হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
তখন রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের টুকরো টুকরো লেখাই পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে পড়েছি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জলসত্র’ নামে গল্পটি প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছি, কিন্তু তারাশঙ্কর! ইনি আমার কাছে যেন স্বর্গের দেবতা হয়ে ধরা দিলেন— তা-রা-শ-ঙ্ক-র! ওই বইতে ‘ডাকহরকরা’, ‘কালাপাহাড়’, ‘নুটু মোক্তারের সওয়াল’ প্রভৃতি গল্পগুলো পড়ে আমি যেন অন্য জগতে চলে গেলাম।
কিশোর বয়সেই আমি আমার আরাধ্য দেবতার ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘গণদেবতা’, ‘কবি’, ‘কালিন্দী’ ও ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ একাধিকবার করে পড়ে ফেলেছি। ততদিনে অবশ্য জেনে গিয়েছি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লাভপুরের মানুষ হলেও উনি থাকেন কলকাতার টালা পার্কে।
তাই একদিন ঠিকানা খুঁজে ঠিক চলে গেলাম ওঁর টালা পার্কের বাড়িতে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে উনি তখন যাচ্ছিলেন শৈলজানন্দের বাড়িতে। পথেই ওঁকে প্রণাম করে আমার আসার হেতু জানালাম। উনি খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘ওরে ব্বাপ, হাঁসুলি বাঁক এত ভালো লেগেছে তোমার?’
তারপরই জানতে চাইলাম, ‘ওই জায়গায় কীভাবে যাওয়া যায়?’
উনি আমাকে পথ নির্দেশিকা দিলেন, ‘এখান থেকে সোজা বোলপুর, সাঁইথিয়া হয়ে আমোদপুর। সেখান থেকে ছোট রেলে লাভপুর। লাভপুরে গেলেই পৌঁছে যাবে হাঁসুলি বাঁকে।’
এরপর একদিন পনেরোটি টাকা সম্বল করে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। লাভপুরের প্রকৃতি দেখে মন ভরে গেল। ভাবলাম, দেখে আসি তারাশঙ্করবাবুর গ্রামের বাড়িটাও। অবশ্যই দূর থেকে। স্টেশনেই একজনের কাছে জানতে চাইলাম, ‘তারাশঙ্করবাবুর বাড়ি কোনদিকে বলতে পারেন?’
সেই ভদ্রলোকই জানালেন যে, গতকালই তারাশঙ্করবাবু দিল্লি থেকে ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে এখানে এসেছেন।
আমি লাভপুরের লালমাটির পথ ধরে কিছুটা এগতেই পৌঁছে গেলাম ধাত্রীদেবতায়। স্থির করলাম, এই ভরদুপুরে ওঁকে বিরক্ত করব না। বিকেলে আসব। কিন্তু ভাবি এক, হয় আর এক। আমি কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে বাড়িটা দেখতে লাগলাম। বাড়ি তো নয় যেন একটি আশ্রম।
হঠাৎই আমারই বয়সি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ একটি ছেলে বাড়ির ভেতর থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল, ‘কাউকে খুঁজছেন?’
আমি হেসে বললাম, ‘কাউকে নয়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি দেখতে এসেছি।’
‘ও। কিন্তু বাবুর সঙ্গে তো এখন দেখা হবে না। বাবু এখন ঘুমচ্ছেন। তাছাড়া বাবু এখন অসুস্থ। বাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলে বিকেল চারটের পর আসবেন।’
এই কথাবার্তার ফাঁকে মধ্যবয়সি একজন খালি গা, ধুতি পরা ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার সঙ্গে কথা বলছিস রাম?’
‘জানি না বাবু। উনি এসেছেন কলকাতা থেকে। বাবুর সঙ্গে দেখা করতে।’
যিনি এলেন তিনি হলেন তারাশঙ্করবাবুর ছোট ভাই পার্বতীশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। পার্বতীবাবু বললেন, ‘কাদের ছেলে তুমি? এখানে কাদের বাড়ি এসেছ?’
