রতনলালের নাম সকলেরই জানা। উল্লেখ্য, স্বপনকুমারের আসল নাম ছিল সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে। গোয়েন্দা কাহিনির পাশাপাশি চিকিৎসা শাস্ত্রেরও অনেক বই লিখেছেন তিনি। এই সমরেন্দ্রনাথই সেইসময় ‘শ্রীভৃগু’ ছদ্মনামে জ্যোতিষ শাস্ত্রের কিছু বই লিখেছিলেন।
দুই
বাংলা সাহিত্যে প্রথম নারী গোয়েন্দাকে নায়িকার আসন দিয়েছিলেন প্রভাবতী দেবী সরস্বতী। তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দাদ্বয়ের নাম ছিল ‘কৃষ্ণা’ ও ‘শিখা’। কৃষ্ণা সিরিজে সাতটি আর শিখা সিরিজে তিনি তিনটি কাহিনি লিখেছিলেন। যেমন—‘কারাগারে কৃষ্ণা’, ‘কৃষ্ণার অভিযান’ ‘রহস্যময়ী শিখা’ ইত্যাদি। দুই গোয়েন্দাই আদপে ছিল বিচক্ষণ, সুগঠিত চেহারার। একাধিক ভাষায় পারদর্শী, অশ্বারোহণ বা গাড়ি চালনায় দক্ষ এই দুই গোয়েন্দা রহস্যের উন্মোচন করেছে মাথা ঠান্ডা রেখে, উপস্থিত বুদ্ধিবলে।
নারী গোয়েন্দাকে একটি বিশেষ স্থানে বসিয়েছিলেন নলিনী দাশ। তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দার নাম গণ্ডালু। মূলত চারটি চরিত্র কালু (কাকলি চক্রবর্তী), মালু (মালবিকা মজুমদার), বুলু (বুলবুলি সেন) ও টুলু (টুলু বোস) এই চার বন্ধুর টিম—গোয়েন্দা গণ্ডালু। এদের প্রত্যেকের নামের শেষ অক্ষর ‘লু’। কালুই এদের দলের পাণ্ডা। ওর বুদ্ধিই সবচেয়ে বেশি। তবে রহস্য উন্মোচনে এরা সকলেই তৎপর। বিপদ বুঝে নিজেদের মধ্যে কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে এরা রহস্যের সমাধান করেছে। নলিনী দাশ গণ্ডালুকে নিয়ে ঊনত্রিশটি কাহিনি লিখেছেন। যেমন—‘গোয়েন্দা গণ্ডালু’, ‘জমিদার বাড়ির রহস্য’, ‘অভিশপ্ত রাজবাড়ি’, ‘সিমলার মামলা’, ‘শিখর রহস্য’ ইত্যাদি। কখনও জাল নোটের কারবারি, কখনও গোল্ড-স্মাগলার, কখনও বা ভেজাল ওষুধ ও খাবার তৈরির কারখানার রহস্য উন্মোচন করেছে তারা। উল্লেখ্য, নলিনী দাশের বেশিরভাগ গোয়েন্দা কাহিনির অলঙ্করণ করেছেন সত্যজিৎ রায়। কিছু গল্পের নামকরণও করেছিলেন তিনি।
নারী গোয়েন্দা হিসেবে বিখ্যাত হয়েছে তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা গার্গী। পুরো নাম গার্গী ব্যানার্জি। ‘ঈর্ষার সবুজ চোখ’ দিয়ে শুরু হয়েছিল গার্গীর জয়যাত্রা। তারপর কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সে গোয়েন্দাগিরি করেছে। তেইশটি গোয়েন্দা কাহিনিতে গার্গী বিভিন্ন রহস্যের সমাধান করেছে। যেমন—‘হলুদ খামের রহস্য’, ‘কফিন রঙের রুমাল’, ‘চিনা ডাকাতের হত্যা রহস্য’, ‘হোস্টেল হত্যা’ ইত্যাদি। অপরাধীকে কব্জা করতে কখনওই তাকে পিস্তল ধরতে হয়নি। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও অতুলনীয় বুদ্ধির দ্বারা সে অপরাধীকে চিহ্নিত করেছে। শুরুতে সে ছিল শখের গোয়েন্দা, পরে সংসার সামলাতে তাকে পেশাদার গোয়েন্দাগিরিতে নামতে হয়েছে। গার্গী নিতান্তরূপেই গোয়েন্দা দময়ন্তীর উত্তরসূরি।
