হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
শুধু কথামৃতে আজকের মানুষের মন ভরে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অমৃতবাণীর প্রচারক সাধুসন্ততির মধ্যে দক্ষিণেশ্বরের পূজারী বাউনের ভাগ্য ভালো তাঁর সময়ে ফোটোগ্রাফির জয়যাত্রা সবে শুরু হয়েছে এবং তার কয়েকটি আলোকচিত্র আমাদের কাছে এসেছে, যা বুদ্ধ, খ্রিস্ট, শঙ্করাচার্য, শ্রীচৈতন্য কারও ক্ষেত্রেই ঘটেনি। সেই ফোটোচিত্রের সংখ্যা আর ক’টি! শ্রীরামকৃষ্ণের সবক’টি ছবিও আমাদের হাতে নেই। তাঁর ডাক্তার ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত যেসব ছবি তুলেছিলেন অজ্ঞাত কারণে তার নেগেটিভ গঙ্গার জলে ফেলে এসেছিলেন। বাকি ছবির কোনটা কীভাবে কোন কোম্পানির কোন আলোকচিত্রী কোথায় তুলেছিলেন, আবার রামকৃষ্ণ কীভাবে কলকাতার প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফারের স্টুডিওতে এলেন সে নিয়ে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের যথেষ্ট কৌতূহল আজও অব্যাহত। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছাড়াও আছেন তাঁর সমকালের পুরুষ ও মহিলারা, তাঁদের দেখতে কেমন, কেন তাঁরা বিস্মৃতির আলো-আঁধার থেকে আবার বেরিয়ে এলেন সে নিয়ে যা অনুসন্ধান ও উদ্ধারকর্ম হয়েছে, তা নিয়ে কাশীপুরে অন্ত্যলীলাপর্ব থেকে অনুসন্ধান, সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও গবেষণা আজও চলছে দেশে এবং বিদেশে।
গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৩৬। দেহাবসান ১৮৮৬। কিন্তু তাঁর প্রথম আলোকচিত্র কবে এবং কোথায় কীভাবে তোলা হল সে সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় খবর স্বামী চেতনানন্দ সংগ্রহ করে রেখেছেন। প্রথম ছবির তারিখ ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৭৯, উদ্যোক্তা কেশবচন্দ্র, স্থান তাঁর আপার সার্কুলার রোডের বাড়ি ‘কমল কুটীর’। কে এই ছবি তুলল, তার সন্ধান মিলল দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বিশেষ সংগ্রহ থেকে, একটা ফোটোর পিছনে উল্লেখ রয়েছে ‘দ্য বেঙ্গল ফোটোগ্রাফার্স, প্রতিষ্ঠা ১৮৬২’। একশো বছর পরে (১৯৬৩) আমেরিকান গবেষক সন্ন্যাসী স্বামী বিদ্যাত্মানন্দ কলকাতার ওই ঠিকানায় গিয়ে স্টুডিওর খোঁজ পেলেন না, আমেরিকান সন্ন্যাসী খুঁজছিলেন ঐতিহাসিক ছবির প্লেট।
এই বিখ্যাত প্রথম ছবিতে আরও চরিত্র আছে— বাহ্য চৈতন্য বিলুপ্ত রামকৃষ্ণকে ধরে রয়েছেন তাঁর ভাগিনেয় ও সেবক হৃদয়রাম। এই ছবিতে আরও যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের সবাইকে শনাক্ত করা যায়নি আজও। একমাত্র ব্যতিক্রম ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল।
আরও কিছু ছবি সংগৃহীত হয়েছে— শ্রীরামকৃষ্ণ চাইতেন না যে, কেউ তাঁর ছবি তুলুক। তিনি সমাধিস্থ না হলে তাঁর ছবি তোলা যে যেত না, তাও জানা যাচ্ছে।