আমি সব বললাম।
উনি বললেন, ‘না না না। নিশ্চয়ই বাবা-মার বকুনি খেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ! একেবারেই ছেলেমানুষ।’
এই কথার মাঝে অপ্রত্যাশিতভাবে সেখানে এসে হাজির হলেন তারাশঙ্কর জননী। পার্বতীবাবু ও রামের মুখে আমার বৃত্তান্ত শুনে আমার একটি হাত ধরে বললেন, ‘এই ভরদুপুরে এমন ফুটফুটে চেহারা নিয়ে ব্রাহ্মণ সন্তান, কে তুমি? আমি তো তোমাকে ছাড়ব না বাবা। এসো, ভেতরে এসো। খাবে চলো।’
আমার তখন নিজের ছেলেমানুষি ভাবের জন্য খুব লজ্জা করছিল।
আর পার্বতীবাবুকে বললেন, ‘এই! এখনই এর থাকার ব্যবস্থা করে দে।’
বিকেল হতেই তারাশঙ্করবাবু বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। বললেন, ‘কই, কে এসেছ ভাই কলকাতা থেকে?’
হাসিমুখে উঠে গিয়ে প্রণাম করলাম বাংলা সাহিত্যের চতুর্থ সম্রাটকে।
উনি আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘মায়ের মুখে তোমার কথা শুনলাম।’
তারাশঙ্করবাবুর পরনে ছিল ভাঁজ করে পরা ধুতি। খালি গা। গলায় শুভ্র উপবীত। ছোট্ট একটি রুদ্রাক্ষের মালাও ছিল।
আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘এখানকার ঠিকানা তুমি পেলে কার কাছ থেকে? আর আমি যে অসুস্থ হয়ে গ্রামে এসেছি সে খবরই বা দিল কে?’
আমি তখন কয়েকমাস আগে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ব্যাপারটা মনে করিয়ে দিলাম।
উনি বললেন, ‘মনে পড়েছে। তাই তোর মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে।’
একটু পরেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। শুরু হল ঝড়। তারপর বৃষ্টি নামল মুষলধারায়। ইতিমধ্যে রামের সঙ্গে আমার সহোদর ভাইয়ের মতো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। ঝড়-বৃষ্টি থামলে সন্ধেবেলায় রাম এসে বলল, ‘বাবু আমাকে দোকানে পাঠাচ্ছেন, আমার সঙ্গে যাবেন আপনি?’
আমি তো এককথায় রাজি।
ও আমাকে বাবুর ঘরে নিয়ে গেল।
রাম বলল, ‘বাবু, ষষ্ঠীদাকে নিয়ে যাব?’
তারাশঙ্করবাবু বললেন, ‘নিশ্চয়ই নিয়ে যাবি। ও তো আমাদের গ্রাম দেখবে বলেই এসেছে।’
অনুমতি পেয়ে আমি তো বেজায় খুশি। রাম বলল, ‘আজ তো রাত ন’টার সময় মা ও বড় দাদাবাবু আসছেন। আমরা স্টেশনে যাচ্ছি, ওঁদের নিয়ে আসতে। আপনি যাবেন?’
বললাম, ‘যাবেন মানে? তোমরা নিয়ে গেলেই আমি যাব।’
রাতে অন্ধকার গ্রাম্য পথ ধরে আমরা কয়েকজন চললাম স্টেশনের দিকে। কী মজা! পথে যেতে যেতে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়ে গেল আমার।
ট্রেন এল যথাসময়ে। তারাশঙ্করবাবুর স্ত্রী এবং বড় ছেলে সনৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ট্রেন থেকে নামলেন।
পথে যেতে যেতে সনৎবাবু রামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাঁ রে রাম, তোদের সঙ্গে এই ছেলেটি কে? আগে তো কখনও দেখিনি একে?’
রাম তখন আমার বৃত্তান্ত শোনাল।
সে কী আদর পেলাম সকলের কাছ থেকে। লাভপুরের মাখা সন্দেশ খাওয়ালেন তারাশঙ্করবাবুর স্ত্রী। সে রাতেই আমি ওঁদের পরিবারের একজন হয়ে গেলাম।
সনৎবাবু আমার ব্যাপারে সব কিছু জেনে নিলেন। দশম শ্রেণিতে পড়তে পড়তে পারিবারিক কারণে আমাকে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিতে হয়েছে জেনে অত্যন্ত দুঃখ পেলেন। আমি লেখালেখি করি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। কয়েক সপ্তাহ আগে আমারই লেখা মহাকবি অমরু পড়ে দারুণ ভালো লেগেছে ওঁর। আমি যে সেই ষষ্ঠীপদ তা জেনে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
পরদিন সকালে তারাশঙ্করবাবু ঘুম থেকে উঠে খোঁজ নিলেন আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না।
জলযোগ পর্ব শেষ হতে সনৎবাবু আমাকে নিয়ে চললেন সেখানকার অধীশ্বরী দেবী ফুল্লরা মাকে দর্শন করাতে। শুধু আমি নয়, পরিবারের অন্যান্য ছেলেরাও চলল আমাদের সঙ্গে।
সেদিনের সেই আনন্দের তুলনা নেই।
দর্শনান্তে ধাত্রীদেবতায় ফেরার পর তারাশঙ্করবাবু আমাকে বললেন, ‘কেমন লাগছে গো আমাদের দেশ?’