কে এই দময়ন্তী? মনোজ সেন সৃষ্ট বিবাহিতা নারী গোয়েন্দা। অন্যদিকে ইতিহাসের অধ্যাপিকাও সে। ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ পত্রিকার পাতায় প্রথম পাওয়া গিয়েছিল দময়ন্তীকে। তার আগে অবশ্য আমরা পেয়েছি গোয়েন্দা নারায়ণীকে। বাংলা সাহিত্যের শুরুতে গোয়েন্দা সাহিত্যের সঙ্গে নারী, অপরাধ, অবৈধ যৌনতা ইত্যাদিকে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আটের দশকে এই ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন অদ্রীশ বর্ধন। তাঁর সৃষ্ট নারায়ণী রূপ নিয়েছিল অপরাধ বা অপরাধীকে চিহ্নিত করতে।
বর্তমানে বাংলার নারী গোয়েন্দা হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিনমাসি। ওর ভালো নাম প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়। বোনঝি টুপুর ও বাঙালি পাঠকের কাছে গোয়েন্দার পরিচিতি মিতিনমাসি নামে। মিতিনমাসির বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানভাণ্ডার অফুরন্ত। অপরাধ মনস্তত্ত্ব, ফরেন্সিক সায়েন্স, অ্যানাটমি, ফিজিওলজি সম্পর্কে তার জ্ঞানের শেষ নেই। ঘরকন্নার পাশাপাশি ক্যারাটে বা রিভলভার চালাতেও পটু সে। মিতিনমাসির প্রথম পরিচয় পাওয়া গেল ‘পালাবার পথ নাই’ উপন্যাসে। এ ছাড়াও ‘বিষ’, ‘মেঘের পড়ে মেঘ’, ‘তৃষ্ণা মারা গেছে’, ‘গুপ্তধনের গুজব’ ইত্যাদি রচনায় মিতিনমাসির রহস্য উন্মোচন ক্ষমতা লক্ষণীয়। তার সহকারী হিসেবে আমরা পাচ্ছি তার স্বামী পার্থ ও ভাইঝি টুপুরকে। সত্য উদঘাটনে মিতিনমাসির এজেন্সি ‘থার্ড আই’-এর কোনও তুলনা নেই।
তিন
বাংলা সাহিত্যের লেখকদের কলমে অসংখ্য গোয়েন্দার অবির্ভাব ঘটেছে। কেউ কেউ সৃষ্টি হয়েই হারিয়ে গিয়েছে। কেউ আবার শিশুকিশোরদের মনে জায়গা করে নিয়েছে। কেউ কেউ আবার বাঙালি জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। শুধু সাহিত্যের পাতায় নয়, সিনেমার পর্দাতেও স্থায়ী আসন পেয়েছে তারা। তবে জনপ্রিয়তার নিরিখে নিঃসন্দেহে ব্যোমকেশ ও ফেলু মিত্তির এগিয়ে। অবশ্য পুরুষ গোয়েন্দার পাশাপাশি নারী গোয়েন্দার সৃষ্টিও নেহাত কম নয়। যেমন— সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘বিন্দিপিসি’, সুকুমার সেনের ‘ইন্দুমতী’, আশাপূর্ণা দেবীর ‘কাজল’, নবনীতা দেবসেনের ‘সারা’ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য নয়, তবুও টিভির পর্দায় ‘গোয়েন্দাগিন্নি’-র জনপ্রিয়তা সেই কথাই বলে।
লেখার শেষে মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের কথা। তিনি একটাও গোয়েন্দা কাহিনি লিখবেন না তা হতে পারে না। গোয়েন্দা গল্পের প্রতি তাঁরও বেশ ঝোঁক ছিল। ‘ডিটেকটিভ’ গল্পটি তাঁরই লেখা। এই গল্পের গোয়েন্দা হিসেবে মহিমচন্দ্র বিখ্যাত হয়ে আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বহু মানুষের যাতায়াতের কারণে ব্রিটিশ শাসনকালে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর শান্তিনিকেতন গোয়েন্দাদের নজরে পড়েছিল। গোয়েন্দা খাতায় রবীন্দ্রনাথের পরিচয়টা ছিল এইরকম— ‘Rabi Tagore, I.B suspect Number 11.’ তাঁর নামে আসা চিঠি তাই চেক করে তাঁর কাছে পাঠানো হতো। একবার ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে আসা দুটি চিঠি একটি খামে ভরে ডাকঘর থেকে পাঠানো হলে তাঁর বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা দৃঢ় হয়েছিল।