দ্বিতীয় ছবিটির তারিখ ১০ ডিসেম্বর ১৮৮১, শনিবার। শ্রীরামকৃষ্ণের পরিধানে একটি ধুতি, একটি লম্বা হাতা পাঞ্জাবি ও একটি কোট, পায়ে চটি-জুতো। ছবির পিছনে তারিখ ১০ ডিসেম্বর ১৮৮১। ‘সুরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁকে গাড়ি করিয়া বেঙ্গল ফোটোগ্রাফার্স স্টুডিওতে লইয়া গেলেন, ফোটোগ্রাফার তাঁহাকে দেখাইলেন কীরূপে ছবি তোলা হয়। কাঁচের পিছনে কালি মাখানো হয়, তারপর ছবি ওঠে।’
এই দ্বিতীয় ছবি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা, শ্রীরামকৃষ্ণ কি জুতো পরেছেন? পরে গবেষকরা বলেছেন, ধুতির নীচে তাঁর পদযুগল ছায়ায় আচ্ছাদিত, তাই কালো দেখাচ্ছে। চটি-জুতো সুস্পষ্ট দৃশ্যমান।
বিদেশি সন্ধানীরা জানাচ্ছেন এই আলোকচিত্র থেকেই ঠাকুরের প্রথম তৈলচিত্র তৈরি হয়েছিল। তারিখও পাওয়া যাচ্ছে ১০ ডিসেম্বর ১৮৮১— ২৭ অক্টোবর ১৮৮২। এর খবরও যে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে রয়েছে তাও আমরা জানি। এই আলোকচিত্রের প্রিন্ট যে ঠাকুর দেখেছিলেন, তার ইঙ্গিতও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু কে তাঁর প্রথম তৈলচিত্র অঙ্কন করেছিলেন? অদ্বৈত আশ্রমের নেগেটিভে একটি অস্পষ্ট স্বাক্ষর দেখা যায়। ‘Vilg’, কিন্তু তিনি কে তা আজও আবিষ্কারের অপেক্ষায়।
এবার সেই বিখ্যাত চিত্র যেখানে একটি সাদা কাপড় পরে কটিদেশ ও ঊরু আবৃত করে ঠাকুর বসে আছেন দক্ষিণেশ্বরে রাধাকান্ত মন্দিরের পশ্চিম দিকে। বরানগরের ভক্ত ভবনাথ চট্টোপাধ্যায় ঠাকুরের এই ছবি তুলতে চান, বরানগর থেকে এক ফোটোগ্রাফার চলে আসেন। এই ছবির ডিরেকশন দেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত। এই ছবি দেখেই ঠাকুর বলেছিলেন— ‘এই ছবি কালে ঘরে ঘরে পূজা হবে।’ ফোটোগ্রাফার অবিনাশচন্দ্র দাঁ ১৮৮৩ সালের অক্টোবর, রবিবার সকাল সাড়ে ৯টায় এই ছবি তোলেন। এই তারিখ নিয়ে সামান্য মতভেদ আছে। অন্য মত ২ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪। স্বামী অভেদানন্দ লিখেছেন, ‘এই ছবির কাচের নেগেটিভ দাঁয়ের হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল এবং মূল ছবিটি রক্ষা করতে দাঁ নেগেটিভের উপরিভাগ গোলাকারে কেটে দিয়েছিলেন। মূল ফোটোর প্রতিচিত্রের সংখ্যা ছিল ছয়টি।’
চতুর্থ ও পঞ্চম আলোকচিত্র তোলা হয়েছিল মহাসমাধির পরে কাশীপুরে ১৬ আগস্ট ১৮৮৬, এবারেও বেঙ্গল ফোটোগ্রাফারের। উদ্যোক্তা ঠাকুরের চিকিৎসক ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। তিনি এর জন্য ১০ টাকা দিয়েছিলেন। এই দু’টি ছবির ঐতিহাসিক মূল্য নিদারুণ। অনেকের দুঃখ, বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দের দেহাবসানের পর এমন ছবি স্বামী ব্রহ্মানন্দ তুলতে দেননি।