আমি হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললাম, ‘দারুণ।’
আবার এক প্রস্ত চা-পর্ব হল।
সনৎবাবু আমাকে ও অন্যান্য ছেলেদের নিয়ে এক উন্মুক্ত প্রান্তরের ধারে ওঁদের আমবাগানে এসে হাজির হলেন। তারপর সে কী আম পাড়ার ধুম। সনৎবাবু আমার একটা হাত ধরে বললেন, ‘চলো, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।’
আমি সাগ্রহে এগিয়ে গেলাম।
বাগানের শেষপ্রান্তে গিয়ে দূরের দিকে আঙুল দেখিয়ে সনৎবাবু বললেন, ‘ওই যে দেখছ জায়গাটা, ওখানেই বিখ্যাত হাঁসুলি বাঁক। এবারে তো আমার সময় হবে না, না হলে তোমাকে নিয়ে যেতাম। পরে সময় হলে দেখাব।’
সেবার অবশ্য হয়নি। তবে, পরবর্তীকালে আমি নিজে গিয়ে জায়গা দেখে এসেছিলাম।
আমরা আম নিয়ে ফেরার পর রাম আমাকে পাশের পুকুরে স্নান করতে নিয়ে গেল। তখন তারাশঙ্করবাবুও গিয়েছেন ওই পুকুরে স্নান করতে। বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পীর সঙ্গে স্নান করলাম একই পুকুরে, একই সঙ্গে।
ধাত্রীদেবতায় তেরাত্রি বাস করে আমি আমাদের গ্রামের গাজন দেখতে যাব বলে বিদায় চাইলাম। কিন্তু তারাশঙ্করবাবু কিছুতেই ছাড়তে চাইলেন না। বললেন, ‘তুমি আমাদের সঙ্গে টালা পার্কের বাড়িতেই যাবে। ওখান থেকে রাম তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে। না হলে অনেক দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকব আমরা।’
আমি বললাম, ‘আমার জন্য আপনারা একেবারেই চিন্তা করবেন না। গাজনের ব্যাপারটা না থাকলে আমি রয়েই যেতাম।’
তখন তারাশঙ্করবাবু বললেন, ‘একান্তই যখন যেতে চাইছ, তখন এসো। তবে, বাড়ি ফিরেই কিন্তু আমার সঙ্গে কলকাতায় দেখা করবে।’
এক সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হলাম টালাপার্কের বাড়িতে। আমি যাওয়ায় কী যে খুশি হলেন তারাশঙ্করবাবু তা বলে বোঝাতে পারব না। যেন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে এমন ভাব। দিনটা ছিল বোধ হয় রবিবার। সনৎবাবুও বাড়িতে ছিলেন। আমাকে দেখার জন্য তখন বাড়ির ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকি চলতে লাগল। সবারই কৌতূহল তখন কে ষষ্ঠী, কে সেই বাড়ি পালানো ছেলে! তবে, সবার চেয়ে বেশি খুশি হল রাম।
বিদায় নেওয়ার সময় সনৎবাবু বললেন, ‘আমাদের যেন ভুলে যেও না। বাবা আর আমি দু’জনেই তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। তা এক কাজ করো, তুমি প্রতি রবিবার সকালে আমাদের বাড়িতে চলে এসো। বাবার কাছে বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি আসেন। খুব ভালো লাগবে তোমার।’
এরপর থেকে আমার যেন এক নতুন জীবন শুরু হল। প্রতি রবিবার চলে যেতাম তারাশঙ্কর দর্শনে। কত জ্ঞানীগুণীর সমাগম হতো সেখানে। তারাশঙ্করবাবু তাঁর লেখার ঘরে বসে লেখালেখির কাজ করতেন। সেখানেই বসতাম আমরা। আমি গেলেই উনি হাঁক দিতেন, ‘সনৎ, ষষ্ঠী এসেছে।’
সনৎবাবু ভেতর থেকে এসে আমার গাল টিপে বলতেন, ‘আগে আমরা চা-পর্বটা সেরে নিই। তারপর বাবার ঘরে বসব।’
তারাশঙ্করবাবু সেই সময় ‘গ্রামের চিঠি’ লিখতেন। সেগুলি পড়ে শোনাতেন। তারপর মাঝে মধ্যে সনৎবাবু আমাকে নিয়ে চলে যেতেন কবি সজনীকান্ত দাসের বাড়িতে। সজনীকান্ত দাস তখন প্রয়াত। তাঁর ছেলে রঞ্জন দাস তখন ‘শনিবারের চিঠি’র দপ্তর দেখছেন। সনৎবাবু ও আরও দু’ একজন এসে গল্প জমাতেন।
এইভাবেই এই বাড়ির স্নেহ-ভালোবাসার আশ্রয়ে দিন কাটছিল আমার। হঠাৎ করেই পেয়ে গেলাম রেলে চাকরি। তিন বছর একটানা চাকরি করে রেলের পাস নিয়ে বেড়াতে চলে যাই জ্বালামুখী-কাংড়া অঞ্চলে। কিন্তু ঘুরে এসে সে চাকরি ছেড়ে দিলাম। তারাশঙ্করবাবু প্রচণ্ড বকাবকি করলেন আমাকে। তারপরই একটা অস্থায়ী চাকরি পেলাম ডালহৌসির টেলিফোন ভবনে। এক সপ্তাহ চাকরি করার পর সে চাকরিও ভালো লাগল না বলে ছেড়ে দিলাম। আবার বকুনি।
আমি তখন অবধূতের সঙ্গেও দারুণ পরিচিত হয়ে গিয়েছি। অবধূত আমাকে আঁকড়ে ধরলেন। সময় পেলেই ওঁর ওখানে গিয়ে বাড়ির ছেলের মতো থাকি।
তারাশঙ্করবাবু বলতেন, ‘ষষ্ঠী, ওই মহাতান্ত্রিককে তুমি বশ করলে কী করে?’
সনৎবাবু বলতেন, ‘ও তো কাউকে বশ করেনি। আমরাই ওর মোহে পড়ে গিয়েছি।’
তারাশঙ্করবাবুর জন্মদিনে হতো দারুণ উৎসব। ৮ শ্রাবণ একটা স্মরণীয় দিন হয়ে থাকত। সেই দিনটি ছিল খুবই আনন্দের। প্রায় রবিবার শৈলজানন্দ আসতেন। তিনিও ভালোবাসতেন আমাকে। শৈলজানন্দ তো পাড়ারই একজন।
একটি রবিবারের কথা, আমার বেশ মনে আছে। কলকাতার পুলিস কমিশনার পি কে সেন ও তাঁর ভাই এলেন তারাশঙ্করকে প্রণাম জানাতে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সনৎবাবু বললেন, ‘ওর একটাই দোষ, কাজকর্ম করবে না শুধু সাহিত্য করবে বলে রেলের চাকরি, টেলিফোন ভবনের চাকরি সব ছেড়ে দিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওকে কীভাবে ফাঁদে ফেলা যায় বলুন তো?’
সিপি এবং তাঁর ভাই দু’জনেই চমকে উঠলেন শুনে। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে। কাল ওকে অফিসে আসতে বলুন। ওর ব্যবস্থা আমরাই করে দেব। ওকে এবার যে চাকরি করে দেব, সে চাকরি ছাড়লেই সোজা হাজতবাস।’
সে চাকরি হয়েছিল সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিস কর্ডনিং অ্যান্ড ভিজিলেন্স সেলে। আমার মনের মতো চাকরি।
আর একবার হল কী এক রবিবার সকালে দুটো লোক এলেন তারাশঙ্করবাবুর বাড়িতে। সনৎবাবু বললেন, ‘বাবা, এঁরা আপনার হাতটা একটু দেখতে চান!’