আরও যে ফোটোগ্রাফের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, তা ঠাকুরের পছন্দ না হওয়ায় ভক্ত ডাঃ রামচন্দ্র দত্ত গঙ্গায় নেগেটিভ ফেলে দিয়েছিলেন বলে অনেকের বেজায় দুঃখ।
দ্বিতীয় আলোকচিত্রে ফিরে আসা প্রয়োজন। যাঁর ছবি তিনি নেই, যে স্টুডিওতে ছবি তোলা তাও নেই। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের পরিধান ও কোটটি রয়ে গিয়েছে যা পরবর্তীকালের গবেষকদের খুব কাজে লেগে গিয়েছে। ভক্তরা শ্রীরামকৃষ্ণের দেহের দৈর্ঘ্য কখনও নির্ধারণ করেননি। স্বামী নির্বাণানন্দ ফেলে যাওয়া কোটটি মেপে এবং কোটটির সঙ্গে রামকৃষ্ণের আকৃতির সম্বন্ধ হিসেব করে মেপে ফেললেন, ঠাকুরের দেহের দৈর্ঘ্য ছিল পাঁচ ফুট সাড়ে নয় ইঞ্চি। এই স্থির চিত্র পরবর্তীকালে ঠাকুরের প্রথম মর্মর মূর্তি তৈরির সময় খুব কাজে লেগে গিয়েছিল। কলকাতায় তৈরি এই মূর্তি এখন রয়েছে বারাণসীর অদ্বৈত আশ্রমে।
এই আলোকচিত্র থেকেই শ্রীমা সারদামণির উক্তি— ‘এখানকার লোক সব সেয়ানা— ছবিটা তুলে নিয়েছে। কোন অবতারের কি ছবি আছে?’ তিনি আরও বলেছেন, ‘ছবি তো তাঁরই ছায়া। তাঁর ফোটো দেখলেই হবে। ফোটোতে তিনি স্বয়ং রয়েছেন।’
আমেরিকান গবেষক স্বামী বিদ্যাত্মানন্দ বলেছেন, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ছবি তোলার বিরোধী ছিলেন না। ছবি তোলার ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর আকৃতি ও চেহারার সুস্পষ্ট প্রতিকৃতি রক্ষা করার অনুমতি দিয়েছিলেন।’
স্টুডিওতে তোলা শ্রীরামকৃষ্ণের দু’নম্বর ছবিটি নিয়ে এবং সংগ্রহশালার সুরক্ষিত জামা নিয়ে পরবর্তীকালে একটি অনন্য ছবি তৈরি করে তা স্বামী চেতনানন্দের নতুন বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন জীবিতকালের তিনটি আলোকচিত্র ও একটি তৈলচিত্র থেকে কীভাবে মার্কিন দেশে অর্ধশতাব্দী ব্যয় করা সেন্টনুইস বেদান্ত সোসাইটির সভাপতি একদা খুলনার রিফিউজি চেতনানন্দ এই ৬৩৯ চিত্রের বিস্ময়কর রামকৃষ্ণ গ্রন্থ প্রস্তুত করলেন?
স্বামী চেতনানন্দ আমাকে বললেন, ‘এই চিত্রমালার সংগ্রহ ও পরিকল্পনা সেই শুরু থেকে। ১৯৭০ সালে মায়াবতীতে গিয়েছিলাম এবং সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের একটা চিত্রজীবনী তৈরি করি, যা ১৯৭৬ সালে অদ্বৈত আশ্রম থেকে প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই সংগ্রহ আমাকে তৃপ্তি দেয়নি।’
‘আমেরিকা থেকে কয়েক বছর অন্তর ভারতবর্ষে যাই এবং দু’-তিনটি ক্যামেরা ও কোডাক ফিল্ম নিয়ে ঠাকুর সংক্রান্ত দশ হাজার ছবি তুলি।’