তারাশঙ্করবাবু বললেন, ‘বাবু হে, আমার হাত দেখে কী হবে? আমার তো নাড়ি নক্ষত্র সবই সবাই জানে। বরং ওই যে তোমার পাশে ষষ্ঠী বসে আছে, ওকে এগিয়ে দাও। ওর হাতটা দেখুক ওরা। ওকে তো দেখেনি আগে, চেনেও না কেউ। দেখি ওর হাত দেখে কী বলে।’
যেহেতু তারাশঙ্করবাবু বলেছেন, তাই আমার ব্যাপারে আগ্রহী হলেন ওঁরা। দু’জনের একজন হাত দেখেই শিউরে উঠলেন। বললেন, ‘এ কী! এও কি সম্ভব! এই বয়সের মধ্যে এ তো দেখছি সারা ভারতের বহু জায়গায় ঘুরেছে। আর ভবিষ্যতে সারাটা জীবন ও ঘুরে ঘুরে বেড়াবে। সত্যি, এরকম ভ্রমণযোগ সচরাচর দেখা যায় না। বলা উচিত নয়, তবু বলি, তীর্থমৃত্যু যোগ আছে এর।’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘লেখালেখি করলে সুনাম অর্জন করবে। তবে ওর পড়াশোনার পাঠ চুকে গিয়েছে। পড়াশোনা শেষ।’
তারাশঙ্করবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘একদম ঠিক। আমি জ্যোতিষ বিশ্বাস করতাম না। আজ আমার বিশ্বাস হল।’ যাই হোক, তিনি হাত দেখালেন না।
সবাই চলে যাওয়ার পর সনৎবাবু আমাকে বললেন, ‘ষষ্ঠী, আমি এবারে যা বলি তা মন দিয়ে শোনো। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের নাম শুনেছ তো? এক জ্যোতিষী তাঁর হাত দেখে বলেছিলেন হাতের রেখাটা যদি আর একটু এগিয়ে আসত তাহলে আপনি বিশ্বজয় করতে পারতেন। শুনে উনি হেসে বলেছিলেন, বেশ তো, নিজের হাতের রেখা আমি নিজেই তৈরি করে নিচ্ছি। এই বলে তরোয়াল দিয়ে চিরে হাতের রেখা তৈরি করে নিয়েছিলেন। সেইভাবে তুমিও আবার লেখাপড়ায় মন দাও। তুমি প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষাটা দিয়ে পাশ করো এবং মূর্খ নামটা ঘোচাও। বড় বড় কাগজে লেখা বেরচ্ছে তোমার আর তুমি কিনা নন-ম্যাট্রিক হয়ে বসে থাকবে! আমি তা হতে দেব না।’
অতএব শুরু হল পড়াশোনা। পাশও করলাম। তারাশঙ্করবাবু ও সনৎবাবু অনেক আশীর্বাদ করলেন আমাকে।
সেবার তারাশঙ্করবাবু জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেলেন। যাঁরা সেই পুরস্কার দিয়েছেন তাঁরা এলেন সংবর্ধনা জানাতে। আমিও ছিলাম সেদিন। অলক মিত্র এলেন ছবি তুলতে। তারাশঙ্করবাবু আদরের ছোট্ট নাতনি লালিকে কোলে নিয়ে বসলেন। অন্যান্য নাতি-নাতনি সবাইকে ডাকলেন। সনৎবাবুও আমাকে সঙ্গে নিয়ে পাশে বসলেন। ছবি উঠল। আমি ওঁদের পরিবারে সবার সঙ্গে যেন এক হয়ে গেলাম। এইরকম কত স্মৃতি যে জমা হয়ে আছে আমার তা বলে শেষ করা যাবে না।
তারপর একদিন এল সেই অন্তিম মুহূর্ত মৃত্যুরূপী মহাকালের অমোঘ নিয়মে দেহাবসান হল বাংলা সাহিত্যের চতুর্থ সম্রাটের। টালাপার্কের বাড়ি থেকে নিমতলা শ্মশান পর্যন্ত আমার মহাগুরুর মরদেহ নিয়ে শেষযাত্রা করলাম। আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ধারাভাষ্য দিলেন। শ্মশানে সম্রাটের নশ্বর দেহ চিতায় তোলার পর ছলছল চোখে সনৎবাবু আমার কাঁধে হাত রেখে একটাই কথা উচ্চারণ করলেন, ‘বাবা।’
অঙ্কন : সুব্রত মাজী
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়