আমার আমেরিকান বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা ছাড়া এই ঐতিহাসিক দলিল সংগ্রহ ও মুদ্রণ সম্ভব হতো না।’ খ্যাতনামা গ্রাফিক আর্টিস্ট ডায়েন মার্শাল দু’বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে ছবিগুলি সাজান। ২০১৮ সাল থেকে এই সংগ্রহের উপর আমরা কাজ করি, যাতে রামকৃষ্ণকালের কোনও কিছু ছবি বাদ না পড়ে। ছবিগুলো ডিজিটালাইজ করতে জন লুইসের ছ’বছর লাগে। এই বইয়ের ছবিগুলি সংগ্রহ করে, তা মুদ্রণোপযোগী করাও মস্ত এক চ্যালেঞ্জ ছিল। ছাপার জন্য ভক্তরা ঠিক করেন কানাডার বিখ্যাত প্রিন্টার ফ্রাইমেনকে। এই বইতে রামকৃষ্ণের সমকালীন ব্যক্তিত্বের ছবিগুলির পুনরুদ্ধার ছিল মস্ত কঠিন কাজ। যেমন ঠাকুরের সপ্তদশ সন্ন্যাসী সন্তানের ছবিটি— আদিতে এই ছবিতে ছিলেন ১৮৯৬ সালে আলমবাজারে তোলা মাত্র কয়েকজন। তারপর ডিমার্শাল ইলেকট্রনিক যন্ত্র সাহায্যে বাকি সাতজনের ছবি জুড়ে দিয়ে এই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবিটি তৈরি করলেন। এই মার্শালের তৈরি গদাধরের প্রথম সমাধির উৎস সাদা বকদের ছবিও আমাকে বিস্মৃত করে।
বিভিন্ন উৎস থেকে সমসাময়িক কালে ভক্ত ও ভক্তিমতীদের ছবি স্বামী চেতনানন্দ সংগ্রহ করেছেন। যেমন পাঠশালায় গদাধরের সহপাঠী গয়াবিষ্ণু লাহা ও হারাধন দত্ত।
খ্যাত অখ্যাত সমকালের মানুষদের ছবি উদ্ধার করেছেন স্বামী চেতনানন্দ। কোনও চরিত্র, কোনও জায়গা বাদ যায়নি। এই সম্পাদনা কাজে যাঁরা তাঁর বিশেষ সহায়তা করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন— কিমকেন্ট, শুদ্ধপ্রাণা ও লিন্ডাপ্রু।
বলা হয়, শ্রবণ ও পাঠে যা পাওয়া যায় তার সহস্রগুণ প্রাপ্তি রয়েছে চোখের দেখায়। তাই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের সঙ্গে আমাদের বিশেষ প্রয়োজন ছিল এক রামকৃষ্ণ চিত্রামৃতের যেখানে কামারপুকুরের ধর্মদাস লাহার বিধবা কন্যা প্রসন্নময়ী দেবীর দুর্লভ ছবি থেকে কেশব সেন, বঙ্কিম, ঈশ্বরচন্দ্র, মথুরনাথ, জগদম্বা দাসী, যদু মল্লিক, বৈকুণ্ঠ সান্যাল, বলরাম বসু, তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণভাবিনী ও শাশুড়ি মাতঙ্গিনী ঘোষের দুর্লভ ছবি সংগৃহীত হয়েছে। সুগৃহীত ও মুদ্রিত হয়েছে ভক্ত রামচন্দ্র দত্তের স্ত্রী কৃষ্ণপ্রেয়সীর ছবি। আছে দরিদ্র ভক্ত ভগবতী দেবী ও গোলাপসুন্দরী দেবীর ছবি। শ্রীম লিখিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের সুবিখ্যাত রামলালার ছবিও স্বামী চেতনানন্দ এই সংগ্রহে ছেপেছেন। যাকে এককথায় বলা যায় শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ চিত্রামৃত। একই বইতে এমন রামকৃষ্ণকেন্দ্রিক চিত্রসংগ্রহ এর আগে কস্মিনকালেও প্রকাশিত হয়নি। যার সংকলন ও মুদ্রণ ব্যয় বহন করেছেন আমেরিকান ও প্রবাসী ভারতীয়রা।
এমন একটি চিত্র সংগ্রহের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। প্রবাসী আমেরিকানদের উৎসাহ ও উন্নত কারিগরি সহযোগিতায় এবার তা সম্ভব হল। স্বামী চেতনানন্দের অর্ধ শতাব্দীকাল বিদেশবাস সার্থক হল।
শ্রীরামকৃষ্ণের হস্তলিপি থেকে শুরু করে ভক্ত ও শত্রু-মিত্রের এমন সম্পূর্ণ সংগ্রহ যে আগে কখনও সম্ভব হয়নি বলাটা অত্যুক্তি হবে না।
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়